স্বাস্থ্যসেবীরা অশ্লেষাকাল পার করে সভ্যতার পুনরাভিষেক ঘটাবেই

এম এম খালেকুজ্জামান

কগনিটিভ ইমিউনিটি হচ্ছে এমন এক বুদ্ধিবৃত্তিক  সক্ষমতা যেটা মিথ্যা থেকে সত্য, গল্প থেকে তথ্য, তুষ থেকে শস্যকে আলাদা করার ক্ষমতা। আমেরিকার সিভিল সোসাইটির দাবি তাদের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাদের জনগণের কগনিটিভ ইমিউনিটি ধ্বংস করে দিয়ছে। সাধারণ জনসমষ্টির এক বিশাল অংশ (ট্রাম্পকে যারা ভোটা দিয়েছে) এর শিকার, ট্রাম্পের টোটকা মানতে হচ্ছে প্রেসক্রিপশনের মতো করে। 

হার্ড ইমিউনিটিকে বরণ করে নেয়া আমাদের জনগণও কম-বেশি কথিত কগনিটিভ ইমিউনিটি অর্জনের পথে। সাবেকি স্বাভাবিকতা আর কাজ করছিল না তাই  প্রকৃতিই নতুন স্বাভাবিকতার অভিষেক ঘটিয়েছে । কিন্তু মানুষ এখনো ধারণ করে সেই চিরন্তন জিজীবিষা।  

“Each patient carries his own doctor inside him”, এনাটমি অব অ্যান ইলনেস-এ নর্মান কাজিন্স রোগী ও চিকিৎসকের সম্পর্কের চিত্রায়ণ করতে গিয়ে এই কথাটি বলেন। চট্টগ্রামের ডা. সামিরুলের মৃত্যুতে তার কাছ থেকে চিকিৎসাসেবা পাওয়া রোগীরা যেন  পরিজন হারানোর বেদনায় ন্যুজ ছিলেন। মানুষ তার সবচেয়ে নাজুক সময়ে ভরসা করার মতো যাকে পায় তিনি চিকিৎসক।এবং জরাত্তীর্ণ অবস্থায় সবচে স্বস্তিদায়ক সময়েও প্রথম অভিনন্দন পায় চিকিৎসকের কাছ থেকে।ব্যক্তির জীবনযুদ্ধের মতো দেশ ও সভ্যতাগুলো যখন করোনা মোকাবেলার যুদ্ধে ব্যস্ত তখনো অগ্রবর্তী  দলেই থাকেন চিকিৎসক। জীবনে ও যুদ্ধে জড়িয়ে চিকিৎসক।২০১৯ সালে ডেঙ্গু প্রাবল্যের সময়েও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাতদিন কাজ করে শত শত মানুষের জীবন রক্ষা করেছেন কত চিকিৎসক! অসুস্থের সেবা ও আর্তের পাশে দাড়ানোর শপথ নিয়েই চিকিৎসকরা এই পেশায় আসেন। জীবিকা নির্বাহ করে বলে পেশা বটে কিন্তু জীবন বাঁচানোর কাজ করেন বলে  এ পেশাটি সমাজের অন্যান্য পেশার তুলনায় অনেক বেশি সম্মানের।

চিকিৎসক ছাড়া অন্যান্য সম্মুখসারির স্বাস্থ্যকর্মীরা করোনা ‘ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা’র মতো শাব্দিক বাগাড়ম্বরপূর্ণ অভিধা ছাড়া খুব বেশি কিছু কি পেয়েছে? জুনের তৃতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ নামের একটি  সংগঠন (যেটি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক জেমস পি গ্র্যান্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথ-এর সঙ্গে কাজ করে) এক সমীক্ষায় প্রকাশ করে- করোনা মহামারীতে দায়িত্বরত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ২৬ শতাংশ মে মাস পর্যন্ত ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী বা পিপিই পাননি। এছাড়া স্বাস্থ্যকর্মীদের পিপিইর মান এবং ব্যবহারের প্রশিক্ষণ না থাকায় তাদের উদ্বেগের কথাও উঠে এসেছে সমীক্ষায়।

সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মঈন উদ্দিন আহমেদ কভিড আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন ১৫ এপ্রিল। তিনিই প্রথম বাংলাদেশে কভিড আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা চিকিৎসক। এ পর্যন্ত আশি জনেরও অধিক চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে কভিড আক্রান্ত হয়ে। বাংলাদেশ চিকিৎসকের মৃত্যু হার অন্য অনেক আক্রান্ত দেশের তুলনায় অনেক বেশি। চিকিৎসকদের জন্য ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীর অপ্রতুলতা ও নিম্নমানের কারণে অন্যান্য দেশের তুলনায় চিকিৎসকদের মৃত্যুর হার বাংলাদেশে এত বেশি বলে অনেকেই মনে করেন। তাছাড়া সুরক্ষাসামগ্রী ব্যবহারে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাবও একটা কারণ। 

করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসকদের মধ্যে মৃত্যুহার ৩ দশমিক ২ শতাংশ। সার্বিকভাবে অন্য  পেশাজীবীদের তুলনায় চিকিৎসকদের মধ্যে মৃত্যুহার  বেশি। মহামারী মোকাবিলায় সামনের সারির বিভিন্ন পেশার আক্রান্ত  মৃত্যুর সংখ্যা পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। যদিও আক্রান্ত হার বিবেচনায় পেশাজীবীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন পুলিশ সদস্যরা। তবে আক্রান্তের তুলনায় পুলিশ সদস্যদের মৃত্যুহার শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। করোনার প্রাদুর্ভাবের প্রেক্ষাপটে সামনের সারির বিভিন্ন পেশার আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। স্বাস্থ্যকর্মীদের অধিক হারে মৃত্যু, তাদের  মনের ওপর মানসিক চাপের বিষয়টি ভাবনার বিষয়।এই তুলনা রহিত মহামারীর কালে চিকিৎসকরাই  ইস্পাত দৃঢ় মনোবল, আহরিত পেশাগত জ্ঞান এবং হার না মানা অপরাজেয় আত্মবিশ্বাস নিয়ে সম্মিলিত যুদ্ধের আয়োজনে সামনে থকে মানবতার উদ্ধারে নিয়োজিত।

করোনা মহামারীতে আক্রান্ত মানবজাতি দূর্নীতিতে আক্রান্ত স্বাস্থ্যখাত। স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি নতুন কিছু না, এই খাতের সিন্ডিকেটের কথা এখন আলোচনায়, যেন করোনা প্রাদুর্ভাবের আগে এসব ছিল না। অথচ গত ডিসেম্বরে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকের পরে কমিটির একজন প্রভাবশালী সদস্য সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি মনে করছে, স্বাস্থ্য খাতে একটি সিন্ডিকেট কাজ করছে’ (প্রথম আলো, ২২ ডিসেম্বর ২০১৯)।

দুর্নীতির কবল থেকে রেহাই পায়নি আপরিহার্য চিকিৎস সামগ্রীর কেনাকাটা ও সরবরাহ ব্যবস্থাও। আবার সেসব নিয়ে প্রতিবাদ করলে সরকারি হাসপাতালের পরিচালক পর্যায়ের চিকিৎসকদের পর্যন্ত বদলি ও শাস্তিমূলক পদায়নের শিকার হতে হয়েছে। এন৯৫ মাস্কের মোড়কে নকল মাস্ক সরবরাহ করা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালককে ওএসডি করা হয়েছে! নিম্নমানের সুরক্ষা সামগ্রী নিয়ে প্রশ্ন তোলায় শোকজ করা হয়েছে অনেক চিকিৎসককে। 

দিল্লির জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক জ্যোতি ঘোষ প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে সম্প্রতি এক নিবন্ধে লিখেছেন, উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোর অবস্থা বেশ খারাপ। স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সামগ্রী নেই। জীবন ঝুঁকিতে রেখে তাদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে যেতে হচ্ছে। অনেক ব্যক্তিমালিকানাধীন হাসপাতালে ও  সেবাকেন্দ্রে কর্মরত চিকিৎসক ও কর্মীদের বেতন কমিয়ে দেয়া হয়েছে। এই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার কারণে ভারতে অনেক চিকিৎসকেরা চাকরি ছেড়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছেন। কঙ্গোতে বেতন না পাওয়ায় চিকিৎসক ও সেবাকর্মীরা ধর্মঘট করেছেন। তাদের এই অবর্ণনীয় দূরবস্থার কথা সেভাবে আলোচনায় উঠে আসছে না। দীর্ঘায়িত  মহামারীর প্রেক্ষাপটে  পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ এখনো বাড়তির দিকেই এই অঞ্চলে। বেতন নিয়ে বাংলাদেশেও এমন অবস্থা, খোদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালেই দেখা গেছে, মাঝখানে দুমাস বেতন বন্ধ ছিল (যদিও পরে তার সমাধা হয়)। অনেক বেসরকারি হাসপাতালে রোটেশন ভিত্তিতে চিকিৎসকরা কাজ করায় স্বাভাবিক বেতনের কম বেতন পাচ্ছেন।

করোনা মহামারীর প্রাদুর্ভাবের প্রেক্ষাপটে সরকারি আর বেসরকারি ডাক্তারদের কাজের ধরন,পদ্ধতি আর প্রকরণ, অনেকটাই আর আগের মতো নাই বদলে গেছে গত কয়েক মাসে। ছোট খাট অসুখে এলাকার যেসব জেনারেল প্রাকটিশনার অথবা ছোট ক্লিনিক যে সেবা দিত সেগুলোও সেবা দেয়া বন্ধ করে রেখেছিল বেশ দীর্ঘ সময়। কারণ ডাক্তার আর রোগীর মধ্যে বিরাজ করছে দ্বিধা ও সংশয়।যেটি পরস্পরকে দূরে রেখেছে। অর্থ থাকলেও চিকিৎসা লাভ করা যাচ্ছে না। টেলিমেডিসিনই ভরসা হয়ে দেখা দেয় এই ‘নিও নর্মাল’ আবহে। ব্যক্তিগত সুরক্ষা বিষয়ে চিকিৎসকেরা আস্থা সংকটে ভুগছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য সিক্স পয়েন্টস স্ট্র্যাটেজি প্রকাশ করেছিল। সেগুলোর প্রথমটি রোগী সনাক্তে  পরীক্ষার ওপর জোর দেয়া। দ্বিতীয় কৌশলের সঙ্গে নিবন্ধের আলোচিত চিকিৎসকদের  মৃত্যু বিষয়টি সংশি¬ষ্ট।এই বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ ছিল স্বাস্থ্যসেবা খাতে পর্যাপ্ত জনবল ও রোগী ব্যবস্থাপনায় উপযুক্ত পরিমান প্রতিষ্ঠান প্রস্তুত রাখা। এর সঙ্গে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তথা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতিকাঠামো জড়িত। স্বাভাবিক সময়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চাহিদা অনুযায়ী জনবল নিয়োগ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এ কাজটি কখনই প্রয়োজন মতো হয়নি। করোনার বিস্তারের প্রেক্ষিতে বেশ কিছু চিকিৎসক নার্স নিয়োগ দেয়া হয়েছে ঠিকই কিন্তু ব্যাপারটি এমন না যে শিশু পড়ে গিয়ে পা জখম হওয়ার পর যেমন থুথু দিয়ে অ্যান্টিসেপ্টিকের   প্রলেপ দেয়ার মতো  প্রাথমিক চেষ্টা অথবা সারা বছর কাজ না করে নদীভাঙ্গন রোধে ভাঙ্গনের মুখে বালুর বস্তা বা সিমেন্ট ব্লক ফেলা, এতে বস্তা, ব্লক, অর্থ, উদ্যম সব জলে যায়।

গত এক দশকে পরিমানগত বিবেচনায় স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়লেও বাজেট হিস্যা হিসেব করলে তা সন্তোষজনক নয় মোটেই।স্বাস্থ্যখাতের দূরবস্থার প্রেক্ষাপটে এবারের বাজেটে এই খাত আরো মনোযোগ দাবি করেছিল। কিন্তু যা তাই। সুযোগ হাতছাড়া করার ব্যাপারে আমাদের একটি হতাশাজনক ঐতিহ্য রয়েছে।এবারও তার অন্যথা হলো না। বাজেটে আশা ছিল স্বাস্থ্য খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে  প্রধান উন্নয়ন খাত গণ্য করা হবে। মহামারীর প্রেক্ষাপটে  স্বাস্থ্য খাতে আগামী অর্থবছরে বরাদ্দ কিছুটা বেড়েছে সত্য। বরাদ্দ বাড়ানোই সমাধান নয়। বেহাল স্বাস্থ্য খাতে একটা সম্পূরক স্বাস্থ্য বাজেটের আশা ছিল। স্বাস্থ্যবিষয়ক একটা সার্বিক পরিকল্পনা দরকার ছিল। সেই প্রত্যাশা এই বাজেট পূরণ করতে পারেনি। বরং একে একে করোনার মতো বিষয় নিয়ে জেকেজি, রিজেন্ট এর মারণঘাতী অবহেলা নাড়িয়ে দিয়েছে সব আর এখন পর্যন্ত এর সর্বশেষ সংযোজন শাহবুদ্দীন মেডিকেল কলেজের দুর্নীতি যেন, ‘ঘোমটার আড়ালে জিভ লকলক’।

বণিক বার্তার বরাতে জানা যা, যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত চিকিৎসক ফারজানা হোসেইন দেশটির অন্যতম বর্ষসেরা চিকিৎসক নির্বাচিত হয়েছেন। করোনা মহামারীর মধ্যে সাহসিহকতা ও একাগ্রতা দিয়ে রোগীদের চিকিৎসা দেয়ায় ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে এ সম্মাননা পেলেন। দেশটির স্বাস্থ্য বিভাগের (ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস- এনএইচএস) ৭২তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে টানানো এক বিলবোর্ডে ফারজানা হোসেইনের ছবি প্রকাশিত হয়। এছাড়া এনএইচএস-এর অফিশিয়াল ওয়েবসাইটেও এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। ফারজানাসহ ১২ জন স্বাস্থ্যকর্মীকে নিয়ে বিলবোর্ড বানিয়েছে ইংল্যান্ডের এনএইচএস। কঠোর পরিশ্রম ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের স্বীকৃতিস্বরূপ তাদের জনগণের সামনে এভাবেই পরিচয় করিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়। আমাদের চিকিৎসকেরা একেকজন নানাভাবে এমন অনেক গৌরবের অংশীদার করেছেন দেশকে। আমাদের বিশ্বাস স্বাস্থ্যসেবীদের হাত ধরে এই  অশ্লেষাকাল পার করে সভ্যতার পুনরাভিষেক হবেই। 

এম এম খালেকুজ্জামান

আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

[email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন