কর্মসংস্থানের সুযোগ কমেছে ৮০ শতাংশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির ওপর কভিড-১৯ যে চাপ তৈরি করেছে, সরাসরিই তার প্রভাব পড়েছে কর্মসংস্থানে। বৈশ্বিক জায়ান্টগুলোও কর্মীবাহিনী ছোট করে আনার পরিকল্পনা নিয়েছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে তা বাস্তবায়ন করেছে। বাংলাদেশে মার্চের শুরুতে প্রথম কভিড-১৯ রোগী শনাক্তের পরবর্তী মাসগুলোতে সংক্রমণ রোধের নানা পদক্ষেপে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সংকোচন ঘটেছে। এতে কর্মসংস্থানের সুযোগ হ্রাস পেয়েছে। উল্টো বিদ্যমান কর্মীসংখ্যাই কমিয়ে এনেছে দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানই। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত এপ্রিলে কর্মসংস্থানের বিজ্ঞাপন কমেছে ৮০ শতাংশের বেশি। খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও আগের তুলনায় তা এখনো ৭০ শতাংশের মতো কম।

অনলাইন জব পোর্টালে চাকরির বিজ্ঞাপনের তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন তৈরি করেছে এডিবি। এতে বিভিন্ন খাতের তথ্য আলাদাভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ২০১৯ সালের একই সময়ে কর্মসংস্থানের সংখ্যার সঙ্গে চলতি বছরের তথ্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা এসব খাতের মধ্যে রয়েছে বস্ত্র পোশাক খাত, বেসরকারি সংস্থা, উৎপাদনমুখী শিল্প, তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি, সরকারি চাকরি, শিক্ষা, পাইকারি খুচরা বাণিজ্য, নির্মাণ, আবাসন, আর্থিক খাত, যোগাযোগ, স্বাস্থ্য, হোটেল রেস্টুরেন্ট। এর মধ্যে কর্মসংস্থানের উল্লেখযোগ্য অংশই বেসরকারি সংস্থা, উৎপাদনমুখী শিল্প এবং তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে।

দেশের অন্যতম শীর্ষ জব পোর্টাল বিডিজবসের কাছ থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি এডিবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে অনলাইন জব পোর্টালটির মাধ্যমে মোট ৬৩ হাজার ৮৬টি চাকরির বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে তা আগের মাসের তুলনায় শতাংশ বাড়লেও ফেব্রুয়ারিতে কমে যায় ১৩ শতাংশ। মার্চে আগের মাসের তুলনায় চাকরির বিজ্ঞাপন কমেছে ২৮ শতাংশ। আর এপ্রিলে মার্চের তুলনায় ৮২ শতাংশ কমেছে চাকরির বিজ্ঞাপন।

বিডিজবস ডটকমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা একেএম ফাহিম মাশরুর বণিক বার্তাকে বলেন, তৈরি পোশাক খাতে তিন মাস নতুন কোনো নিয়োগ হয়নি। ব্যাংকগুলোর অবস্থাও সংকটপূর্ণ। ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে লোকবল কমিয়ে আনছে। চাকরির বাজারের পরিস্থিতি ছয় মাস রকমই থাকবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে নতুন লোকবল নিয়োগ হচ্ছে বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলোতে। আর -কমার্স খাতেও নতুন জনবল নেয়া হচ্ছে। আগের চেয়ে কিছুটা উন্নতি হলেও এখনো কর্মসংস্থানের বিজ্ঞাপন ৩০ শতাংশ কম।

দেশে চাকরিদাতা চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে সংযোগ তৈরিতে কাজ করছে বিডিজবস, এনআরবি জবস, কর্ম অলজবসবিডিসহ আরো বেশকিছু প্রতিষ্ঠান। তাদের দেয়া তথ্য বলছে, কভিড সংক্রমণ শনাক্তের পর গত এপ্রিলে চাকরির বিজ্ঞপ্তি স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ৮০ শতাংশ কমে যায়। পরের মাসে তা কিছুটা বাড়লেও অন্য সময়ের তুলনায় ৭০ শতাংশ কম বিজ্ঞপ্তি দেন চাকরিদাতারা। তবে চলতি মাসে নতুন কর্মী চেয়ে বিজ্ঞাপন আগের দুই মাসের চেয়ে বেড়েছে। যদিও অন্যান্য বছরের তুলনায় তা প্রায় অর্ধেক। পাশাপাশি চাকরিতে দক্ষতা বৃদ্ধিসংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণ থেকে আয়ও কমেছে প্রতিষ্ঠানগুলোর। অনলাইনভিত্তিক প্রশিক্ষণেই এখন গুরুত্ব দিচ্ছে তারা।

খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মূলত সেবা খাতের কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে নতুন করে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। নতুন নিয়োগ হচ্ছে উন্নয়ন সংস্থাগুলোতে। উৎপাদনমুখী খাতে নতুন নিয়োগ একেবারেই বন্ধ। কর্মী ছাঁটাই করেছে তৈরি পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো। এমনকি লোকবল কমিয়ে আনার কথা ভাবছে ব্যাংকগুলোও।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বণিক বার্তাকে বলেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে নতুন নিয়োগ হচ্ছে। কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তারা ছাঁটাই করছে। আবার কিছু কারখানা কাজ কম বলেও ছাঁটাই করছে। কিছু কারখানায় কাজের পরিধি বেড়েছে, যেখানে নতুন নিয়োগ হচ্ছে। জুন জুলাই দুই মাসেই কিছু নতুন কর্মী কাজে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কারখানা বন্ধ থাকায় এপ্রিলে গ্রামে চলে যাওয়া শ্রমিকদের একটি অংশ মে মাসে কারখানা সচল হলেও কাজে ফেরেননি। এই ফিরে না আসা কর্মীদের খোঁজ আমরা এখনো জানি না। হয়তো তারা নিজ এলাকায় কোনো কাজে প্রবেশ করেছেন অথবা অন্য কারখানায় কাজে যোগ দিয়েছেন। সামনের দিনগুলোতে কাজের নিশ্চয়তা এখনো পরিষ্কার হয়নি। ফলে সার্বিকভাবে চাকরির বাজার পরিস্থিতি কী হবে সেই লক্ষণ এখনো অনিশ্চিত। চাকরির বাজার যে ক্রমে আরো ভালো হবে তেমনটা স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। বরং কর্মীসংখ্যা কমিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধির দিকেই আমাদের মনোযোগ।

সংক্রমণ ঠেকাতে প্রাথমিকভাবে দেশে দেশে লকডাউন দেয়া হয়। এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে যাওয়ায় আয়ের পথও রুদ্ধ হয় প্রতিষ্ঠানগুলোর। ফলে প্রথমেই পরিচালন ব্যয় কমিয়ে আনার পদক্ষেপ হিসেবে লোকবল কমানোর ঘোষণা দেয় তারা। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই কভিডের প্রভাবে আড়াই কোটির বেশি মানুষ কর্মহীন হয়েছে। আর সারা বিশ্বে প্রায় ২৭ কোটি তরুণ-তরুণী মহামারীতে কর্মহীন হয়ে পড়েছে।

দেশে কভিড-১৯ সংক্রমণ রোধে ২৬ মার্চ শুরু হয় সাধারণ ছুটি। পর্যায়ক্রমে কাজ বন্ধ হয়ে যায় শিল্প-কারখানাগুলোয়। ২৬ এপ্রিল থেকে পর্যায়ক্রমে চালু হলেও কাজের ঘাটতি ভবিষ্যৎ সংকটের অজুহাতে কারখানা লে-অফ রিট্রেঞ্চমেন্ট বা ছাঁটাই শুরু হয়। এখন পর্যন্ত দেশের শিল্প অধ্যুষিত ছয় এলাকা আশুলিয়া, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ খুলনায় চাকরিচ্যুত হয়েছেন ৩০ হাজারের বেশি শ্রমিক।

অন্যতম জব সাইট এনআরবি জবস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম চৌধুরী শামীম বণিক বার্তাকে বলেন, সহসাই চাকরির বাজারের বিদ্যমান পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছে না। ফলে এটি মেনে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে। আর এক্ষেত্রে ছাঁটাই না করে প্রতিষ্ঠানগুলো টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করতে হবে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলছে, নভেল করোনাভাইরাস সংকটে বাংলাদেশের প্রতি ছয়জন যুবকের মধ্যে একজন কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ২৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ যুবক বেকার রয়েছে। ফেব্রুয়ারি থেকেই বেকারত্ব বাড়ছে। মহামারীর প্রভাবে যুবাদের প্রতি ছয়জনে একজন কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। মহামারীতে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তিনভাবে। কর্মহীন হওয়ার পাশাপাশি শিক্ষা প্রশিক্ষণ ব্যাহত হচ্ছে তাদের। এতে চাকরিতে প্রবেশ দক্ষতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটছে।

বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের (বিইএফ) সভাপতি কামরান টি রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, মহামারী করোনাভাইরাসের প্রভাবে দীর্ঘ চার মাস লকডাউন থাকায় চাকরির বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। একই সঙ্গে বিরূপ প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিতে। গত মাস থেকে সীমিত পরিসরে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চালু হয়েছে, ধীরে ধীরে অর্থনীতির চাকা সচল হতে শুরু করেছে। তবে করোনাভাইরাস পুরোপুরিভাবে বিদায় নেয়নি। যে কারণে চাকরির বাজার স্বাভাবিক হতে হয়তো কিছুটা সময় লাগবে। তবে কতদিন সময় লাগবে এটা এখন বলা মুশকিল। এটা নির্ভর করবে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি বিদায় নেয়ার ওপর। নেতিবাচক পরিস্থিতি পরিবর্তনে সরকার এরই মধ্যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা দিয়েছে। এই প্রণোদনা প্যাকেজ যত তাড়াতাড়ি খাতসংশ্লিষ্ট লোকের কাছে পৌঁছবে তত তাড়াতাড়ি পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন