দুর্ঘটনা রোধ

সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় কার্যকর কৌশল ও উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি

সড়ক দুর্ঘটনা একটি গুরুতর জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও দুর্ঘটনায় হতাহতের খবর পাওয়া যায়। তবে ঈদের সময়ে দুর্ঘটনা আকস্মিকভাবে কয়েক গুণ বেড়ে যায়। এবারো এর ব্যতিক্রম নয়। চলমান কভিড-১৯ মহামারীর কারণে সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন চলাচল আগের চেয়ে বেশ কমেছে। এমন এক পরিস্থিতির মধ্যেও কোরবানি ঈদের আগে পরে সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। সর্বশেষ মঙ্গলবার চার জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত আটজনের নিহত হওয়ার খবর মিলেছে। বিষয়টি গভীর শঙ্কার উদ্বেগজনক।

সড়ক-মহাসড়কে বেঘোরে মৃত্যু কারোরই কাম্য নয়। একটি মৃত্যু একটি পরিবারের কাছে সারা জীবনের জন্য গভীর ক্ষতের কারণ হয়ে থাকে। দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে জারি রয়েছে, বেরও হয়েছে অনেক কিছু। তবু বছর বছর দুর্ঘটনা নতুন রূপে হাজির হচ্ছে, এটা অনাকাঙ্ক্ষিত। বিষয়ে দায়িত্বশীলদের দ্রুত সক্রিয়তা জরুরি।

লক্ষণীয়, জাতিসংঘের যেসব সদস্য রাষ্ট্র ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা নামিয়ে আনার অঙ্গীকার করেছিল, তার একটি বাংলাদেশ। অঙ্গীকার পূরণ দূরে থাক, বরং দিন যত যাচ্ছে, দেশে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। তার মানে এটা শুধু ফাঁপা অঙ্গীকার ছিল। দুর্ঘটনা রোধ বা কমিয়ে আনতে সত্যিকার অর্থে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষগুলো আদৌ কোনো কার্যকর পরিকল্পনা কৌশলই গ্রহণ করেনি। এটা জাতি হিসেবে আমাদের দায়িত্বহীনতার আরেকটি বড় প্রমাণ।

আমাদের দেশে কী কী কারণে এত বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, কী কী পদক্ষেপ নিলে দুর্ঘটনার হার কমিয়ে আনা সম্ভবএসব বহুল আলোচিত বিষয়। নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য মোটাদাগে কিছু কারণ বিদ্যমান। সেগুলো হলো, চালকের অসতর্কতা, অসচেতনতা, বেপরোয়া বা অনিয়ন্ত্রিত গতিতে গাড়ি চালানো, ত্রুটিপূর্ণ রাস্তা, ফিটনেসবিহীন-ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন প্রভৃতি।

সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, ভুয়া লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালক বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো বন্ধ করা হলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেক কমতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে ফলপ্রসূ উদ্যোগ নেই। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালকদের বিচার যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করা হয়নি অনেক ক্ষেত্রে। বলতে গেলে, এক্ষেত্রে একটি গভীরতর দায়মুক্তির সংস্কৃতি বিরাজমান। এটি দূর করতে হবে। সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতে সড়ক পরিবহন আইন প্রণীত হয়েছে। এতে দায়ীদের শাস্তি বাড়ানো হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। শাস্তি বাড়ালেই হবে না, যথাযথ বিচারিক প্রক্রিয়ায় তা যেন কার্যকর করা হয়, তাও নিশ্চিত করতে হবে।  

সড়ক দুর্ঘটনার আরেকটি কারণ হলো ত্রুটিপূর্ণ সড়ক ব্যবস্থা। মহাসড়কগুলোয় বাঁক থাকার কারণে সামনের দিক থেকে আসা গাড়ি দেখতে না পেয়ে অনেক চালক দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা দেশের সড়ক ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ব্ল্যাক স্পট চিহ্নিত করেছেন। সেগুলো সংশোধন করতে হবে। এছাড়া রাস্তার পাশে হাটবাজার স্থাপন ওভারব্রিজ না থাকাও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। সঠিক প্রকৌশলগত জ্ঞানের ভিত্তিতে এসব ত্রুটি দূর করা গেলে দুর্ঘটনা অনেকাংশে হ্রাস পাবে বৈকি। সড়ক দুর্ঘটনার আরেকটি বড় কারণ মহাসড়কগুলোয় দ্রুতগতির যানবাহনের পাশাপাশি ধীরগতির যানবাহন চলাচল। গতির তারতম্য থাকায় দ্রুতগতির গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লেগে ধীরগতির বাহন রাস্তা থেকে ছিটকে পড়ে। ধীরগতির যানবাহন মহাসড়কে বন্ধ করতে বিভিন্ন সময়ে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তাতে খুব একটা সুফল মেলেনি। ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে হলে সার্বক্ষণিক তদারকি এবং ব্যবস্থাপনাগত উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। এদিকে ট্রাফিক আইন অমান্য করার কারণেও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। তাই আমাদের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আরো উন্নত আধুনিক করতে হবে। সড়ক-মহাসড়কগুলোকে ডিজিটাল নজরদারির আওতায় নিয়ে আসা এক্ষেত্রে ফলপ্রসূ হতে পারে।

সড়ক ব্যবস্থাপনা কোনো মানবিক বিষয় নয়, এটি বৈজ্ঞানিক বিষয়। বৈজ্ঞানিক সূত্রেই এটি পরিচালিত হয়। বিজ্ঞানের একটি অসাধারণ গুণ হলো, এটি যেকোনো সমস্যার সঠিক বহুমাত্রিক উপসর্গ খুঁজে বের করে। দেশে সড়ক দুর্ঘটনা কেন হয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তার একটি মাত্র উপসর্গের দিকেই আমাদের সাধারণত নজর থাকে। সেটি হলো, দুর্ঘটনার সব দায় কেবল গাড়িচালকের। এক্ষেত্রে দুর্ঘটনার বাকি যেসব নিয়ামক আছে, সেগুলো বেশির ভাগ সময়েই বিবেচনার বাইরে থেকে যায়। এটি মোটেই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নয়। একপাক্ষিকভাবে চালকের ওপর দায় চাপালে সড়ক দুর্ঘটনার অন্য গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলো কখনো দূর হবে না। তাই নিরাপদ সড়কের জন্য সমন্বিত একটি কার্যকর কৌশল প্রণয়নে সংশ্লিষ্ট সবার দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।

প্রতিনিয়ত বেড়ে চলা দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের আর শৈথিল্যের সুযোগ নেই। সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দিয়ে এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের কাজ করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধের উপায় হিসেবে গবেষক বিশেষজ্ঞদের অনেক সুপারিশ-পরামর্শ রয়েছে। সেসব সুপারিশ বিআরটিএ, সড়ক বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর কাছে রয়েছে। এখন প্রয়োজন সেগুলো বাস্তবায়নের সক্রিয় উদ্যোগ নেয়া। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে যথেষ্ট আন্তরিকতা দেখিয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা রোধে কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। সেই নির্দেশনাগুলোর বাস্তবায়ন দেখভাল করার জন্য কয়েকজনকে দায়িত্বও দিয়েছেন বলে খবরে প্রকাশ। এখন সময় নিজেদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের। চালক যানবাহনের লাইসেন্স থেকে শুরু করে সড়ক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় বিরাজমান পদ্ধতিগত ত্রুটি-দুর্বলতাগুলো দূর করা গেলে সড়ক দুর্ঘটনার হার ক্রমে কমিয়ে আনা অসম্ভব নয়। তবে তার জন্য চাই সরকারি কর্তৃপক্ষ, ট্রাফিক পুলিশ, পরিবহন মালিক, শ্রমিক যাত্রীসাধারণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। সবার দায়িত্বশীল ভূমিকায় সড়কে অচিরেই শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে, এটিই প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন