করোনা ও নিরাপত্তাহীনতা

দক্ষিণ আফ্রিকায় দুর্দশায় প্রবাসী বাংলাদেশীরা

আবু তাহের

দক্ষিণ আফ্রিকার ব্লুমফন্টেইন শহরে গত ২৬ জুলাই সন্ত্রাসীদের ছোড়া গুলিতে মারা যান বাংলাদেশী যুবক সজল খান। শহরের একটি দোকানে পণ্য ডেলিভারি দেয়ার সময় সন্ত্রাসীর গুলিতে প্রাণ হারান তিনি। এর আগে গত ২৪ জুলাই জোহানেসবার্গ শহরে ব্যবসায়ী ফরিদের দোকানে আগুন ধরিয়ে দেয় একদল ডাকাত। সেই আগুনে পুড়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনিও।

দেশটিতে বসবাসরত বাংলাদেশীরা জানিয়েছেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় ডাকাত দুর্বৃত্তদের হামলায় বাংলাদেশী প্রবাসীদের আহত নিহত হওয়াটা নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে ধরনের হামলা আরো বেড়ে গিয়েছে। বর্তমানে একদিকে করোনা সংকটের কারণে আর্থিক অনিশ্চয়তা, অন্যদিকে জানমালের নিরাপত্তা দুটো নিয়েই শঙ্কায় আছেন সেখানকার বাংলাদেশীরা।

দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশী কমিউনিটি সংগঠন বাংলাদেশ পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য বলছে, গত দুই মাসে দেশটিতে সন্ত্রাসীরা বেশ কয়েকজন বাংলাদেশীকে অপহরণ করে। এদের মধ্যে কাউকে কাউকে হত্যাও করা হয়। আবার অনেককে মুক্তিপণের মাধ্যমে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। গত চার বছরে দেশটিতে ৪৫২ জন বাংলাদেশী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ২০১৯ সালের প্রথম নয় মাসে ৮২ জন খুন হন।

সন্ত্রাসীদের উৎপাতে বেশ কয়েকটি শহর আতঙ্কের নগরে পরিণত হয়েছে। প্রায় সময় এসব শহরে বাংলাদেশীদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে লুট, চাঁদাবাজি, অপহরণ হত্যার ঘটনা ঘটে। কখন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়, এমন আতঙ্কে থাকেন প্রবাসীরা।

দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশী কমিউনিটি সংগঠন বাংলাদেশ পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আলী হোসেন জানান, লকডাউনের পর এখানকার মানুষের মধ্যে কিছুটা আশা জেগেছিল পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, কিন্তু হলো তার বিপরীত। এমনিতেই এখানে লুণ্ঠন, ডাকাতি নিয়ে বাংলাদেশীরা সবসময় উদ্বেগে থাকেন, তার মধ্যে করোনায় মৃত্যু আতঙ্ক আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

দক্ষিণ আফ্রিকায় কতসংখ্যক বাংলাদেশী বর্তমানে বসবাস করছেন, সে সম্পর্কে সরকারি কোনো তথ্য পাওয়া না গেলেও সেখানকার প্রবাসীদের সংগঠনসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকায় তিন লাখের বেশি বাংলাদেশী বসবাস করছেন। এদের বড় অংশই অবৈধভাবে এবং অনেকেই আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে সেখানে আছেন। ক্ষুদ্র ব্যবসা থেকে শুরু করে নানা ধরনের পেশায় নিয়োজিত এসব বাংলাদেশীর দিন কাটছে এখন চরম অনিশ্চয়তায়। করোনার কারণে তাদের অনেকেরই ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধের উপক্রম।

গত মাস থেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। লকডাউন শিথিল করার পর জুলাই থেকে রেকর্ডসংখ্যক নাগরিক করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। দেশটির নাগরিকদের পাশাপাশি প্রবাসী বাংলাদেশীদের আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যাটাও উদ্বেগজনক। গত দুই মাসে পাঁচ শতাধিক বাংলাদেশী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানান সেখানকার বাংলাদেশীরা। তারা জানান, দেশটির তিনটি বড় শহর জোহানেসবার্গ, কেপটাউন, ব্লুমফন্টেইনে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বাংলাদেশী করোনায় আক্রান্ত। আক্রান্তদের অন্তত ৪০ ভাগ রাজধানী জোহানেসবার্গের। এদের মধ্যে অন্তত ২০ জন মারা গেছেন।

দক্ষিণ আফ্রিকার ব্লুমফন্টেইনে থাকা করোনায় আক্রান্ত বাংলাদেশী শ্রমিক সিদ্দিকুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, গত জুনের শেষে করোনায় আক্রান্ত হই। এরপর আর কর্মস্থলে যেতে পারিনি। বেশ কিছুদিন এভাবে যাওয়ার পর শুনি চাকরি নেই। পরে বন্ধুবান্ধব অন্যদের কাছ থেকে সহযোগিতা নিয়ে বর্তমানে চলছি।

ব্লুমফন্টেইনে বসবাসরত আরেক বাংলাদেশী ব্যবসায়ী আমির হোসেন বলেন, করোনায় দেশটির সরকারের সব চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে। কোনোভাবেই আক্রান্তের সংখ্যা কমানো যাচ্ছে না। তীব্র শীত থাকায় গত সপ্তাহে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছিল। তবে এখন শীতের প্রকোপ কিছুটা কমায় আক্রান্তের সংখ্যাও কিছুটা কমে এসেছে।

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় গত মে মাসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার। এর পর থেকে সেখানকার দোকানপাট, ছোট ছোট বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হন ব্যাপকভাবে। অন্যদিকে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েন হাজার হাজার প্রবাসী কর্মী। দেশটির সরকারের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ বেকার হয়ে পড়েছে, যাদের বড় একটি অংশ বিদেশী নাগরিক।

এদিকে, করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে দেশটির সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। করোনায় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় লুণ্ঠন, হত্যা এমনকি অপহরণের মতো ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। জোহানেসবার্গ, কেপটাউন, প্রিটোরিয়ার মতো বড় বড় শহরে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা চালাচ্ছে সন্ত্রাসীরা। তাদের উৎপাতে আতঙ্কে থাকেন ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশীদের সঙ্গে এমন ঘটনার পরও নির্বিকার সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাস, এমন অভিযোগ প্রবাসীদের।

বিষয়ে জানতে দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাব্বির আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে অনেকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন