কোটি কোটি ভ্যাকসিন উৎপাদন করতে চলেছে সিরাম ইনস্টিটিউট

আদর পুনাওয়ালার সেলফোনটি এখন সারাক্ষণই ব্যস্ত

বণিক বার্তা ডেস্ক

মে মাসের শুরুর দিককার কথা। সিলগালা করা এক ইস্পাতের বাক্স এসে পৌঁছে বিশ্বের বৃহত্তম ভ্যাকসিন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান পুনের সিরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার কোল্ডরুমে। বাক্সের ভেতরে ড্রাই আইসে সংরক্ষণ করা ছিল এক মিলিমিটার ব্যাসের ছোট একটি শিশি। বাক্সটি এসেছে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড থেকে। ভেতরে ছিল নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবেলায় এখন পর্যন্ত বিশ্বে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় হিসেবে বিবেচিত প্রতিষেধকের সেলুলার ম্যাটেরিয়াল।

সাদা ল্যাবকোট পরা বিজ্ঞানীরা শিশিটি নিয়ে গেলেন সিরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার ১৪ নম্বর ভবনে। শিশির ভেতরের জিনিসটুকু একটি ফ্লাস্কে সতর্কতার সঙ্গে ঢেলে নিলেন তারা। এর সঙ্গে ভিটামিন শর্করা যুক্ত করার মাধ্যমে শুরু হলো কোটি কোটি কোষ তৈরির কাজ। এর মধ্য দিয়ে বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যবসায়িক ঝুঁকিটি নিয়ে নিল সিরাম ইনস্টিটিউট, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম যাকে অভিহিত করছে বড় মাপের জুয়া হিসেবে। যদিও ঝুঁকির পেছনে রয়েছে দ্রুত বাজারে ভ্যাকসিন নিয়ে আসার মাধ্যমে পৃথিবীকে কভিড-১৯ দুঃস্বপ্ন থেকে বের করে আনার তাগিদ।

সিরাম ইনস্টিটিউটের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ভারতের অত্যন্ত ধনী এক পরিবার। প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে যা করছে, এখন পর্যন্ত খুব অল্প প্রতিষ্ঠানই ধরনের দুঃসাহস দেখিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে এমন এক ভ্যাকসিনের কোটি কোটি ডোজ উৎপাদন করছে, যা এখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়েই রয়েছে। ফলে এটি পুরোপুরি কাজ করবে কিনা, সে বিষয়ে এখনো মন্তব্য করার সময় আসেনি। 

কিন্তু যদি টিকা পুরোপুরি কার্যকর হয়, সেক্ষেত্রে গোটা পৃথিবীর সামনে পাদপ্রদীপের আলোয় চলে আসবেন সিরাম ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতার একমাত্র সন্তান বর্তমান সিইও আদর পুনাওয়ালা। করোনা দুঃস্বপ্নের মুক্তিদাতা বহুল প্রতীক্ষিত ভ্যাকসিন তার কাছেই থাকবে সবচেয়ে বেশি।

ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের জন্য অক্সফোর্ডের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে সিরাম ইনস্টিটিউট। হাতেগোনা যে কয়টি প্রতিষ্ঠান ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষ হওয়ার আগেই বৃহৎ পরিসরে করোনার টিকা উৎপাদনের ঘোষণা দিয়েছে সিরাম ইনস্টিটিউট তার অন্যতম। আদর পুনাওয়ালার অধীন ভ্যাকসিন অ্যাসেম্বলি লাইন এখন মিনিটে পাঁচ শতাধিক করোনা প্রতিষেধকের ডোজ উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত।

সিরাম ইনস্টিটিউটের মতো আদর পুনাওয়ালার সেলফোনটিও এখন ব্যস্ত সারাক্ষণই। বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীসহ রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত ফোন পাচ্ছেন তিনি। তবে তাদের কারোরই নাম প্রকাশ করতে চাচ্ছেন না আদর পুনাওয়ালা। ভিআইপি ছাড়াও পরিচিত-অপরিচিত মহল থেকেও প্রচুর ফোন আসছে তার কাছে। সবাই চাইছেন প্রথম ব্যাচে উৎপাদিত টিকার ভাগ নিতে। বিষয়ে আদর পুনাওয়ালার মন্তব্য হলো এভাবে যে দেয়া যায় না, সেটা তাদের সবাইকেই আমার বোঝাতে হয়েছে।

গোটা বিশ্বকে স্থবির করে দিয়েছে মহামারী। সব আশা-ভরসার কেন্দ্রে রয়েছে কার্যকর একটি ভ্যাকসিন। এমন পরিস্থিতিতে উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন জনসাধারণের কাছে দ্রুত পৌঁছাতে প্রস্তুতকারীদের প্রয়োজন সিরামের মতো বৃহদায়তনের অ্যাসেম্বলি লাইনসংবলিত একটি প্রতিষ্ঠানের সহায়তা। প্রতি বছর প্রতিষ্ঠানটি অন্যান্য টিকার প্রায় দেড়শ কোটি ডোজ উৎপাদন করে, যা বিশ্বের ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ।

সিরাম ইনস্টিটিউটের উৎপাদিত টিকা নিয়েছে পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক শিশু। প্রতিষ্ঠানটির বিশেষত্বই হলো বৃহৎ পরিসরে উৎপাদনের সক্ষমতা। তবে সিরামের উৎপাদিত টিকার কী পরিমাণ ডোজ ভারত নিজের কাছে রেখে দিতে পারে, সে বিষয়টি এখন পর্যন্ত নিশ্চিত নয়। এছাড়া উৎপাদনে তহবিলের জোগানদাতা কে হবে সেটিও নিশ্চিত নয়। সে হিসেবে বৃহদায়তনে করোনার টিকা উৎপাদন করতে গিয়ে রাজনৈতিক, আর্থিক, আন্তর্জাতিক অভ্যন্তরীণ নানামুখী চাপ মোকাবেলা করতে হতে পারে পুনাওয়ালা পরিবারকে।

ভারত নিজেই এখন করোনার তাণ্ডবে বিধ্বস্ত। করোনার টিকার প্রয়োজনীয়তা ১৩০ কোটি মানুষের দেশটিতে এখন ভালোভাবেই অনুভূত হচ্ছে। এছাড়া দেশটির নেতৃত্বও দিচ্ছেন এমন একজন ব্যক্তি, যিনি অতিমাত্রায় জাতীয়তাবাদী। এরই মধ্যে নরেন্দ্র মোদির সরকার ভারত থেকে করোনা চিকিৎসায় ব্যবহূত সব ধরনের ওষুধের রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে।

বিষয়ে ৩৯ বছর বয়সী আদর পুনাওয়ালা সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমসকে জানান, তার প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত ভ্যাকসিন ভারত অন্যান্য দেশের মধ্যে আধাআধি হিসেবে ভাগ করতে চান। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে তুলনামূলক দরিদ্র দেশগুলো। অন্যদিকে নরেন্দ্র মোদির সরকারের পক্ষ থেকেও এখন পর্যন্ত নিয়ে কোনো আপত্তি জানানো হয়নি।

তার পরও কিছুটা সংশয় রয়েছে আদর পুনাওয়ালার মধ্যেও। তিনি বলেন, এর পরও তারা প্রয়োজন মনে করলে বা চাইলেই একধরনের জরুরি বিধিনিষেধ আরোপ করে দিতে পারে।

অন্যান্য ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সিরাম ইনস্টিটিউটের একটি বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে। ভারতীয় অনেক প্রতিষ্ঠানের মতো এটিও পরিচালিত হয় পারিবারিক ব্যবসা হিসেবে। ফলে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে বড় ধরনের ঝুঁকি নেয়ার বিষয়টি খুব একটা কঠিনও নয়। কারণেই করোনা ভ্যাকসিন উৎপাদনের বিষয়ে এত বড় ঝুঁকি নেয়ার সাহস করতে পেরেছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে ঝুঁকি ভুল প্রমাণিত হলে কোটি কোটি ডলারের সমপরিমাণ সম্পদ হারাতে পারে পুনাওয়ালা পরিবার।

আদর পুনাওয়ালা জানান, সিদ্ধান্তটি গ্রহণের সময়ে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে তিনি ৭০-৮০ শতাংশ নিশ্চিত ছিলেন।

অক্সফোর্ড উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ চালিয়ে দেখা গিয়েছে, এটি গ্রহণকারীর দেহে কভিড-১৯- ভুগে সদ্য সুস্থ হয়ে ওঠা ব্যক্তির দেহের সমপরিমাণে অ্যান্টিবডি সক্রিয় করে তোলে। সে হিসেবে এটি পুনাওয়ালা পরিবারের জন্য অত্যন্ত স্বস্তিদায়ক একটি খবর।

এরই মধ্যে গবেষণা উন্নয়নকাজে ব্যবহারের জন্য কয়েক লাখ ডোজ প্রতিষেধক তৈরি করেছে সিরাম ইনস্টিটিউট। নভেম্বর নাগাদ পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ হওয়ার মধ্যেই বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য ৩০ কোটি ডোজ প্রতিষেধকের মজুদ গড়ে তুলতে চাইছে প্রতিষ্ঠানটি। 

কিন্তু অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রতিষেধকটি যদি রেসে জিততে ব্যর্থও হয়, তার পরও মহামারী মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে সিরাম ইনস্টিটিউট। প্রতিষ্ঠানটি অন্য কয়েকটি ভ্যাকসিন উদ্ভাবনকারী সংস্থার সঙ্গেও নিয়ে জোটবদ্ধ হয়েছে। সেক্ষেত্রে করোনার আরো চারটি প্রতিষেধক উৎপাদনের সুযোগ পাচ্ছে সিরাম। যদিও এর কোনোটিরই এখন পর্যন্ত বৃহদায়তনে উৎপাদন শুরু হয়নি। এবং এর সবকটিই ব্যর্থ হলেও অন্য কোনো উদ্ভাবকের কার্যকর ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য নিজেদের দ্রুত গুছিয়ে নেয়ার বিষয়ে আশাবাদী আদর পুনাওয়ালা। তিনি বলেন, আমরা যে গতি বা আয়তনে অথবা যত স্বল্প ব্যয়ে উৎপাদন করতে পারব, সে সক্ষমতা খুব কম প্রতিষ্ঠানেরই আছে। মহামারী শেষেও প্রতিষেধক মুনাফাতেই বিক্রি করা যাবে বলে আশাবাদী আদর পুনাওয়ালা। তবে মুহূর্তে তার সবচেয়ে বড় বিবেচ্য বিষয় হলো স্বল্পমেয়াদে প্রতিষ্ঠানের তারল্যপ্রবাহ বজায় রাখা। তার হিসাব অনুযায়ী, বৃহৎ পরিসরে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য তাকে ব্যয় করতে হচ্ছে ৪৫ কোটি ডলার।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন