সিমেন্ট খাতে নগদ অর্থপ্রবাহ সংকট

কারখানা সচল রাখতে অর্থ মন্ত্রণালয়ে ৩ প্রস্তাব উদ্যোক্তাদের

রাশেদ এইচ চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরো

কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে পুঞ্জীভূত লোকসানের কারণে নগদ অর্থপ্রবাহ সংকট তৈরি হয়েছে সিমেন্ট খাতে। এতে নির্মাণ উপকরণটির উৎপাদন খরচ, কর্মীদের বেতন, ব্যাংকের রি-পেমেন্ট দিতে ত্রাহিদশা অবস্থা। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে অর্থ মন্ত্রণালয়ে তিনটি প্রস্তাব দেয়া হয়েছে খাতের উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে দেয়া চিঠিতে সিমেন্ট শিল্পের জন্য সব ধরনের মেয়াদি ঋণ/লিজ লোন ১২ বছরের জন্য স্বাভাবিক নিয়মে মাসিক কিস্তিভিত্তিক পরিশোধের সুযোগ চেয়েছেন উদ্যোক্তারা। এছাড়া চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সব ধরনের মেয়াদি ঋণ/লিজ লোনের জন্য গ্রেস পিরিয়ডের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। ব্যাংকঋণের ওপর শতাংশ সুদ নির্ধারণ করার পর ব্যাংকগুলো যাতে ঋণ নবায়ন ফি, এলসি কমিশন নিশ্চিতকরণ চার্জ বৃদ্ধি না করে সে ব্যাপারেও নিশ্চয়তা চেয়েছেন তারা।

বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমএ) সভাপতি মো. আলমগীর কবির প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তাতে সিমেন্ট শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে অর্থ মন্ত্রণালয়ে অত্যন্ত বাস্তবমুখী প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। করোনার সময়কালে জুলাইয়ে এখনো স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ৫০ শতাংশ বিক্রি কম হচ্ছে। বিক্রি কমে ক্যাশ ফ্লো অনেক কমে গেছে সিমেন্ট খাতের ব্যবসা পরিচালনায়। কাস্টমস এআইটি কেটে রাখার কারণে নগদ অর্থ সংকট আরো প্রকট হয়েছে। এখন দীর্ঘমেয়াদি ঋণগুলোর ক্ষেত্রে আমাদের সময় বাড়িয়ে দিলে ক্ল্যাসিফায়েড হওয়ার ঝুঁকি থাকবে না। এতে প্রতি মাসে কর্মীদের বেতন চালিয়ে নেয়াসহ দৈনন্দিন কাজ পরিচালনা সম্ভব হবে। প্রক্রিয়ায় ব্যাংকেরও কোনো ক্ষতি হবে না। ব্যাংক একটি বড় সময়ে ইন্টারেস্ট পেতে থাকবে। অন্যথায় একটা সময় গিয়ে কেউ ক্ল্যাসিফায়েড হয়ে গেলে ব্যাংক যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমনি শিল্পও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমনটা হলে কর্মসংস্থানের ওপর এটা সরাসরি আঘাত আসবে। এর থেকে বাঁচতেই প্রস্তাবটি দেয়া হয়েছে। আমরা আশা করছি প্রস্তাবগুলো বিবেচনায় নিয়ে দেশের উদীয়মান সিমেন্ট শিল্পকে অপ্রত্যাশিত আর্থিক দুরবস্থা থেকে রক্ষা করতে পদক্ষেপ নেয়া হবে।

সিমেন্ট প্রস্তুতকারক উদ্যোক্তারা জানান, করোনার প্রভাবে দেশের যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম সিমেন্ট শিল্প। খাতটি ভলিউমেট্রিক অর্থাৎ বিক্রয় অধিক কিন্তু মুনাফার স্বল্প। ফলে ধরনের শিল্প স্বল্প সময়ের জন্য বন্ধ হলেই বড় অংকের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। গত তিন মাসে সিমেন্ট শিল্পের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ হাজার কোটি টাকা। বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে ডিসেম্বর পর্যন্ত আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে দেয়া চিঠিতে উদ্যোক্তারা দাবি করেছেন। এছাড়াও শতভাগ কাঁচামাল আমদানিনির্ভর শিল্পের বিশ্বব্যাপী কাঁচামাল সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে কমপক্ষে দেড় থেকে দুই বছর সময় লেগে যাবে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

দেশের শীর্ষস্থানীয় সিমেন্ট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান প্রিমিয়ার সিমেন্ট মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশের সিমেন্ট খাত এখন একটি গভীর সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। দেশের নির্মাণ শিল্পের জন্য সিমেন্ট ইস্পাত হলো বেসিক ইন্ডাস্ট্রি। সরকারও উন্নয়নের ধারাটিকে ধরে রাখতে চাইছে। সরকারের সীমাবদ্ধতার বিষয় বিবেচনায় রেখে আমাদের শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য সরাসরি কোনো আর্থিক প্রণোদনা চাওয়া হয়নি। মন্দার সময় যেসব দেশ সক্ষমতা ধরে রাখতে কিংবা বাড়াতে মনোযোগী থাকে, দীর্ঘমেয়াদে তারাই ভালো করে। অর্থনীতির চাকা না ঘোরালে কোথায় স্থবিরতা চলে আসবে এটা কেউ বলতে পারবে না। অনেক ব্যাংক এখনো ১১ থেকে ১২ শতাংশ সুদ কার্যকর রেখেছে। এতে কেউ লাভবান হবে না। সময়ের ধারাবাহিকতায় দেশে ভারী শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে। দেশের নির্মাণ খাত স্থবির হয়ে পড়লে পিছিয়ে যেতে বেশি সময় লাগবে না। আমরা গত ১০ বছরে যতটা এগিয়ে এসেছি, এটাকে যে কোনো মূল্যে ধরে রাখতে হবে।

সিমেন্ট খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ সিমেন্ট প্রস্তুতকারক সমিতির (বিসিএমএ) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে উৎপাদনে রয়েছে দেশী-বিদেশী ৩৪টি সিমেন্ট কোম্পানি। এর মধ্যে ২৯টিই স্থানীয় উদ্যোক্তাদের। দেশে সিমেন্টের বার্ষিক চাহিদা প্রায় সাড়ে তিন কোটি টন। যদিও উৎপাদন ক্ষমতা তারও দ্বিগুণ অর্থাৎ প্রায় সাড়ে সাত কোটি টন। খাতে বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। স্বয়ংসম্পূর্ণ খাত দেশের চাহিদা মিটিয়ে কিছু অংশ ভারতেও রফতানি করছে, যার মূল্য বছরে প্রায় কোটি ডলার। ৩৪টি কারখানার খাতে সরাসরি প্রচ্ছন্নভাবে প্রায় দুই লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে।

কনফিডেন্স সিমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহির উদ্দিন আহমদ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সিমেন্ট খাতের ব্যবসা এমনিতে অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। চাহিদার তুলনায় দ্বিগুণ উৎপাদন সক্ষমতা থাকায় প্রতিযোগিতা অনেক বেশি হচ্ছে। করোনায় সিমেন্ট খাতকে অরো কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে হলে আমাদের নির্মাণ খাতকে উজ্জীবিত করতে হবে। উন্নয়ন কার্যক্রমের অন্যতম প্রধান উপকরণ সিমেন্ট। খাতটির সঙ্গে নগরায়ণ, গ্রামীণ অর্থনীতি, নির্মাণ খাতকে উজ্জীবিত করার বিষয়গুলো জড়িত। তাই খাতটির সংকটময় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে উদ্যোক্তাদের প্রস্তাব আশা করছি বিবেচনায় নেয়া হবে।

বাংলাদেশ সিমেন্ট প্রস্তুতকারক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, সরকারের বড় উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর পাশাপাশি দেশজুড়ে সব ধরনের নির্মাণকাজ বাড়ায় চাহিদা বাড়ছিল সিমেন্টের। ২০১৯ সালে সিমেন্টের বিক্রি বাড়ে দশমিক ৩৭ শতাংশ। সময়ে কোটি ৩৬ লাখ টন সিমেন্ট উৎপাদন করেছে সিমেন্ট প্রস্তুতকারকরা। এর মধ্যে প্রিমিয়ার, ক্রাউন, কনফিডেন্স সিমেন্ট, মেট্রোসেম, কিং ব্র্যান্ড, বসুন্ধরা, শাহ, ডায়মন্ড, ফ্রেশ, আকিজ, আনোয়ার, মীর সিমেন্ট প্রভৃতি ব্র্যান্ড উল্লেখযোগ্য। দেশে করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে ২৬ মার্চ থেকে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। সময় দেশজুড়ে জরুরি কিছু পণ্য সেবা খাতসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ছাড়া প্রায় সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। ফলে এপ্রিল, মে, জুন ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য কঠিন সময় অতিবাহিত করে। এর প্রভাব পড়েছে প্রতিষ্ঠানগুলোর আয়ে। করোনায় বিক্রি কমে যাওয়ার কারণে উৎপাদনও নামিয়ে আনেন সিমেন্ট খাতের উদ্যোক্তারা। তবে জুন থেকে সীমিত আকারে খুলতে শুরুর পর সিমেন্ট খাতের বিক্রি কিছুটা বেড়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন