চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে চীনের ভ্যাকসিন

বণিক বার্তা ডেস্ক

চীনা কোম্পানিগুলো করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের বৈশ্বিক প্রচেষ্টায় বেশ দারুণভাবে এগিয়ে আছে। অর্ধডজনের বেশি কোম্পানি এখন ক্লিনিক্যাল ডেভেলপমেন্টের কাজ করছে। গত সপ্তাহে তিয়ানজিনভিত্তিক ক্যানসিনো বায়োলজিস প্রাথমিক পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফল প্রকাশ করেছে, যা দেখিয়েছে ভ্যাকসিনটি নিরাপদ এবং ইমিউন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে সক্ষম। যদিও তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালে যাওয়ার প্রচেষ্টায় ভ্যাকসিন কোম্পানিগুলো জটিলতার মুখোমুখি হয়েছে। এই ধাপটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে কার্যকারিতা প্রমাণ নিয়ন্ত্রকদের কাছ থেকে অনুমোদন প্রয়োজন। এই ট্রায়ালে সাধারণত হাজার হাজার অংশগ্রহণকারী প্রয়োজন এবং চীন বৃহত্ভাবে প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসায় কোম্পানিগুলোকে তাদের ভ্যাকসিন অন্য কোথাও পরীক্ষা করে দেখতে হবে। কিন্তু গবেষকরা বলছেন, তারা অনেক বেশি অংশগ্রহণকারীকে তালিকাভুক্ত করতে এবং যথেষ্ট পরিমাণ হেলথকেয়ার কর্মীকে ডাটা সংগ্রহের জন্য নিয়োগ দিতে সংগ্রাম করছে।

সিউলের ইন্টারন্যাশনাল ভ্যাকসিন ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক জেরোমে কিম বলেন, চীনা কোম্পানিগুলোর উচিত চীনের বাইরে পদক্ষেপ নেয়া। প্রতিযোগিতা তুঙ্গে। বিষয়টি নির্ভর করছে কে দ্রুত উচ্চঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় যেতে পারে তার ওপর।

চীনা ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারকরা আরো একটি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করবে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, দেশের অস্বচ্ছ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অতীতের ভ্যাকসিন কেলেঙ্কারির কারণে, ভ্যাকসিন খুব সম্ভবত বাড়তি নজরদারিতে পড়বে। ২০১৮ সালে কয়েক হাজার শিশুকে ডিপথেরিয়া, টিটেনাস হুপিং কাশির ত্রুটিপূর্ণ ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছিল বলে জানা গেছে।

দ্রুত ব্যবস্থা

যেখানে সবার আগে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে, সেই চীন সবার আগের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের লক্ষ্যে কাজ করছে। ক্যানসিনোর প্রস্তাবিত ভ্যাকসিনটি সাধারণ সর্দিজ্বরের ভাইরাস থেকে বানানো হয়েছে, যা করোনাভাইরাসকে অনুকরণ করে কাজ করবে। সিনোফার্ম নামে বেইজিংয়ের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি দুটি ভ্যাকসিনের বিকাশ করছে করোনাভাইরাসের নিষ্ক্রিয় অংশ ব্যবহার করে, ফলে তারা আর রোগের কারণ হতে পারে না। কোম্পানিটি জুনে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, উভয় ভ্যাকসিনই অংশগ্রহণকারীদের মাঝে প্রথম দ্বিতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে অ্যান্টিবডি উৎপাদন করেছে। একইভাবে বেইজিংভিত্তিক কোম্পানি সিনোভ্যাকও ইতিবাক ফল পাওয়ার কথা জানিয়েছে।

মাসে সিনোভ্যাক তাদের ভ্যাকসিনের তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল শুরু করেছে ব্রাজিলে। সিনোফার্ম তাদের ভ্যাকসিনের ট্রায়াল শুরু করবে সংযুক্ত আরব আমিরাতে। কেবল অন্য তিনটি করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে প্রবেশ করেছে: কেমব্রিজের বায়োটেক কোম্পানি মডার্না, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি এবং ওষুধ প্রস্তুতকারক আস্ট্রাজেনেকার একটি ভ্যাকসিন এবং অন্যটি মেইঞ্জের বায়োটেক কোম্পানি বায়োনটেকের। ক্যানসিনোও তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের কাজ শুরুর প্রস্তুতি নিয়েছে। চীনা সরকার এরই মধ্যে বলেছে যে এই ভ্যাকসিন দেশটির সামরিক বাহিনী ব্যবহার করতে পারে।

যে গতিতে চীনা ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারকরা এগিয়ে যাচ্ছে তা বিশ্বব্যাপী আশাবাদ তৈরি করেছে। সিনোফার্ম প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিতরণের জন্য তাদের ভ্যাকসিন বছরের শেষ নাগাদ তৈরি থাকবে।

ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষেত্রে বিস্তৃতভাবে ইনঅ্যাকটিভ ব্যবহার করা হয়। তাই চীনা কোম্পানিগুলো কেন এর ওপর মনোযোগ দেয় তা বোঝা যায়। পল বলেন, ভ্যাকসিনের প্রথম লাইন হিসেবে এটি ইমিউজেনিক, দ্রুত বিকাশমান সাশ্রয়ী। কিন্তু কিছু ভাইরাস আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে যখন তারা ইনঅ্যাক্টিভেটেড ভ্যাকসিন দ্বারা আগে চিকিৎসা দেয়া জীবকে সংক্রমিত করে।

অপেক্ষমাণ বাধা

কোনো কোনো পর্যবেক্ষক প্রশ্ন তুলে বলেছেন, কোম্পানিগুলো কী প্রতিশ্রুতিশীল গতিতে এবং ধরনের পরীক্ষায় যে নির্ভুলতা প্রয়োজন সে অনুযায়ী কাজ করতে সক্ষম হবে? ব্যাপার হচ্ছে তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালের আগে সেনাবাহিনীতে ক্যানসিনো ভ্যাকসিন অনুমোদনের ব্যাপারে চীনের আগ্রহ অনেককে বিস্মিত করেছে। ভ্যাকসিন গবেষক মারি-পল কেইনি বলেন, সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক, বৈজ্ঞানিক না। এটি ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার কোনো কিছুই প্রদর্শন করে না।

তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল বিশ্বব্যাপী ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারকদের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। যেমন তাদের যথেষ্ট পরিমাণ অংশগ্রহণকারী এবং দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী প্রয়োজন। বিজ্ঞানীরা বলেন, এই ভ্যাকসিন ইমিউন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং মানুষকে ভাইরাস থেকে বাঁচাতে পারে, ২০ থেকে ৪০ হাজার মানুষের কাছ থেকে এমন ডাটা প্রয়োজন। যাদের কয়েক মাস এমনকি বছরব্যাপী পর্যবেক্ষণ করা হবে।

সংখ্যা পেতে যা প্রয়োজন তা হলো এই ট্রায়ালগুলো অনেকগুলো হাসপাতালে হতে হবে। প্রতিটি হাসপাতাল কয়েকশ রোগীর ডাটা সরবরাহ করবে। কিম বলেন, এসব কাজ করতে হবে এবং সঠিকভাবে করতে হবে। তবে যেসব সাইট এটা করতে পারে তা সীমিত। এমনকি সেরা সাইটটিকেও অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে।

তিনি আরো বলেন, অনেক চীনা কোম্পানিকে অসুবিধায় পড়তে হবে কারণ বিশ্বব্যাপী তাদের হাসপাতালগুলোর প্রতিষ্ঠিত নেটওয়ার্ক নেই। এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গত সপ্তাহে ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, তিনি যেকোনো কোম্পানির সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী যারা কিনা কার্যকর ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে পারে। তবে চীনা কোম্পানিগুলো এর আগে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অপারেশন ওয়ার্প স্পিড থেকে অর্থ নেয়ার বিষয়টি বাতিল করে দিয়েছে। এছাড়া ২১ জুলাই ইউএস-চীন সহযোগিতার সম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যখন ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস অভিযোগ এনে বলে যে দুজন চীনা হ্যাকার যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানির কভিড-১৯-এর ভ্যাকসিনের ডিজাইন চুরির চেষ্টা করেছে।

এদিকে কেইনি ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন যে সিনোফার্ম তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালের জন্য ইউএই সরকার, হেলথকেয়ার লোকাল আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কোম্পানির সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। অন্যদিকে সিনোভ্যাক যুক্ত হয়েছে ব্রাজিলের সাও পাওলোর বুটানটান ইনস্টিটিউটের সঙ্গে। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত চীনা কোম্পানিগুলো অংশীদার পেতে সফল হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে।

ডাটা পর্যাপ্ত?

কিন্তু অনেক গবেষক প্রশ্ন তুলে বলেছেন, আরব আমিরাত ব্রাজিল কি যথেষ্ট পরিমাণ ডাটা জড়ো করতে পারবে, যা রেগুলেটরি এজেন্সিগুলোকে ভ্যাকসিনের কাজ সম্পর্কে সন্তুষ্ট করবে। আরব আমিরাত, যেখানে সিনোফার্ম ১৫ হাজার অংশগ্রহণকারীর মাঝে দুটি ভ্যাকসিনের ট্রায়াল করার কথা ভাবছে, সেখানে খুব অল্প লোকই কভিড-১৯- আক্রান্ত হয়েছে।

তাই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে ট্রায়ালের যে ডাটা সংগ্রহ করা হবে তা যেন ড্রাগ রেগুলেটর এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে। কিম বলেন, যদি আপনি তা করতে না পারেন, তবে আপনি বিপদে পড়বেন।

নেচার ম্যাগাজিন

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন