পুলিশ যখন সরকারের, পুলিশ যখন জনগণের

সামজীর আহমেদ

সরকারের অংশ হিসেবে পুলিশের প্রধানতম কাজ হচ্ছে জনগণের নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করা এবং সেই সঙ্গে সরকারের চলমানতায় সৃষ্টি হওয়া আইনসংক্রান্ত ব্যাঘাত নিরসনে সাহায্য করা। এই দুটো বিষয় আবার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আলাদা হতে পারে না। কারণ গণতন্ত্রে জনগণের ইচ্ছা ও রুচিতে সরকার গঠিত হয় এবং সেই সরকার মূলত ওই জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু দুর্বল গণতান্ত্রিক ও শক্তিশালী আমলাতান্ত্রিক কাঠামোয় সরকার ও জনগণের সম্পর্ক সহজেই বিভাজিত হয়ে পড়ে এবং বর্তমান শিরোনামে কোনো লেখা সম্ভবপর হয়ে ওঠে। এই লেখায় আমি মূলত খুব সাধারণ তিনটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে মনোযোগী হব। 

১. সরকার ও জনগণ কোথায় বিভাজিত হয়ে পড়ে?

২. ঔপনিবেশিকতা ও গণতন্ত্রের সম্পর্ক কেমন?

৩. এই বিভাজন রেখায় পুলিশ কী ভূমিকা পালন করে?

সরকার ও জনগণ কোথায় বিভাজিত হয়ে পড়ে, তা বলা এক অর্থে খুব সোজা। গণতন্ত্র ব্যতীত সব শাসন ব্যবস্থায়ই সরকার ও জনগণ আসলে বিভাজিত থাকে। অর্থাৎ পারস্পরিক দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতার সম্পর্ক সেখানে থাকে না। গণতন্ত্রে শাসক হয়ে ওঠে শাসিতের প্রতিনিধি। অর্থাৎ এটা মূলত স্বশাসন। এই স্বশাসন বা গণতন্ত্রে উত্তরণের সঙ্গে সঙ্গে সরকার ও জনগণের বিভাজন ঘুচে যাওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের চারপাশ এটা বারবার মনে করিয়ে দেয় যে এই বিভাজন কখনই ঘোচেনি। সর্বশেষ এই মহামারীর কালে আমরা দেখলাম সরকারি চাকরি যাওয়া কঠিন আর বেসরকারি চাকরি রক্ষা করা কঠিন। প্রশ্ন হলো, এই দুই ধরনের ব্যবস্থা থাকে কেন? যদি চাকরির নিরাপত্তা একটা ভালো ও জরুরি বিষয় হয়, তাহলে তা বেসরকারি খাতে থাকবে না কেন? আর কাজে গাফিলতির কারণে বা প্রতিষ্ঠানের উন্নতির স্বার্থে যদি চাকরির নিরাপত্তার বদলে ‘অনিরাপত্তা ও সবসময় টিকে থাকার লড়াই’ উপকারী হয়, তাহলে এই ধারণা সরকারি খাতে প্রয়োগ হয় না কেন? এর সঠিক উত্তর যদি আমরা না-ও জানি, তবু এটুকু চোখে পড়তে বাধ্য যে সরকারি ও বেসরকারি বলে সম্পূর্ণ আলাদা ধারণার দুটি খাত এখানে চলমান। অর্থাৎ একটা বিভাজন রেখা এখানে উপস্থিত। 

সরকার ও জনগণের বিভাজন সবচেয়ে স্পষ্ট হয় যখন কেবল ভোটে অংশগ্রহণ (দুর্বল গণতন্ত্রে সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ) ব্যতীত সরকার ব্যবস্থায় জনগণের কোনো প্রকার অংশগ্রহণ থাকে না এবং সরকার ব্যবস্থা কেবল আমলাতান্ত্রিক কাঠামোতেই আবদ্ধ হয়ে পড়ে। করোনাকালীন বাংলাদেশে এ অবস্থা খুবই চোখে পড়ার মতো, যা ‘করোনার আয়নায় আমলাতান্ত্রিক সরকার, জনগণ ও বিশ্ববিদ্যালয়’ শিরোনামে আমার অন্য একটি লেখায় আরেকটু বিশদভাবে আলাপ করেছি। এখন প্রশ্ন হলো, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মোড়কেও কীভাবে সরকার ও জনগণ বিভাজিত হয়ে পড়ে? এর কারণ দুই রকমের, ইতিহাসের অভিশাপ মুছতে না পারার দায় ও বর্তমান প্রসঙ্গ উদ্ভূত কিছু কারণ। আমি আলাপ করব ইতিহাসের অভিশাপ মুছতে না পারার দায় নিয়ে। ইতিহাসের দায় মূলত ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা ও মানসিকতা থেকে পুরো বের হয়ে আসতে না পারার দায়। ঔপনিবেশিক শাসকের জন্য উপনিবেশিত জনগণ সবসময়ই ‘অপর’। জনগণ ও শাসকের ঔপনিবেশিক বিভাজন রেখায় দাঁড়িয়েই ভারতে পুলিশের জন্ম। জনগণের দেখভালের উদ্দেশ্যে নয়। ভারতে পুলিশ সৃষ্টি হয়েছে পুঁজির প্রবাহ নির্বিঘ্ন রাখতে এবং জনগণকে দমিয়ে রাখতে। ভারতে আধুনিক পুলিশি ব্যবস্থা শুরুর জন্য ব্রিটেনের হাতে পুলিশিংয়ের দুটি মডেল উপস্থিত ছিল। একটি হচ্ছে ১৮২৯ সালে প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন পুলিশের মডেল, অন্যটি হলো উপনিবেশিত আয়ারল্যান্ডে ১৮২২ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘রয়্যাল আইরিশ কনসটাবুলারি’ (সংক্ষেপে আইআরসি) মডেল। এই দুই মডেলের পার্থক্য হলো, প্রথমটি অনেকখানি সিভিক চরিত্রের, দ্বিতীয়টি মূলত বিদ্রোহ, প্রতিবাদ ও দাঙ্গা দমনের উপযোগী প্যারামিলিটারি চরিত্রের। ভারতে ব্রিটিশ শাসনে কেন্দ্রীয় পুলিশের জন্ম সিপাহি বিদ্রোহের ঠিক পরপর এবং এখানে উপনিবেশের চরিত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই আরআইসির মডেলেই পুলিশের সৃষ্টি, যা মূলত ছিল একটি প্যারামিলিটারি বাহিনী। ব্রিটিশ সিভিক পুলিশের মডেল না নিয়ে উপনিবেশগুলোয় আইরিশ প্যারামিলিটারি মডেল নেয়ার কয়েকটি কারণ আছে। এর একটি হলো ব্রিটিশ মেট্রোপলিটন পুলিশের কাঠামো নিজ জনগণের জন্য তৈরি আর আইরিশ কাঠামো বিদ্রোহপ্রবণ, সন্দেহজনক, অবিশ্বাসী ‘অপর’ জনগণের জন্য তৈরি। ফলে ভারতসহ অন্যান্য উপনিবেশে এ মডেলই অনুসরণ করা হয়েছে। ভারতীয় পুলিশের প্যারামিলিটারি আদর্শ সৃষ্টির আরেকটি কারণ হলো ঔপনিবেশিক সরকারের শাসনকাজে মূলত প্রয়োজন হয় মিলিটারি। কারণ এই শাসন প্রধানত দখল ও জোরজবরদস্তিমূলক। কিন্তু মিলিটারি কোনো এলাকায় সার্বক্ষণিক মজুদ রাখলে বড় কোনো বিদ্রোহ বা সম্যসায় জরুরি সাহায্যকারী ফোর্সের অভাব দেখা দিত। এসব সমস্যার সমাধান ছিল পুলিশকেই যথাসম্ভব মিলিটারি চেহারা দেয়া। তাতে যেমন খরচও কমানো সম্ভব ছিল, তেমনি বড় আকার ধারণ করার আগেই বিদ্রোহও দমন করা যেত। উপনিবেশিত অঞ্চলকে যেহেতু উপনিবেশক জোরপূর্বক দখল করে, তাই বিদ্রোহের ভয় তার পিছু ছাড়ে না এবং তার চেষ্টা থাকে ওই জোরপূর্বক শাসন অব্যাহত রাখার। এ কারণে উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের গোড়ায় যখন ভারতীয় জাতীয়তাবাদ দানা বাঁধছে, তখন এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ঠেকাতে কলকাতায় কলকাতা স্পেশাল ব্রাঞ্চের পত্তন হয়। আর এটি সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য ১৯০১ সালে ভারতীয় পুলিশে যোগ দেন স্যার চার্লস টেগার্ট নামের একজন আইরিশ পুলিশ। এই টেগার্ট জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও বিদ্রোহ দমনকেন্দ্রিক গোয়েন্দাগিরি ও নজরদারিতে সুপ্রসিদ্ধ। কলকাতায় তিনি এত সাফল্য পেয়েছিলেন যে পুলিশ উপদেষ্টা হিসেবে পরবর্তী সময়ে তাকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আরেক অগ্নিক্ষেত্র ফিলিস্তিনে পাঠানো হয়।

ব্যাংকোল এ কোল জানাচ্ছেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যজুড়ে গোয়েন্দা নজরদারির প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিল ট্রেড ইউনিয়নিস্টরা, টেররিস্ট ও মিলিট্যান্টগোষ্ঠী, কমিউনিস্ট ও শিক্ষার্থীরা। ঔপনিবেশিক বাংলায় পুলিশ ও জনগণের সম্পর্ক কেমন ছিল, সে বিষয়ে পিটার রব বলেন, ‘State controls to protect the public were in concept and practice almost inextricable from coercion to preserve colonial rule.’

প্রায় একই রকম কথা বলেছেন ডেভিড কিলিনগ্রে। তার ভাষ্যমতে, উপনিবেশের পুরো সময়ে পুলিশিং ছিল জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়া একটা বিষয় এবং কখনই এই পুলিশিংয়ের সঙ্গে জনগণের সম্মতি অর্জনের কোনো প্রশ্ন ছিল না। এই পুলিশিং সম্পর্কে আরেক ধাপ এগিয়ে তার বক্তব্য, ‘Colonial Policing had little to do with serving the community and everything to do with upholding the authority of the colonial state.’ এখন প্রশ্ন হলো, ঔপনিবেশিক পুলিশের এ সংস্কৃতি উপনিবেশোত্তর সদ্য স্বাধীন দেশগুলোয় কতখানি বদলে ছিল? দুনিয়াব্যাপী এসব উপনিবেশিত দেশ স্বাধীন হয়েছিল একটা ব্যাপক আন্দোলন ও তত্পরবর্তী চরম বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্য দিয়ে। ফলে বেশির ভাগ দেশের নেতাই শেষ পর্যন্ত ঔপনিবেশিক কাঠামোর ওপর ভরসা রেখেই নতুন দেশের ব্যবস্থা সাজাতে চেয়েছেন। উপনিবেশ থেকে স্বাধীন হওয়া দেশের নেতাদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কাঠামো ঢেলে সাজানোর ব্যাপারে মনোভঙ্গি কেমন ছিল, তার একটি চমত্কার উদাহরণ হচ্ছে ঔপনিবেশিক পুলিশ কাঠামো বদলে ফেলার প্রশ্নে জওহরলাল নেহরুর উত্তর। তিনি বলেন, ‘First things, must come first and the first thing is the security and stability of India.’ অর্থাৎ ঔপনিবেশিক পুলিশ কাঠামোর পরিবর্তন নিয়ে আসা নেহরুর কাছে খুব বেশি গুরুত্ব পায়নি। গুরুত্ব পায়নি অন্য প্রায় সব উপনিবেশোত্তর দেশেও। তাই পুলিশের আইরিশ প্যারামিলিটারি মডেলই পৃথিবীব্যাপী পুলিশের প্রায় সাধারণ সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। 

পাকিস্তান আমলে ঔপনিবেশিক পুলিশ কাঠামোর কোনো কিছুই পরিবর্তিত হয়নি। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ পুলিশে নিয়োগ পদ্ধতি, কিছু কর্ম পদ্ধতি, পুলিশের পোশাকে ও অন্য কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন হলেও মূল ঔপনিবেশিক কাঠামো বা মনোভঙ্গির কতখানি পরিবর্তন হয়েছে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। আমি দু-একটি ঘটনা বিশ্লেষণ ও তুলনার মাধ্যমে বিষয়টি স্পষ্ট করার চেষ্টা করব। 

কোল জানাচ্ছেন, ব্রিটিশ উপনিবেশে একটি সাধারণ ঘটনা ছিল পুলিশ পরিচয়ে ছিনতাই, ডাকাতি বা প্রতারণার মামলা। বাংলাদেশে এমন ঘটনার নজির প্রচুর। সর্বশেষ ১৭ জুলাই ডিবিসি নিউজের প্রতিবেদন—ডিবি পরিচয়ে ২৫ লাখ টাকা ছিনতাই ও ব্যক্তিকে অপহরণের ঘটনা ঘটে। ‘পুলিশ পরিচয়ে অপরাধ’ খুবই বিশেষ ধরনের অপরাধ। এটা পুলিশিংয়ের ইনডিকেটর হিসেবে কাজ করে। পুলিশ যখন প্রশ্নাতীত ক্ষমতা অর্জন করে এবং জনগণের সঙ্গে অর্থপূর্ণ সংলাপের কোনো ব্যবস্থা থাকে না, তখনই এ ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়। কোনো যথোপযুক্ত কারণ ছাড়াই যদি আসল পুলিশ জোর করে তুলে নিয়ে যেতে পারে, তবে নকল পুলিশও এই সুযোগ নিয়ে অপহরণ করতে পারে। পুলিশের গোয়েন্দা নজরদারি মূলত সরকারকেন্দ্রিক। অন্তত যতখানি দৃশ্যমান। শুধু করোনার সময়টাকে আমলে নিলেই তা বোঝা যাবে। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহম্মদ নাসিমের মৃত্যুতে কটূক্তি করায় গ্রেফতার হন বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষক। এ সময়ে আরো কয়েকজন লেখক অ্যাক্টিভিস্ট ও কার্টুনিস্ট গ্রেফতার হয়েছেন শুধু অনলাইনে কিছু লেখা বা প্রকাশের কারণে। কিন্তু এই সময়কালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আনসারীর জানাজায় বিপুল লোক সমাগমের ডাকও আসে অনলাইনে। তারও আগে ৫ এপ্রিল গার্মেন্ট খুলবে এমন সংবাদে ৪ এপ্রিল শ্রমিকদের ঢল নামে রাস্তায়। দুটো ঘটনারই পূর্বানুমান ছিল না, ফলে ব্যবস্থাও নেয়া যায়নি। এ ঘটনাকে পুলিশের অক্ষমতা হিসেবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এ দুটো ঘটনা সরাসরি সরকারবিরোধী বা সরকারকেন্দ্রিক ছিল না বলে গুরুত্ব সম্ভবত যথেষ্ট ছিল না। বিষয়টা এমন নয় যে সরকার বা রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কিছু পুলিশ দেখবে না। কিন্তু ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার মতো জনগণের নামে সরকার তুষ্টিই যেন উদ্দেশ্য না হয়। আনসারীর জানাজায় লোক সমাগম ঠেকানোর ব্যর্থতা কোনো ব্যক্তি পুলিশের ব্যর্থতা নয়। এটা পুলিশি সংস্কৃতির ব্যর্থতা। এ ঘটনায় সরকারের উদ্যোগ ব্রিটিশ শাসনের একটি কৌশলকে পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেয়। ১৮৫৪ সালে মহারাষ্ট্রে পুলিশি অত্যাচারে একটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে, যার উল্লেখ পাই অনুপমা রাওয়ের গবেষণায়। শেষ পর্যন্ত তাতে দোষী সাব্যস্ত হয় নিম্নপদস্থ একজন ভারতীয় পুলিশ। তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ভারতীয়রা জাতিগতভাবেই গণ্ডগোল ও অত্যাচারপ্রিয়। এই তদন্তের ফল প্রকারান্তে ঢেকে দেয় ঔপনিবেশিক শাসনের কাঠামোগত সমস্যাকে। দোষ পড়ে ভারতীয় পুলিশের ঘাড়ে। আনসারীর ঘটনায় প্রত্যাহার করা হয় সার্কেল এএসপি ও সংশ্লিষ্ট থানার ওসিকে। আড়ালে চলে যায় কাঠামো ও দৃষ্টিভঙ্গিগত সমস্যা। 

স্বাধীনতা-উত্তরকালে এই ঔপনিবেশিক কাঠামো থেকে পুলিশের অবশ্যই বেশকিছু উন্নয়ন হয়েছে। সেবার পরিধি ও মান বেড়েছে। লোকবল বেড়েছে। দক্ষতা বেড়েছে। কিন্তু মূল কাঠামো ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রায় নেই বললেই চলে।

ঔপনিবেশিক কাঠামোর মতো যে সমাজে বা রাষ্ট্রে পুলিশিং সম্মতিভিত্তিক না হয়ে জোরভিত্তিক পদ্ধতিতে চলে, সে সমাজ বা রাষ্ট্রে কম কেইসফাইল হওয়া বাজে বা দুর্বল পুলিশিংয়ের লক্ষণ। কম কেইস মানে পুলিশকেই মানুষ ভয় করে এবং ছোটখাটো সমস্যা এড়িয়ে যায়, পুলিশও কম অপরাধ আবিষ্কার করে। বাংলাদেশ পুলিশের জনগণের কাছে যাওয়ার সবচেয়ে ভালো উদ্যোগ সম্ভবত ‘জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯’ চালুকরণ। কিন্তু সরকার ও পুলিশি ব্যবস্থার দৃষ্টিভঙ্গি বা দর্শনগত পরিবর্তন না করে এমন উদ্যোগেরও কাঙ্ক্ষিত ফল লাভের সম্ভাবনা কম। বাংলাদেশ পুলিশ চলে ঔপনিবেশিক টপ-ডাউন ভিত্তিতে, যেখানে উপর থেকে আদেশ আসে এবং তা নিচে প্রতিফলিত হয়। কিন্তু জনগণের পুলিশ হতে হলে তার চলার কথা বটমআপ ভিত্তিতে, যেখানে নিচের প্রয়োজনের ভিত্তিতে সাড়া দেবে উপর।

ঔপনিবেশিক আইনের প্রসঙ্গ বাদ দিয়েও শুধু জনবল কাঠামোর দিকে তাকালেও পুলিশের ঔপনিবেশিক ছাপ এড়ানো যায় না। বাংলাদেশ পুলিশের সিংহভাগ কনস্টেবল। এ পদে নিয়োগের ন্যূনতম যোগ্যতা মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হওয়া। কোনো কনস্টেবল কেইস ফাইল বা তদন্তের ক্ষমতা রাখেন না। অর্থাৎ সিংহভাগ পুলিশই অপরাধ তদন্তবিষয়ক কাজ থেকে দূরে। মূলত ব্যারাকবাসী এই পুলিশ সদস্যরা বিশেষ দরকারে ডাক পেয়ে থাকেন, যেমন জনসমাবেশ নিয়ন্ত্রণ, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, বড় কোনো অভিযান ইত্যাদি ক্ষেত্রে। এখন লক্ষ করার বিষয় হলো, কনস্টেবলের নিয়োগের যোগ্যতা যদি আরেকটু বাড়ানো হয় এবং তাকে কেইস পরিচালনার উপযোগী করা হয়, তাতে সমস্যা কোথায়? ১৯৭১ সালে প্রখ্যাত পুলিশ বিশেষজ্ঞ ডেভিড বেইলি ভারতীয় পুলিশের জন্য কনস্টেবল পর্যায়ে সংস্কারের এমনই পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু এমন প্রস্তাবনা বা আলোচনা সত্ত্বেও ভারত-বাংলাদেশ অঞ্চলে পুলিশিংয়ে কনস্টেবলের ভূমিকা বদলায়নি। এর একটা বড় কারণ হলো, ব্রিটিশ কাঠামোর মতো পুলিশের স্তরভিত্তিক কাজের বিভাজন অব্যাহত রাখা। কিন্তু বেইলি ইংল্যান্ড ও আমেরিকার উদাহরণ টেনে দেখিয়েছেন পুলিশিংয়ের মূল দায়িত্বে কাজের ধরন ভাগ করা জরুরি নয়। কাজের ধরন ভাগ হবে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত ও প্রশাসনিক কাজের ক্ষেত্রে। 

ঔপনিবেশিক প্রভাব কাটিয়ে পুলিশকে যদি জনগণের হতে হয় এবং জনগণের সেবার মধ্য দিয়েই সরকারের দায়িত্ব পালন করতে হয়, তবে পুলিশি ব্যবস্থার চেয়েও সরকার ব্যবস্থার দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তন অধিক জরুরি। সম্মতিভিত্তিক পুলিশিং পুলিশের একার কাজ নয়। পুলিশকে জনগণের হতে হলে পূর্বতন উপনিবেশগুলোর জন্য বিউপনিবেশায়নের রাজনীতির বিকল্প নেই। 

সামজীর আহমেদ: শিক্ষক, উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন