কমরেড মণি সিংহের জীবন-সংগ্রাম

হাবীব ইমন

তুমি কি মিলিয়ে গেলে শূন্যতায় ভাস্বর পুরুষ?

না, তুমি নিদ্রিত দ্বিপ্রহরে;

যেন যুদ্ধ বিরতির পর কোনো পরিশ্রান্ত সেনানী বিশ্রামে

ভরপুর। তোমার নিদ্রার মসলিন

কিছুতে হবে না ছিন্ন চিলের কান্নায়, প্রতিবাদী

মানুষের যৌথ পদধ্বনিত অথবা

রক্ত গোলাপের মতো পতাকা জাগরে স্বননে

জোয়ারে প্রবল উচ্ছ্বাসে।  

ভাস্বর পুরুষ : শামসুর রাহমান 

পাকিস্তানের শুরুর দিকে টঙ্ক আন্দোলনকে দমন-পীড়ন চালিয়ে নিস্তব্ধ করে দেয়ার পর নূরুল আমিনের সদম্ভ আস্ফাালন―‘কমিউনিস্টদের এবার কবর দিয়ে দিলাম’ প্রসঙ্গটি উল্লেখ করে মণি সিংহ তার ভাষণে প্রায়ই এ বিষয়ে উপসংহার টানতেন এই বলে, ‘কমিউনিস্ট পার্টি শ্রমিকের পার্টি, গরিবের পার্টি, ইনসাফের পার্টি। এই পার্টিকে যারা ধ্বংস করতে চাবে, তারাই ধ্বংস হয়ে যাবে। কমিউনিস্ট পার্টি জিন্দা আছে, জিন্দা থাকবে।’ 

পাটির মধ্যে ক্রমে প্রসারমাণ দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদী, মধ্যবিত্তসুলভ-প্রবণতা ও বিচ্যুতি সম্পর্কে তিনি খুবই সচেতন ছিলেন। কেন্দ্রীয় কমিটিতে তিনি বহুবার সতর্কতা উচ্চারণ করেছেন। দু-এক সময় ক্রোধান্বিত হয়ে এও বলেছেন যে, ‘এভাবে যদি চলে তা হলে পার্টি একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। আজ তোমরা যেসব কথা বলছ, দেখো এসব কথার সুর ধরেই একদিন বলবে যে পার্টিই বাতিল করা হোক, শ্রেণি সংগ্রাম বাতিল করা হোক। এসব এখনই তোমরা বন্ধ করো। নয়তো সর্বনাশ হয়ে যাবে’। পার্টির ভেতরে আমলাতান্ত্রিক প্রবণতা, শ্রেণি সংগ্রাম থেকে দূরে থেকে পার্টি নেতৃত্বের কাছে ভিড় করার প্রবণতা, নানা অজুহাতে পার্টির শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, সময়ানুবর্তিতার লঙ্ঘন, সার্বক্ষণিকদের কর্মকাণ্ডে ঢিলাঢালা ভাব ইত্যাদির তিনি কঠোর সমালোচক ছিলেন। পার্টিতে এসবের অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে তিনি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতেন। 

কমরেড মণি সিংহ। অবিভক্ত ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলনের কিংবদন্তি নেতা, তার অন্যতম স্থপতি। ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামী, টঙ্ক আন্দোলনের মহানায়ক, তেভাগা আন্দোলনের কুশীলব  মণি সিংহ ছিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তিনি ছিলেন এ দেশের তরুণ বিপ্লবীদের কাছে অনুপ্রেরণা ও উজ্জীবনের অফুরান উৎস। ছিলেন মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের সৃজনশীল বৈজ্ঞানিক মতাদর্শে দৃঢ় আস্থাবান একজন সাচ্চা কমিউনিস্ট নেতা। তিনি কোনো বড়মাপের মার্ক্সবাদী একাডেমিক ছিলেন না। তাত্তি¡ক খুটিনাটিতেও তিনি বিশেষজ্ঞ ছিলেন না। কিন্তু তিনি মার্ক্সবাদকে গভীরতা দিয়ে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তিনি তত্ত¡ মুখস্থ বলতে পারতেন না, কিন্তু প্রজ্ঞার সঙ্গে তত্ত¡কে প্রয়োগ করতে পারতেন। তার জীবন-সংগ্রাম ছিল মেহনতি মানুষের মুক্তির জন্য এবং তার মধ্য দিয়ে সার্বিকভাবে মানবমুক্তির জন্য। তার বিপ্লবী জীবনাদর্শ ও অক্ষয় বিপ্লবী কর্মকাÐের মাঝেই তার কালজয়ী পরিচয় লিপিবদ্ধ। এ কর্মকাÐ বাদ দিয়ে পৃথক অন্য কোনোভাবে তার পরিচয় খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা বৃথা। এ পরিচয়েই তিনি হয়ে উঠেছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ জাতীয় নেতা। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নেতা-সংগঠক হিসেবে স্মরণীয় তিনি। 

খুবই সাদাসিধে জীবন-যাপন করতেন। প্রথম জীবনের কথা কিছু কালের কথা বাদ দিলে, বাদবাকী জীবনে তিনি সাদা পাজামা এবং ফুলহাতা সাদা শার্ট পরেই কাটাতেন। ধুমপান করতেন না কখনো। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি তার দরদ ছিলো অপরিসীম। সহযোগী কর্মী-কমরেডদের প্রতিও ছিলো পরম মমত্ববোধ। তাদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন। প্রচণ্ড কাজের ফাঁকেও বইপড়া ছিল তার একটি অন্যতম নিয়মিত অভ্যাস। নিয়ম-শৃঙ্খলা ছিল তার জীবনের প্রধানতম চরিত্র-বৈশিষ্ট্য। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতেন। সময় মেপে প্রাতরাশ করতেন। আহারও করতেন নিয়মিত। যতদিন দৈহিকভাবে সক্ষম ছিলেন অর্থাৎ চলাফেরা করতে পারতেন, ঘড়ির কাঁটা ধরে অফিসে আসতেন। আর এ জন্যে পার্টির নেতা ও কর্মীদের কাছে চালু ছিল ‘মণি সিংহ টাইম’ পরিচিত। ১৯০১ সালের ২৮ জুলাই কলকাতার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে কমরেড মণি সিংহের জন্ম। মাত্র আড়াই বছর বয়সে তার বাবা কালী কুমার সিংহের মৃত্যু হলে পরিবার সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়ে। তারা কিছুদিন ঢাকায় তার মামা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সুরেন সিংহের বাড়িতে থাককেন। মা সরলা দেবী ৭ বছরের মণি সিংহকে নিয়ে ময়মনসিংহের (বর্তমানে নেত্রকোনা) সুসং দুর্গাপুরে চলে আসেন। এখানে সরলা দেবী তার ভাইদের জমিদারির অংশীদার হয়ে বসবাস শুরু করেন। 

স্কুলে পড়াসময়ে মণি সিংহ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯১৪ সালে সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী ‘অনুশীলন’ দলে যোগ দিয়ে ক্রমেই বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে স্থান করে নেন। ‘দুই শত বছরের বৈদেশিক শাসনে জিঞ্জির থেকে উপমহাদেশকে মুক্ত করার সংগ্রামে অসহযোগ খেলাফত আন্দোলনের আমলে যে বিপ্লবী যুবকরা সর্বস্ব ত্যাগ করে সামনের সারিতে এসে যোগ দিয়েছিলেন কমরেড মণি সিংহ তাদের অন্যতম।’

১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলন ও খেলাফত আন্দোলনের বিপুল গণজাগরণ তরুণ মণি সিংহের মনে গভীর রেখাপাত করে এবং সন্ত্রাসবাদী পদ্ধতি সম্পর্কে তার মনে সংশয় দেখা দেয়। ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র জাতীয় সংগ্রামে কৃষকদের টেনে আনার উদ্দেশ্যে তিনি নিজ জেলার কৃষকদের সংগঠিত করতে থাকেন। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের আদর্শে উদ্বুদ্ধ কমরেড মণি সিংহ ১৯২৫ সালে প্রখ্যাত বিপ্লবী গোপেন চক্রবর্তীর সাথে সুসংয়ে আলোচনার পর মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদকে আদশরূপে গ্রহণ করেন। 

কমরেড মণি সিংহ ১৯২৮ সাল থেকে কমিউনিস্ট পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে নিজেকে বিপ্লবী কর্মকাÐে উৎসর্গ করেন। এ সময় তিনি কলকাতায় শ্রমিক আন্দোলনে একনিষ্ঠভাবে কাজ করতে থাকেন। কেশোরাম কটন মিলের পর শ্রমিকনেতা হিসেবে মণি সিংহের নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ওই ১৯২৮ সালেই তিনি কলকাতার ধাঙ্গর ধর্মঘট, ১৯২৯ সালে ক্লাইভ জুট মিল, বাংলাদেশের প্রথম সর্বাত্মক পাটকল ও চটকল থর্মঘট এবং গার্ডেনরিচ জাহাজ মেরামত ওয়ার্কশপে বাংলাদেশে প্রথম মে দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠিত ধর্মঘট আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব দেন। 

১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ফলে ব্রিটিশ সরকার ক্ষিপ্ত হয়ে মণি সিংহকে এ বছরেরই ৯ মে কলকাতার বৈঠকখানা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে এবং রাজবন্দি হিসেবে জেলে বন্দি করে রাখে। ১৯৩৫ সালে জেল থেকে মুক্তি পেলেও নিজ গ্রাম সুসং দুর্গাপুরে তাকে অন্তরীণ করে রাখা হয়। এ সময় কৃষক-ক্ষেতমজুরদের পক্ষ নিলে নিজ মামাদের জমিদার পরিবারের সঙ্গে তার বিরোধ তৈরি হয়। পাটের ন্যায্য মূল্য দাবি করে কৃষকদের পক্ষে ভাষণ দিলে তার দেড় বছরের জেল হয়। দেড় বছর জেল থেকে মুক্ত হয়ে তিনি পুনরায় নদীয়া জেলার এক গ্রামে অন্তরীণ হন। 

১৯৩৭ সালে জেল থেকে বেরিয়ে এলে পার্টির সদস্য বলে তাকে জানানো হয়। ‘জীবন-সংগ্রাম’ বইয়ে পার্টির সদস্যপদ প্রাপ্তি সম্পর্কে তিনি লিখেছেন- ‘১৯২৫ সালে কমিউনিস্ট পার্টির আর্দশে অর্থাৎ মার্কসবাদ-লেনিনবাদ দীক্ষা নিয়ে ১৯২৮ সাল থেকে সার্বক্ষণিক কর্মী হয়ে যাই। তখন পার্টিতে সভ্যপদ খুবই সংকীর্ণ ভিত্তিতে দেয়া হত। কাজেই আমি শ্রমিক আন্দোলনে একনিষ্টভাবে কাজ করলেও পার্টির সভ্যপদ তখনও পাইনি। তবে কমরেড মুজাফফর আহমদ আমাকে ওয়ার্কাস অ্যান্ড পিজেন্টস পার্টিতে নিয়ে নেন ১৯২৮ সালে। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির কথা ঘুণাক্ষরেও বলেননি। জেল থেকে বের হয়ে এলে আমি পার্টির সভ্য বলে আমাকে জানানো হয়। তখন ১৯৩৭ সাল।’ 

এরপর দুর্গাপুরে মায়ের সাথে দেখা করে কলকাতার শ্রমিক আন্দোলনে ফিরে যেতে চাইলেও, এলাকার মুসলমান কৃষক ও গারো হাজং প্রভৃতি আদিবাসী মণি সিংহকে ‘টঙ্ক প্রথা’র বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য বার বার অনুরোধ করতে থাকেন। কৃষকদের দুঃখের কথা শুনে তাদের আশ্বাস দিয়ে বললেন, ‘আপনারা যদি সব এক জোট হয়ে আন্দোলন করেন, তবে নিশ্চয়ই টংক প্রথা উচ্ছেদ হয়ে যাবে।’ এরপর মণি সিংহ সর্বতোভাবে টঙ্ক আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করেন এবং কালক্রমে তিনি এ আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন। মণি সিংহ তার বইতে লিখেন- ‘আমি ভাবতে লাগলাম আমি যদি মার্কসবাদ-লেনিনবাদে বিশ্বাসী হই, যদি মার্কসবাদ-লেলিনবাদ গ্রহণ করে থাকি, তবে সেখানে আমার পরিবারে স্বার্থনিহিত রয়েছে- প্রয়োজনে ও আদর্শের জন্য তার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা আমার কর্তব্য। যা অন্যায়, যা সামন্ততান্ত্রিক অবশেষে তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করাও উচিত।’ তিনি আরো উল্লেখ করেন, ‘আমার যতটুকু মার্কসবাদ-লেলিনবাদের জ্ঞান ছিল, আর যেটুকু শ্রমিক আন্দোলনের অভিজ্ঞতা হয়েছিল তাকেই ভিত্তি করে সমস্ত দ্বিধাদ্বন্ধ কাটিয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, টংক আন্দোলনে আমি সর্বোতভাবে শরিক হবো।’ আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেতে থাকলে ১৯৪১ সালে মণি সিংহকে আবার গ্রেপ্তার করে ১৫ দিন আটক রাখা হয়। ছাড়া পেয়ে তিনি পরিস্থিতি বুঝে আত্মগোপনে চলে যান। ১৯৪২ সালে তার একজনের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে তার সহকর্মী প্রমথ গুপ্তসহ জামালপুরে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে যান। এক মাসের কারাদণ্ড হয় তার। 

১৯৪২ সাল। জেল থেকে বের হলেন মণি সিংহ। বিনা বিচারে তাকে আর আটক রাখা হলো না। এদিকে এ বছরেরই জুলাই মাসে কমিউনিস্ট পার্টিকেও করা হলো আইনসঙ্গত। তাই নতুন করে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনি, পার্টি সংগঠন গড়ে তোলার কাজে। মুক্তি পাওয়ার কিছুকাল পরই নেত্রকোনা শহরে অনুষ্ঠিত হয় একটি ফ্যাসিবাদ-বিরোধী সম্মেলন। এই সম্মেলন অনুষ্ঠানে অন্য অনেকের সঙ্গে মণি সিংহও বিরাট ভ‚মিকা পালন করেন। 

১৯৪৪ সালে মণি সিংহ সারা বাংলার কৃষাণ সভার প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৫ সালে নেত্রকোনায় অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত কৃষাণ সভার ঐতিহাসিক সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে মণি সিংহ ছিলেন সম্মেলনের অন্যতম প্রধান সংগঠক। ১৯৪৭ সালের আগে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম করতে গিয়ে কমরেড মণি সিংহকে অসংখ্যবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জেল-জুলুম-নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। 

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ণ গণতন্ত্র ও শোষণমুক্ত সমাজের আদর্শকে যারা সামনে নিয়ে এসেছেন মণি সিংহ তাদের একজন। আর এ কাজটি করতে গিয়ে তার ওপর নেমে আসে পাকিস্তান সরকারের দমন-নির্যাতন ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। পাকিস্তান হওয়ার পর থেকে প্রায় ২০ বছর তিনি আত্মগোপনে থাকতে বাধ্য হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি ছিল এবং আইয়ুব সরকার তাকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। ১৯৫১ সালে কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে তিনি আত্মগোপন অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৫ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় সম্মেলনে পুনরায় পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ’৬৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টির চতুর্থ সম্মেলনে (যেটাকে পার্টির প্রথম কংগ্রেস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল) তিনি জেলে থাকাকালীন সময় কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। 

১৯৬১ সালর নভেম্বর মাসের শেষে আওয়ামী লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে এক ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা অনুৃষ্ঠিত হয়। তখন সামরিক শাসক আইয়ুব খানের দমন-পীড়ন সমানে চলছে। এই বৈঠকের ব্যাপারে কঠোর সর্তকতা আর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছিল, কেননা মণি সিংহ ও খোকা রায়ের মাথার ওপর তখনো ঝুলছিল হুলিয়া। শেখ মুজিবুর রহমান বললেন, ‘দাদা আপনার বহু সংগ্রামের পোড় খাওয়া নেতা। আপনারা পথ নির্দেশ দিন কিভাবে আন্দোলন শুরু করা যায়। সামরিক শাসন দেশটাকে ছারখার করে ফেলল। প্রতিবাদের পথ বন্ধ করে দিয়ে পাঞ্জাবি বিগ বিজনেস লুটে নিয়ে যাচ্ছে বাংলার সম্পদ। সোনার বাংলা আজ শ্মশান। এ অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। দেশের মানুষও তৈরি। শুধু সাহস করে ডাক দেয়ার অপেক্ষা।’

মণি সিংহ বললেন, ‘আপনারা যুবক। দেশের ভবিষ্যত আপনাদের হাতে। মানুষ আপনাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তরুণ সমাজকেই সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। নেতৃত্ব নিয়ে এগিয়ে বলে বাতিল করে দেবেন না। আমরাও আছি আপনাদের তরুণদের মিছিলে।  

১৯৬৯ সালে দেশজুড়ে চলছে আইয়ুব বিরোধী প্রচণ্ড গণআন্দোলন। দেশের মানুষ মানছে না জেল-জুলুম, বুলেট আর গুলি। সেই কালের পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসন কায়েম না হওয়া পর্যন্ত এ সংগ্রাম থামবে না। বিক্ষোভ-আন্দোলনে মানুষ তাই উত্তাল। আর এই আন্দোলনে মুখে ভীত হয়ে সামরিক শাসক আইয়ুব খান রাজবন্দীদের মুক্তি দিতে লাগলেন। অন্য রাজবন্দীদের সঙ্গে এ বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্ত হলেন মণি সিংহ। একই দিনে মুক্ত হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তুলে নেওয়া হলো তার বিরুদ্ধে সাজানো আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। এ বছর ২৫ মার্চ পুনরায় সামরিক আইন জারি হলে মণি সিংহ জুলাই মাসে আবার গ্রেপ্তার হন। পরবর্তীকালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় অনেক নেতাকে মুক্তি দিলেও, ইয়াহিয়া সরকার কমরেড মণি সিংহকে মুক্তি দেয়নি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বন্দীরা রাজশাহীর জেল ভেঙ্গে তাকে মুক্ত করেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন-সাহায্য-সহযোগিতা আদায়ে কমরেড মণি সিংহের অবদান ছিল অবিসংবাদিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করে তিনি ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনী সংগঠিত করার কাজে সমর্থন আদায়ে সক্ষম হন। এর ভেতর দিয়ে পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের পাঁচ হাজার কর্মী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে তাঁকে নির্বাচিত করা হয়।

দ্বিতীয় কংগ্রেস এবং ’৮০ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় কংগ্রেসের মণি সিংহ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। ’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর কমিউনিস্ট পার্টি আবার বেআইনি ঘোষিত হয়। জেনারেল জিয়ার সামরিক শাসন চলাকালে ’৭৭ সালে মাঝামাঝিতে ৭৭ বছর বয়সী মণি সিংহ আবার গ্রেপ্তার হন। ওই বছরের মাঝামাঝি সময়ে একদিন জিয়া তাকে প্রাতঃরাশে আমন্ত্রণ জানায়। জিয়াউর রহমান মণি সিংহকে তার আত্মজীবনী লেখার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু পরদিন ভোররাতে কমরেড মণি সিংহকে নিবর্তনমূলক আইনে গ্রেপ্তার কওে বিনা বিচারে ৬ মাস কারাগারে অন্তরীণ রাখা হয়।

১৯৩৫ সালে বিয়ে করেন অনিমা সিংহকে। অনিমা ছিলেন সুনামগঞ্জের এক সম্ভ্রান্ত ও রাজনৈতিক পরিবারের মেয়ে। টঙ্ক আন্দোলন করতে গিয়ে দুজনের পরিচয়। পরে দুপক্ষের পরিবার পর্যায়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। এদেশের কৃষক নারী প্রগতি আন্দোলনে তার অবদান ভুলবার। ১৯৫৬ সালে তাদের একমাত্র সন্তানের জন্ম হয়। নাম দিবালোক সিংহ। অনিমা সিংহ ১৯৮০ সালের ১ জুলাই এক আকস্মিক দুঘর্টনায় প্রাণ হারান। 

কিংবদন্তি এই আজীবন বিপ্লবী যোদ্ধা ৮৪ বছর বয়স পর্যন্ত সক্রিয়ভাবে পার্টির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালে ২২ ফেব্রæয়ারি রাতে আকস্মিকভাবে রক্তক্ষরণজনিত কারণে তার শরীরে ডান পাশ অবশ হয়ে যায়। ফলে চলাচলের শক্তি হারিয়ে ফেলেন। এক বছর পর অর্থাৎ ১৯৮৫ সালে তিনি হারিয়ে ফেললেন কথা বলার শক্তিও। অবশেষে ঘনিয়ে এলো সেই রক্তিম দিন। অন্তিম ক্ষণ। ১৯৯০ সালের ৩১ ডিসেম্বর তার দীর্ঘ বিপ্লবী জীবনের অবসান ঘটে। 

চিতার আগুনে জ্বলে জ্বলে একসময় ছাই হয়ে যায় মণি সিংহের মরদেহ। কিন্তু যে জীবন ও সংগ্রামী দৃষ্টান্ত তিনি সারা জীবনের অক্লান্ত সাধনায় রেখে গেছেন তা অমর। তিনি বলে গেছেন, ‘মার্কসবাদ-লেনিনবাদ গ্রহণ করে এদেশের বিপুৃল অংশ শ্রমিক-কৃষক-ক্ষেতমজুরের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য যৌবনের প্রথমে সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে যে সংগ্রাম শুরু করেছিলাম আজ তরুণরা অনেকেই এগিয়ে এসেছেন সেই সংগ্রামকে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব নিয়ে। আর এখানেই আমার মতোই সূচনায় যারা এগিয়ে এসেছিলেন তাদের জীবনের সার্থকতা।’ আজীবন বিপ্লবী, একজন আদর্শবান, ন্যায়নিষ্ঠ, সৎ, সংগ্রামী ও আপোষহীন, সময়ানুবর্তী এবং বিপ্লবী শৃঙ্খলা রক্ষায় অবিচল, মানবতাবাদী ও দেশপ্রেমিক এই মহান নেতা বাংলাদেশের জনগণের সামনে আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবেন। 

হাবীব ইমন : সভাপতি, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, ঢাকা মহানগর

সূত্র : 

জীবন সংগ্রাম, মণি সিংহ

মণি সিংহ, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন