জুনের শেষ দিক থেকে শুরু হওয়া বন্যা পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হওয়ায় মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছেন আক্রান্ত এলাকাগুলোর কৃষকরা। দুই ধাপের বন্যায় কৃষকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন শেষ ধাপটিতে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) জানিয়েছে, এবারের বন্যার দ্বিতীয় ধাপে দুর্গত ৩৫ জেলায় ১৪টি ফসলের মোট দেড় লাখ হেক্টরেরও বেশি জমি প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে ধানী জমি, যার পরিমাণ প্রায় এক লাখ হেক্টর।
দেশে চলমান বন্যা পরিস্থিতি ক্রমশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। হুমকির মুখে পড়ছে কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তা। এ অবস্থায় বেসরকারি কয়েকটি উন্নয়ন সংস্থার পক্ষ থেকে এরই মধ্যে চলমান বন্যা পরিস্থিতিকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণার দাবি তোলা হয়েছে। তথ্য বলছে, গত মাসের শেষ দিক থেকে দুই ধাপে দেখা দেয়া বন্যায় এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। বন্যাদুর্গত এলাকাগুলোয় প্লাবন ও নদীভাঙনে মারাত্মক জনদুর্ভোগ দেখা দেয়ার পাশাপাশি শস্য আবাদও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভয়াবহ মাত্রায়। ২৮ জুলাই পর্যন্ত হালনাগাদকৃত তথ্য বলছে, ১১ জুলাই দ্বিতীয় ধাপের বন্যা শুরুর পর আক্রান্ত ফসলি জমির মধ্যে ধানি জমির পরিমাণই সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে বোনা আমনের ফসলে ক্ষতির মাত্রা বেশি। অন্যদিকে পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, এ ৩৫ জেলায় বোনা আমন আবাদে ব্যবহূত মোট জমির প্রায় এক-চতুর্থাংশই বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে।
ডিএইর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৩৫ জেলায় দ্বিতীয় ধাপের বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে ১৪টি ফসলের প্রায় ১ লাখ ৫৫ হাজার ৫৭৫ হেক্টর জমি। এর মধ্যে আউশ ও আমন ধানই রয়েছে সবচেয়ে বেশি। এ ১৭ দিনে আউশ ধানের ক্ষতি হয়েছে ৩৫ হাজার ৮২১ হেক্টর। এছাড়া বোনা আমন ধানের ৫৬ হাজার ৩৬২ হেক্টর ও রোপা আমন ধানের ৮ হাজার ৭৫৪ হেক্টর জমি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে আক্রান্ত ধানি জমির পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৯৩৮ হেক্টর। এর বাইরেও আমন বীজতলার ক্ষতি হয়েছে ৯ হাজার ৪৮৫ হেক্টর।
এর আগে ২৫ জুন থেকে ৯ জুলাই পর্যন্ত প্রথম দফার বন্যায় ১৪টি জেলায় ১১টি ফসলের প্রায় ৭৬ হাজার ২১০ হেক্টর জমি আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে ৪১ হাজার ৯১৮ হেক্টর জমি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। টাকার অংকে এ ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩৪৯ কোটি টাকা। মোট ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ৩ লাখ ৪৪ হাজার জন।
দ্বিতীয় ধাপের বন্যায় মোট আক্রান্ত জমির কতটুকু সম্পূর্ণ তলিয়ে গিয়েছে, সে হিসাব এখনো চূড়ান্ত করেনি ডিএই। এছাড়া টাকার অংকে ক্ষতি এবং মোট কৃষকের পরিমাণও শিগগিরই চূড়ান্ত করা হবে বলে জানিয়েছে ডিএই।
এদিকে বন্যা পরিস্থিতি আরো দীর্ঘায়িত হওয়ার পাশাপাশি কৃষকদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এ ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার তাগিদে এরই মধ্যে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। বন্যায় কৃষকদের ক্ষতি কমানোর উদ্দেশে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সব ধরনের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোর কৃষকদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বীজ-সার সরবরাহসহ বিভিন্ন প্রণোদনা কার্যক্রম বেগবান করার পাশাপাশি এগুলো তদারকি ও সমন্বয়ের জন্য ১২টি কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
বন্যা পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হতে পারে এমন শঙ্কা প্রকাশ করে সম্প্রতি কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাকও বলেছেন, দিন দিন বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। কৃষিতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। বন্যার পানি নেমে গেলে জরুরি ভিত্তিতে কৃষি পুনর্বাসন ও ক্ষয়ক্ষতি কমাতে কাজ শুরু করার নির্দেশনা মাঠ পর্যায়ে দেয়া হয়েছে। বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি আমাদের রয়েছে। আমনের জন্য অতি দ্রুত বিকল্প বীজতলা তৈরি করতে হবে। বীজ, সারসহ কৃষি উপকরণের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। এসব বীজ ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করে দ্রুত নতুন বীজতলা তৈরি করা হবে। চলমান বন্যার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের কৃষি পুনর্বাসনের পাশাপাশি ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় সব কর্মকর্তাকে তত্পর থাকতে কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি আগামী রবি মৌসুমের জন্য আগাম প্রস্তুতি নেয়ারও দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
ডিএই জানিয়েছে, বন্যায় আউশ ও আমনের জমি ছাড়াও পাটের আবাদি জমি প্লাবিত হয়েছে ২৬ হাজার ৯১৫ হেক্টর। গ্রীষ্মকালীন সবজি আবাদে ব্যবহূত জমি আক্রান্ত হয়েছে ১১ হাজার ৮২১ হেক্টর। এছাড়া ১ হাজার ৪৯৭ হেক্টর ভুট্টা আবাদি জমি, ১ হাজার ৮১৪ হেক্টর তিল ও ১ হাজার ৭৫৫ হেক্টর আখ আবাদি জমি বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া যেসব ফসলের আবাদি জমি বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে মরিচ (৬৬০ হেক্টর), চিনাবাদাম (১০ হেক্টর), পান (১৮৫ হেক্টর), কলা (১৮১ হেক্টর) ও লেবু (৩১৩ হেক্টর)।
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পুনর্বাসন কার্যক্রম সম্পর্কে অধিদপ্তর জানিয়েছে, বন্যায় অধিক ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোয় প্রায় ২ কোটি ১৫ লাখ টাকার কমিউনিটিভিত্তিক রোপা আমন ধানের চারা উৎপাদনের পাশাপাশি তা ক্ষতিগ্রস্ত প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকদের মধ্যে বিনা মূল্যে বিতরণ করা হবে। ৭০ লাখ টাকার ভাসমান বেডে রোপা আমন ধানের চারা উৎপাদন করা হবে। রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টারের মাধ্যমে রোপণের জন্য ট্রেতে নাবী জাতের আমন ধানের চারা উৎপাদন ও ক্ষতিগ্রস্ত প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকের মধ্যে বিনা মূল্যে বিতরণ কর্মসূচি হাতে নেয়া হবে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় আমন চাষ সম্ভব না হলে ৫০ হাজার কৃষকের মধ্যে প্রায় ৩ কোটি ৮২ লাখ টাকার মাসকলাই বীজ ও সার দেয়া হবে।
এ বিষয়ে কৃষি সচিব মো. নাসিরুজ্জামান বলেন, আমনের বীজতলা তৈরি করতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে স্থানীয় কৃষি অফিসের মাধ্যমে বিকল্প বীজতলা তৈরি করা হয়েছে। এসব বীজতলার মাধ্যমে বন্যা আক্রান্ত এলাকাগুলোর চাহিদা সহজেই মেটানো সম্ভব হবে। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেই বীজতলা তৈরি করা হবে। এছাড়া উপকরণ সহায়তা বাড়ানো হবে। রবি মৌসুমের জন্যও ব্যাপক আগাম প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। কৃষকদের যাতে ক্ষতিতে পড়তে না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে সব ধরনের বিকল্প উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।