আইন ও নীতিমালার যথাযথ প্রয়োগ বিদেশি বিনিয়োগের পূর্বশর্ত

সানজানা হক মিফতা

তরুণ প্রজন্মের নীতি গবেষণামূলক প্ল্যাটফর্ম  'ইয়ুথ পলিসি ফোরাম' (ওয়াইপিএফ) আয়োজিত 'রি-থিংকিং এফডিআই : ফর দ্য মেনি' শীর্ষক অনলাইন সিরিজের তৃতীয় পর্ব- 'ইনভেস্টমেন্ট পলিসি এন্ড রেগুলেটরি রিফর্ম' অনুষ্ঠিত হয়ে গেল গত ২৪ জুলাই। 

ওয়াইপিএফ এর উপদেষ্টা এবং অর্থনীতিবিদ ডক্টর আখতার মাহমুদের সঞ্চালনায় এবারের পর্বে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) এর সভাপতি নিহাদ কবির, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া এবং টাঙ্গাইল-৬ আসনের সংসদ সদস্য আহসানুল ইসলাম টিটু। 

আলোচনার শুরুতেই বিদেশি বিনিয়োগ সংক্রান্ত নীতিমালার নানা বিষয়ে ইয়ুথ পলিসি ফোরামের পক্ষ থেকে পর্যালোচনা তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, আমাদের দেশে কাগজে কলমে বিদেশি বিনিয়োগ সংক্রান্ত অনেক ভালো আইন ও নীতিমালা থাকা সত্ত্বেও এই আইনগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়া বিদেশি বিনিয়োগের পথে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে। 

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) উদ্দেশ্য যেখানে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা সেখানে বিনিয়োগ বিষয়ে দক্ষ এবং অভিজ্ঞ কর্মকর্তা না থাকায় সেটি বিদেশি বিনিয়োগকে যথাযথ ভাবে আকৃষ্ট করতে পারছে না। এছাড়া সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বশীল সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা,  বিনিয়োগ সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণ এবং তথ্য প্রাপ্তির ব্যবস্থা না থাকা, যথাযথ অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থা না থাকায় আমাদের দেশে এফডিআই ব্যহত হচ্ছে বলে এ পর্যালোচনায় তুলে ধরা হয়।

ডক্টর আখতার মাহমুদ বলেন, আমাদের আইন ও নীতিমালায় অস্পষ্টতা থাকার কারণে বিনিয়োগের পরিবেশে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয় এবং এতে করে সরকারি কর্মচারীদের বিবেচনামূলক ক্ষমতার ভুল প্রয়োগের আশঙ্কা থেকে যায়। 

নিহাদ কবির বলেন, কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে চীন থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ প্রত্যাহারের ফলে বিশ্ব বাণিজ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দৃঢ় করবার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। আমাদের সক্ষমতা ও যোগ্যতার কারণে এখন শুধু তৈরি পোশাক শিল্পেই নয়, বরং বিশ্ববাজারে রপ্তানির ক্ষেত্রে ওষুধ শিল্প, চামড়াজাত শিল্প, সিরামিক শিল্প ইত্যাদিরও বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। 

তিনি আরো বলেন, ‘ভৌগোলিক ও জনসংখ্যার দিক থেকে আমরা যথেষ্ট সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার পরও, আমরা প্রত্যাশিতভাবে বিদেশি বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করতে পারছি না। এর কারণ হল, আমরা এখনো বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে আমাদের সম্ভাবনা ও সক্ষমতা যথাযথভাবে তুলে ধরে আমাদের দেশের প্রতি বিনিয়োগকারীদের মনোভাব পরিবর্তন করতে পারিনি।'

তিনি মনে করেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য আমাদের দেশের বিনিয়োগ সংক্রান্ত আইন ও নীতিমালার যথাযথ সংশোধন ও পরিবর্তন প্রয়োজন। বিশেষ করে ট্যাক্স ও বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় সংক্রান্ত আইনগুলোর সীমাবদ্ধতা নিয়ে কাজ করা সময়ের দাবি। বিডা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার গবেষণা সক্ষমতা জোরদার করা উচিত বলে তিনি মনে করেন।

পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগের অপ্রতুলতা নিয়ে ডক্টর আখতার মাহমুদের প্রশ্নের উত্তরে আহসানুল ইসলাম টিটু, এমপি, পোর্টফোলিও বিনিয়োগের গুরুত্ব উল্লেখ করে বলেন, প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই নিশ্চিত করতেই আমাদের পোর্টফোলিও বিনিয়োগের দিকে নজর দিতে হবে। সামিট গ্রুপ, বেক্সিমকো, স্কয়ার, ওয়ালটন, প্রাণের মত পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি এর সাফল্য বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করতে অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে তিনি মনে করেন।  

এছাড়াও তিনি বলেন, বিদ্যুৎ খাত, এলএনজি খাত, এবং গভীর সমুদ্র বন্দর খাতে চীন, ভারত ও জাপানের বিনিয়োগকারীদের যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। এ লক্ষ্যে সরকার অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তিনি আরো বলেন, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মত বাংলাদেশেরও উচিত সুকুক ইসলামিক বন্ড প্রবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করা।

আলোচনায় মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া বলেন, বিনিয়োগকারীদের তথ্য প্রাপ্তির সুবিধা নিশ্চিত করতে বিডাকে আরো কাজ করতে হবে৷ বিডার সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য এতে আরো দক্ষ কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হবে। 

বিদেশি বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করতে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মচারীদের আরো আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। তিনি আরো বলেন, অনেক সময় সরকারি কর্মচারীদের অভিজ্ঞতার অভাব বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা সৃষ্টি করে। 

এছাড়াও তিনি বলেন, বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রণে সরকারের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ এবং সংস্থার সাথে বিনিয়োগকারীদের যোগাযোগ থাকলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সুবিধা হয়। মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া বলেন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হবার সাথে সাথে আমাদের দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়তে থাকে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ ও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো বড় প্রজেক্ট বাস্তবায়নের সক্ষমতাও আমাদের দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে।

পুরো আলোচনায় দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে আইন ও নীতিমালার স্থিতিশীলতা ও যথাযথ বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এছাড়াও বিশ্বব্যাংকের ইজ অব ডুইং বিজনেস ইনডেক্স এ বাংলাদেশের সন্তোষজনক অবস্থান না থাকার পিছনেও আইন ও নীতিমালার বাস্তবায়নের অভাব এবং সরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করা হয়।

আলোচকদের আলাপচারিতা থেকে বিদেশি বিনিয়োগের উন্নয়ন সংক্রান্ত নানা বিষয়ে পরামর্শ ও সুপারিশ উঠে আসে। নতুন অতিথিদের অংশগ্রহণে এ সিরিজের সর্বশেষ পর্বটি অনুষ্ঠিত হবে আগামী ৭ আগস্ট।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন