ইয়ুথ পলিসি ফোরামের ডায়ালগে বক্তারা

যে কোনো সঙ্কট সমাধানে মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার হতে পারে প্রেরণা

কে এম নাজিব হায়দার

ইয়ুথ পলিসি ফোরামের ওয়াইপিএফ লুকিং ব্যাক সিরিজের দ্বিতীয় পর্বে বিগত ২৫ জুলাই ২০২০ তারিখে আলোচনা হয় মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার এবং তার কর্মকাণ্ড বিষয়ে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের বিশেষ সহযোগী ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের ভ্রাম্যমাণ দূত মো. নুরুল কাদির, তাজউদ্দিন আহমেদের কন্যা শারমিন আহমেদ, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের কন্যা ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর। ইয়ুথ পলিসি ফোরামের পক্ষ থেকে অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন হাসনাত কালাম সুহান।

অনুষ্ঠানের শুরুতে ইয়ুথ পলিসি ফোরামের পক্ষ থেকে যুদ্ধকালীন সরকারের কার্যাবলীর ইতিহাস সংক্রান্ত তথ্য উপাত্ত কেন্দ্রিক উপস্থাপনা তুলে ধরেন। উপস্থাপনাটির মূল লক্ষ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের কাছ থেকে সংকটময় সময়ে কার্যাবলী চালনায় শিক্ষাগ্রহণ। উপস্থাপকগণ মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের সকল বিভাজন সমাধান করে দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার লক্ষ্যে কীভাবে সমগ্র জাতি একত্রিত হয়ে এক উদ্দেশ্যে লড়ে গেছেন স্বাধীনতা অর্জনের উদ্দেশ্যে, সেই বিষয়ে আলোকপাত করেন।

মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের প্রশাসনিক কাঠামোর স্বচ্ছতা এবং কার্যকারিতা কীভাবে সকল প্রক্রিয়া সফলভাবে সম্পন্ন করতে সহায়তা করেছে, সেটিও তাঁরা তুলে ধরেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেভাবে সকল আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে বাঙালি হিসেবে নিজের আত্মসম্মান নিয়ে সকলের সামনে কথা বলেছেন এবং একই ধারায় মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারও যেভাবে সকল আন্তর্জাতিক প্রাঙ্গনে নিজেদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের নির্বাচিত সরকার হিসেব সম্মানের সাথে উপস্থাপন করেছে, সে ব্যাপারেও আলোকপাত করেন তারা। 

ওয়াইপিএফ এর উপস্থাপনায় আরও উঠে আসে কীভাবে মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা বাঙালিদের সাহায্য নিয়েছে এবং চালনা করেছে দেশের স্বার্থে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে দেশবাসীকে উজ্জীবিত করা থেকে শুরু করে বিদেশী গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গকে আমাদের ন্যায়সঙ্গত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে মুজিবনগর সরকার। যেমন ফ্রেঞ্চ সাহিত্যিক আঁদ্রে মালরো বা বিখ্যাত গায়ক জর্জ হ্যারিসন সবাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে জনমত অর্জনে এবং সেসব দেশের সরকারের উপর চাপ প্র‍য়োগ করে বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করেছিল। এরকম আরও অনেক উপায়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের চৌকস সিদ্ধান্তের প্রমাণ পাওয়া যায় ইতিহাসের পৃষ্ঠায়। 

ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম তার বক্তব্যে পরিষ্কার করেন কেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিপ্লবী পরিষদ গঠন করে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে একটি সরকার ছিলো। যদিও সে সময়ে কারো কারো মত ছিলো সরকার গঠন না করে একটি বিপ্লবী পরিষদ তৈরী করা, তাও সরকারই কেন গঠন করা হলো? এমন প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম বলেন যে জনগণ সত্তরের নির্বাচনে ভোট দিয়ে যে সরকারকে নির্বাচিত করেছে সে সরকার জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেছে, এতে বৈদেশিক যোগাযোগ যেমন সহজ হয়েছে, তেমনি আন্তর্জাতিক আইন মান্য করে সরকার প্রতিটি কাজ করেছে। সরকার গঠনের পিছনে কাজ করেছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। এই ঘোষণাপত্র এবং আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতেই সরকার তার পদক্ষেপগুলি নিয়েছে। এছাড়াও যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন, তাদের আনুগত্য প্রকাশ করার জন্য একটি সরকার গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। তিনি স্মৃতির পাতায় ভ্রমণ করে ভারত সরকারের রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে ভারতে প্রবেশ করার কথা বর্ণনা করেন। তিনি আরও উল্লেখ করেন বিশ্ববাসীর কাছে কেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের গুরুত্ব এবং এর যথার্থতা তুলে ধরা সে সময়ে সবচেয়ে উপকারী সিদ্ধান্ত ছিলো এবং সেটি কীভাবে জনমত আকৃষ্ট করেছিল।

মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের ভ্রাম্যমান রাষ্ট্রদূত মো. নুরুল কাদির তার বক্তব্যে তুলে আনেন তিনি কীভাবে ভারতীয় গায়িকা ওয়াহিদা রেহমানের কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের গুরুত্ব বর্ণনা করেন এবং এর ফলে ওয়াহিদা রেহমানের সমর্থন আদায় করে ভারতীয় জনগণকে প্রভাবিত করা সহজ হয়েছিল। তিনি প্রতিদিন বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার জন্য প্রেস কনফারেন্স করতেন। এক পর্যায়ে তিনি ভারত থেকে আফগানিস্তান এবং পরবর্তীতে ৭ দিন সড়কপথে ভ্রমণ করে ইরান পৌঁছান ইরানের শাহেনশাহ’র সমর্থন আদায়ের জন্য। প্রথমদিকে শাহেনশাহ’র সাথে স্বাক্ষাৎ করতে না পারলেও ইরানের প্রধানমন্ত্রীকে লেখা একটি চিঠি শাহেনশাহ’র কাছে পৌঁছায় যেটি তিনি সারারাত জেগে সতেরো পৃষ্ঠাজুড়ে লিখেছিলেন। সেই চিঠির বক্তব্য পড়ে শাহেনশাহ বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেন।

তাজউদ্দিন আহমেদের কন্যা শারমিন আহমেদ তার বক্তব্যে তাজউদ্দিন আহমেদের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং ব্যক্তিত্বের বর্ণনা করেন। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চে, পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর চোখ এড়িয়ে, দুর্গম যাত্রার সঙ্গী ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামের সঙ্গে ঢাকা ত্যাগ করার সময় রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া এক চিরকুটে তিনি তার স্ত্রী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে লিখেছিলেন–  ‘লিলি, আমি চলে গেলাম। যাবার সময় কিছুই বলে আসতে পারিনি। মাফ করে দিও। আবার কবে দেখা হবে জানি না... মুক্তির পর। তুমি ছেলেমেয়ে নিয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষের সাথে মিশে যেও।’ 

তাজউদ্দিন আহমেদ একটি টেবিলে, একটিমাত্র শার্ট গায়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর চালিয়ে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের আশংকা ছিলো চীন ভারতকে আক্রমণ করতে পারে। কিন্তু তাজউদ্দিন আহমেদ মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানির সহায়তায় পৃথিবীর সকল কমিউনিস্ট রাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আনতে কাজ করেন। 

ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামের কন্যা ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তাঁর স্মৃতি বর্ণনা করেন। যুদ্ধের সময় নয় মাস কী অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করেছে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার সহ সারা দেশের সকল মানুষ সে চিত্র তার বক্তব্য উঠে আসে।

অনুষ্ঠানের শেষে এমন একটি আয়োজনের জন্য ইয়ুথ পলিসি ফোরামকে আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ ধন্যবাদ জানান। উল্লেখ্য, ওয়াইপিএফ লুকিং ব্যাক এর এটি ছিলো দ্বিতীয় পর্ব। প্রথম পর্বে ইস্ট এশিয়ান মিরাকল নিয়ে আলোচনা হয়। পরবর্তী পর্বগুলি ইয়ুথ পলিসি ফোরামের ফেসবুক পেজে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে। এছাড়াও পূর্ববর্তী পর্বসমূহ ইয়ুথ পলিসি ফোরামের ইউটিউব চ্যানেলে পাওয়া যাবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন