দুই বছর ধরেই ঋণের জন্য হা-হুতাশ চলছে দেশের বেসরকারি খাতে। বৈশ্বিক মহামারীর প্রভাবে বিপদগ্রস্ত সেবরকারি খাতকে টেনে তুলতে যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে তার বাস্তবায়নও নির্ভর করছে ব্যাংকঋণের ওপর। এ অবস্থার মধ্যেও বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অপরিবর্তিত রেখে ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গত অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল তার সঙ্গে বিস্তর ফারাক অর্জনের। ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ঋণ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে মাত্র ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ। এ অবস্থায় বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কীভাবে, কোন পন্থায় বাড়ানো যাবে তার কোনো রূপরেখা পাওয়া যায়নি ঘোষিত মুদ্রানীতিতে। বরং নতুন মুদ্রানীতিতেও বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ১৪ দশমিক ৮ শতাংশে অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। অন্যদিকে সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪৪ দশমিক ৪ শতাংশ।
যেকোনো দেশের ব্যাংকঋণের ভিত্তি সুদ হলো ব্যাংক রেট। দীর্ঘ ১৭ বছর পর ব্যাংক রেটে পরিবর্তন আনল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ৫ শতাংশ সুদ থেকে এটিকে ৪ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের মুদ্রানীতি ঘোষণার পর এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ব্যাংক রেটে কাটছাঁটের এ তথ্য জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ব্যাংক রেট কমার কারণে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবেন সরকারি কর্মকর্তারা। কারণ সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ব্যাংক রেটে গৃহঋণের ব্যবস্থা করেছে সরকার। তারা এতদিন ৫ শতাংশ সুদে ব্যাংক থেকে ঋণ পেতেন। এখন ব্যাংক রেটের সুদ ১ শতাংশ কমানোর ফলে সরকারি কর্মকর্তাদের ঋণের সুদহারও কমে যাবে।
ব্যাংক রেট কমানোর কারণে সুদহার কমবে সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডেরও। চলতি অর্থবছরে দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে ৮৪ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার।
একই সঙ্গে কমানো হয়েছে নীতি সুদহারও। ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে রেপোর সুদহার নামানো হয়েছে ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশে। এক্ষেত্রে ছাড় দেয়া হয়েছে দশমিক ৫০ শতাংশ। আবার দশমিক ৭৫ শতাংশ কমানো হয়েছে রিভার্স রেপোর সুদ। এ সুদহার ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ৪৭ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, নীতি সুদহার কমানোয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে তারল্যের জোগান বাড়বে। এর সুবিধা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কম সুদে ঋণ নিতে পারবে ব্যাংকগুলো। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যেই উল্লেখ করা হয়েছে, বর্তমানে ব্যাংকগুলোর হাতে ১ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগযোগ্য তারল্য রয়েছে।
বিপুল পরিমাণ অতিরিক্ত তারল্য হাতে থাকার পরও কেন ব্যাংকগুলো বেসরকারি খাতে ঋণ দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না, তার বিষয়ে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি মুদ্রানীতিতে। আবার লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ঋণ বিতরণ না করলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নেয়া হবে, সে বিষয়েও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে ঘোষিত মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
মুদ্রানীতি ঘোষণা উপলক্ষে প্রতি বছরই সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। অনুষ্ঠানে মুদ্রানীতি ঘোষণার পাশাপাশি গণমাধ্যমকর্মীদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন গভর্নর। কিন্তু এবার একেবারেই ভিন্ন আবহে মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে গতকাল বিকালে মুদ্রানীতি ও গভর্নর ফজলে কবিরের লিখিত বক্তব্য আপলোড করা হয়।
গভর্নর তার লিখিত বক্তব্যে বলেন, ব্যাংক রেট, রেপো ও রিভার্স রেপোর সুদহার কমানোর ফলে ব্যাংকগুলোর ঋণ সক্ষমতা যথেষ্ট বৃদ্ধি পাবে। তবে এসব ঋণ যাতে উৎপাদনমুখী, কর্মসৃষ্টি-সহায়ক ও পরিবেশবান্ধব হয়, ব্যাংকগুলোকে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। অন্যথায় মূল্যস্ফীতি এবং খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিসহ অর্থনৈতিক নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
করোনাভাইরাসের কারণে দেশের অর্থনীতিতে নেমে আসা স্থবিরতা এখনো কাটিয়ে ওঠা যায়নি। বন্ধ রয়েছে দেশের শিক্ষা কার্যক্রমসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের উল্লেখযোগ্য অংশ। এর মধ্যেই দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে তীব্র হয়ে উঠেছে বন্যার প্রকোপ। এ দুই মিলিয়ে চলমান অর্থনৈতিক সংকট আরো ভয়াবহ হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ঘোষিত মুদ্রানীতি বাস্তবায়নে করোনা ও বন্যা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করছেন গভর্নর ফজলে কবিরও। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেছেন, ঘোষিত মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উভয় দিক থেকেই বেশ কিছু ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। কভিড-১৯-এর দীর্ঘসূত্রতা ও অনিশ্চয়তার কারণে দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম পুনরুদ্ধারের গতিপ্রকৃতি বাধাগ্রস্ত হতে পারে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক যেসব প্রণোদনা, ঋণ ও বিনিয়োগ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলো যথাযথভাবে উৎপাদন ও কর্মসৃষ্টি সহায়ক উপায়ে বাস্তবায়িত না হলে দেশে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিসহ অনাকাঙ্ক্ষিত মূল্যস্ফীতি সৃষ্টির সম্ভাবনাও রয়েছে। বৈশ্বিক চলমান অর্থনৈতিক মন্দার দীর্ঘসূত্রতার কারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে দেশের রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহে। এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশেষ করে চলমান বন্যার কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির শঙ্কাও রয়েছে। এসব ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা মোকাবেলায় বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় কর্মসূচি গ্রহণে সর্বদাই সচেষ্ট থাকবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন ফজলে কবির।
ঘোষিত মুদ্রানীতিকে গতানুগতিক ও কপি-পেস্ট বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, এ মুদ্রানীতি স্বাভাবিক সময়ের জন্য হলে মানা যায়, কিন্তু চলমান পরিস্থিতির সঙ্গে এটি একেবারেই মানানসই নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক করোনাসৃষ্ট অর্থনৈতিক দুর্যোগ থেকে অর্থনীতিকে টেনে তুলতে বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। মুদ্রানীতিতে সেগুলোর সবিস্তার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বোঝাতে চেয়েছে, তারা উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে নেই। এবারের বাজেটে আমরা হতাশ হয়েছিলাম, ঘোষিত মুদ্রানীতি সে হতাশার পূর্ণতা দিয়েছে।
সাবেক এ গভর্নরের মতে, বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ থমকে গেছে। কয়েক বছর ধরেই মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল থাকছে না। এবার বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৪ শতাংশের বেশি। অথচ বিশাল এ লক্ষ্যমাত্রা কীভাবে অর্জিত হবে, সে বিষয়ে কোনো রূপরেখা নেই। মুদ্রানীতিতে এসএমই, কৃষিসহ বিভিন্ন খাতে ঋণ বিতরণের জন্য ব্যাংকগুলোকে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে সেটি বাস্তবায়নের টাইমফ্রেম বেঁধে দেয়া যেত। লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হলে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে, সেটির বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য থাকতে পারত। কিন্তু সে ধরনের কিছু মুদ্রানীতিতে পাওয়া যায়নি। সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে ক্রমাগত ঋণ নিচ্ছে। এটিকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বেসরকারি খাতে ঋণ না দিয়ে সরকারকে ঋণ দিতে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে। আগামীতে এ প্রতিযোগিতা আরো বাড়বে। এতে বেসরকারি খাত বঞ্চিত ও উপেক্ষিতই থেকে যাবে।
ঘোষিত মুদ্রানীতিতে অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৯ দশমিক ৩ শতাংশ। এর মধ্যে ৪৪ দশমিক ৪ শতাংশ ধরা হয়েছে সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির বার্ষিক লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা ১১ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। রিজার্ভ মুদ্রার প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ।
ঘোষিত মুদ্রানীতিতে কী পেলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, মুদ্রানীতিতে রেপোর সুদহার দশমিক ৫০ শতাংশ কমানো হয়েছে। যদিও আমাদের দাবি ছিল রেপোর সুদহার ৪ শতাংশে নামিয়ে আনার। মুদ্রানীতিতে এ প্রাপ্তিটিকেই আমরা বড় করে দেখছি। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটি কতটুকু বাস্তবায়ন হবে সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। গত অর্থবছরে যেখানে এ ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ, সেখানে চলতি অর্থবছরে তা প্রায় দ্বিগুণে উন্নীত করা কঠিন।