তিন ধাপে বন্যার প্রভাব

সাত লাখেরও বেশি মানুষ জলবন্দি, মহামারীর শঙ্কা

জেসমিন মলি

চলতি বছর তিন ধাপের বন্যায় প্লাবিত হয়েছে ২১টি জেলার নিম্নাঞ্চল। বন্যার প্রভাবে জলবন্দি হয়ে পড়েছে এসব জেলার ৬৫৪টি ইউনিয়নের সাত লাখেরও বেশি মানুষ। বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়েছে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়নগুলোর ৪০ শতাংশেরও বেশি বাসিন্দা। বর্তমানে প্লাবিত এলাকাগুলোয় পানি কমতে শুরু করলে এসব এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে পানিবাহিত নানা রোগ দেখা দেয়ার পাশাপাশি খাদ্য সুপেয় পানির সংকট দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া গাদাগাদি করে একসঙ্গে অনেক মানুষ বসবাস করার কারণে বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব ছড়ানোরও আশঙ্কা রয়েছে।

সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা এনজিওগুলোকে নিয়ে গঠিতনিডস অ্যাসেসমেন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ (এনএডব্লিউজি) বাংলাদেশেরএক জরিপ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

জরিপে ২২ জুলাই পর্যন্ত সময়ের তথ্য ব্যবহার করা হয়। এতে বলা হয়, বন্যায় এখন পর্যন্ত ৯৩ জন প্রাণ হারিয়েছে, তাদের মধ্যে অধিকাংশেরই মৃত্যু হয়েছে পানিতে ডুবে। পানিতে ডুবে মারা যাওয়া মানুষের মধ্যে ৪১টি শিশুও রয়েছে।

প্রতিবেদনের ভাষ্যমতে, ২২ জুলাই পর্যন্ত দেশে বন্যাপ্লাবিত হয়েছে ১০২টি উপজেলার ৬৫৪টি ইউনিয়ন। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এসব এলাকার প্রায় ৩৩ লাখ বাসিন্দা। এর মধ্যে জলবন্দি অবস্থায় রয়েছে লাখ ৩১ হাজার ৯৫৮ জন।

কভিড-১৯ মহামারীর কারণে এবারের বন্যার প্রভাব অন্যবারের তুলনায় বেশি হবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, সেখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি নিয়মিত হাত ধোয়ার মতো করোনা প্রতিরোধী কার্যক্রম পালন করা এক অর্থে অসম্ভব।

এতে আরো বলা হয়, বাস্তুচ্যুত মানুষের আয়-উপার্জন এবং সামাজিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় প্লাবিত অঞ্চলের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নদীর পাড় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সাধারণত প্রতিবার বন্যার পর এসব অবকাঠামো পুনরুদ্ধারে তিন থেকে পাঁচ বছর সময় লাগে। তবে এবার পরপর কয়েকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এসব অবকাঠামো পুরোপুরি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে পরিস্থিতিতে আরো জটিল সময়সাপেক্ষ হয়ে উঠেছে চলমান করোনা মহামারীর প্রাদুর্ভাব।

প্রসঙ্গে এনএডব্লিউজি, বাংলাদেশের ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেটর জাফর ইকবাল বলেন, সরকারি তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এবং প্লাবিত ইউনিয়নগুলোর ছয়জন করে মানুষের সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। পরপর কয়েকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মানুষ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার পর্যাপ্ত সময় পায়নি। এছাড়া করোনা মহামারীর কারণেও বন্যায় মানুষের ভোগান্তি আরো বেড়েছে।

অন্যদিকে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনার সম্ভাব্য উপায় সম্পর্কে জানতে চাইলে কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সাসটেইনিবিলিটির গবেষক মোস্তফা কামাল (পলাশ) বলেন, বাংলাদেশে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেয়ার মতো দক্ষ জনবল নেই। একইভাবে আধুনিক যন্ত্রপাতিরও সংকট রয়েছে। কিন্তু প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে বন্যার পূর্বাভাসও আগে থেকেই বলা সম্ভব। আমাদের প্রযুক্তির এসব সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। তাহলে বন্যা বা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব হয়।

জরিপে বলা হয়েছে, প্লাবিত ইউনিয়নগুলোর ৭৩ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হয়েছে। ফলে রোগব্যাধি পুষ্টির অভাব মহামারীর ক্ষতকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। বন্যায় বাসস্থান ডুবে যাওয়ার পাশাপাশি গর্ভবতী নারী, কিশোরী, শিশু, বয়স্ক প্রতিবন্ধীদের সংকট আরো জটিল হয়ে উঠেছে। অবস্থায় তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে দীর্ঘস্থায়ী সংকট এবং লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতারও

আশঙ্কা রয়েছে।

জরিপে বলা হয়েছে, বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কৃষক মত্স্যজীবীরা। বর্তমান পরিস্থিতিতে ত্রাণের ওপর তাদের নির্ভরশীলতা খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কাকে জোরালো করে তুলতে পারে। তথ্য অনুসারে, ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়নগুলোর ৮০ শতাংশ মানুষ এরই মধ্যে বন্যার কারণে অনিয়মিত খাদ্য গ্রহণ খাদ্য প্রস্তুত করতে গিয়ে অসুবিধার সম্মুখীন হওয়ার কথা জানিয়েছেন।

জরিপে উঠে আসে, বন্যাপ্লাবিত অঞ্চলের বাসিন্দাদের ৮৭ শতাংশই এখন অনিশ্চয়তার শঙ্কার মধ্য দিয়ে রয়েছে। নিরাপত্তাহীনতা মনস্তাত্ত্বিক হতাশার মধ্যে রয়েছে ৬০ শতাংশ মানুষ, যা তাদের মধ্যে অসম্মানজনক কাজের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ারও শঙ্কা তৈরি করছে। বন্যায় স্কুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাজার ৯০২টি। করোনা মহামারীর কারণে এরই মধ্যে বিঘ্নিত হয়েছে সার্বিক শিক্ষা কার্যক্রম। বন্যার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে বিষয়টি হয়ে উঠেছে আরো অনিশ্চিত। ফলে সামনের দিনগুলোয় তাদের স্কুল ছাড়ার সম্ভাবনাও বাড়বে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারদের সঙ্গে নিয়ে জীবন-জীবিকার ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে সম্ভাব্য সব ধরনের সতর্কতা গ্রহণ করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ত্রাণ মন্ত্রণালয়। বন্যা উপদ্রুত অঞ্চলে মানবিক সহায়তার হিসেবে নগদ খাদ্য সহায়তা দেয়া হচ্ছে, যা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের পুনর্বাসন প্রচেষ্টায় কার্যকর হবে। জীবন-জীবিকার পুনরুদ্ধার পুনর্বাসনের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামো, বাঁধ, ঘরবাড়ি, সুপেয় পানির উৎস, স্যানিটেশন সুবিধা ইত্যাদি মেরামতের পাঁচ থেকে নয় মাসের পুনরুদ্ধার পুনর্গঠন প্রয়াস জরুরি বলে জরিপে উঠে এসেছে।

বিষয়ে জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোহসীন বণিক বার্তাকে বলেন, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব অঞ্চলে পুনর্বাসনের কাজ শুরু হবে। কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণে এরই মধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দুর্যোগের ক্ষতি আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন