সাতসতেরো

মস্তিষ্কের কারসাজি!

মো. আব্দুল হামিদ

একটা দৃশ্য কল্পনা করুন। জাহাজে টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিন যাচ্ছেন। সঙ্গে আপনার মা, স্ত্রী তিন বছরের কন্যা। আকস্মিক ঝড়ের কবলে পড়ে সেটা ডুবতে শুরু করল। সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও আপনি একটার বেশি লাইফ জ্যাকেট ম্যানেজ করতে পারলেন না। সাঁতারে পারদর্শী হওয়ায় নিজের পাশাপাশি একজনকে (মাছধরা নৌকাগুলো কাছে আসা পর্যন্ত) নিয়ে ভেসে থাকতে পারবেন। ভুল করলে নিজের জীবনও বিপন্ন হবে। সিদ্ধান্ত নিতে হবে খুব দ্রুত। এবার বলুন: আপনি কাকে বাঁচাতে চেষ্টা করবেন?

দুঃখিত, শুরুতেই আপনাকে এতটা মানসিক চাপ দেয়ার জন্য। তবে বাস্তবতা মাঝেমধ্যে এর চেয়েও কঠিনভাবে আমাদের জীবনে ধরা দেয়। কি বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে বলি...২০১৪ সালে পিনাক- লঞ্চডুবির দৃশ্য আমাদের মনোজগৎ ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল। মাত্র ৫৩ সেকেন্ডের সেই ভিডিওতে দেখা যায় এক বিশাল লঞ্চ কীভাবে পদ্মায় তলিয়ে যাচ্ছে। সে সময়ের এক ঘটনা আমাকে খুবই স্পর্শ করে।

ফরিদপুরের সালথা উপজেলার সাদী নামের এক ব্যক্তি সপরিবারে সেই লঞ্চে যাচ্ছিলেন। তার ভাষ্যে, ‘ডুবে যাওয়ার সময় দুই হাতে দুই সন্তানকে ধরে রাখি। আর স্ত্রীকে বলি আমার প্যান্টের বেল্ট ধরে রাখতে।একপর্যায়ে স্রোতের টানে তার হাত থেকে ছুটে যায় দুই ছেলে আরিফ এনাম, স্ত্রী শেফালীও হারিয়ে যায়। একটা স্পিডবোট তাকে তুলে নেয়। সব হারিয়ে তিনি বেঁচে যান (প্রথম আলো, আগস্ট ২০১৪) দৃশ্যটা কল্পনা করতেও কষ্ট হয়, তাই না

আমার বাবা জীবনের নানা বাস্তবতা বোঝাতে মাঝেমধ্যেই প্রাসঙ্গিক গল্প বলতেন। ছোটবেলায় ওসব খুব একটা বুঝতাম না। বরং মাঝেমধ্যে খেলা বাদ দিয়ে সেগুলো শুনতে হতো বলে বেশ মন খারাপ হতো। কিন্তু এখন জীবনকে যত ঘনিষ্ঠভাবে দেখছি, সেই গল্পগুলোর শিক্ষা খুব রুক্ষভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে। যাহোক, তেমন একটা গল্প বলি: একবার কয়েকজন বিজ্ঞানীর মনে প্রশ্ন জাগে, প্রাণিকুলের সদস্যরা প্রকৃতপক্ষে কাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে? ঠিক কতটা ভালোবাসে

আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে দুনিয়ায় মানুষ (বিশেষত মা) তার সন্তানকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে, তাই তো? কিন্তু তারা বিদ্যমান তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে প্রাথমিক সিদ্ধান্তে উপনীত হলো যে ক্যাঙ্গারু তার বাচ্চাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। অন্যতম যুক্তি ছিল: বাচ্চাকে সবসময় নিজের বুকের সাথে আঁকড়ে রাখে। সন্তান কখনো আক্রান্ত হলে নিজের জীবন থাকা পর্যন্ত তারা কোনো ছাড় দেয় না। এবার পরীক্ষা করার পালা সেই ভালোবাসা ঠিক কতটা গভীর।

দুপুর বেলা। বিশাল এক মরুভূমিতে এক মা ক্যাঙ্গারুকে (বুকের থলিতে) বাচ্চাসহ ছেড়ে দেয়া হলো। তপ্ত রোদ কিছুক্ষণের মধ্যেই তার কাছে অসহনীয় হয়ে উঠল। কোনো গাছে উঠে বা তার ছায়ায় একটু আশ্রয়ের জন্য সে এদিক-সেদিক ছুটতে থাকল। কিন্তু সেখানে তেমন কোনো সুযোগ ছিল না। ফলে একপর্যায়ে সে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিল। কিন্তু গা এলিয়ে দেবার সুযোগও নেই। মরুভূমির বালি তখন এতটাই উত্তপ্ত। শেষ পর্যায়ে নিজের বাচ্চাটাকে টান দিয়ে বুকের থলে থেকে বের করে পায়ের নিচে রাখল! বাচ্চার নিষ্প্রাণ দেহের ওপর দাঁড়িয়ে...বাঁচার শেষ চেষ্টাটা করল!

আমরা ভালোবাসার মানুষকে বলিপ্রাণের চেয়ে প্রিয়’—সত্যিই কি তাই? জীবনে যাদের তেমন নির্মম পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়নি, তাদের এমন কল্পনাবিলাস বেশ উপভোগ্য। এর পেছনে অবশ্য নাটক-সিনেমারও বড় ভূমিকা রয়েছে। একবার ভাবুন, টাইটানিক জাহাজডুবির মতো বিশাল এক দুর্ঘটনাকে ছাপিয়ে রোজ আর জ্যাকের প্রেম দর্শকের হূদয়ে গেঁথে গেল! অথচ মানুষের জীবন বড়ই কঠিন। নির্মম বাস্তবতা যখন সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন কল্পনা হাওয়ায় ভেসে যায়।   

অন্যভাবে দেখলে, পৃথিবীতে পদার্পণের সাথে সাথেই চিত্কার করে জানিয়েছিলাম, দুনিয়া জায়গাটা মোটেই আমাদের পছন্দ নয়। বরং এর আগে যেখানে (মাতৃগর্ভে) ছিলাম, সেটাই ঢের ভালো ছিল! বিস্ময়করভাবে এখন আবারসেই দুনিয়া’-কে ছেড়ে যেতে চাই না। কারণ কীমায়া। বিশেষত চারপাশের মানুষগুলোর মায়া। কিন্তু সেই মায়া প্রকৃতপক্ষে কতটা টেকসই?

রিজেন্ট সাহেদ যাদের মায়ায় ধরাকে সরা জ্ঞান করেছিল, আজ তারা কেউ কি পাশে আছে? যে ডা. সাবরিনা স্বামীর সাথে রোমান্টিক সম্পর্ক প্রমাণে প্রৌঢ় বয়সেও (১৮ বছর বয়সী সন্তানের মা) সোস্যাল মিডিয়ায় নিত্যনতুন যুগল ছবি আপলোড করত, বিপদ আঁচ করতে পেরে সে- কিন্তু দাম্পত্য কলহের গল্প প্রচার করতে শুরু করে। তাহলে এতদিন তারা যে রোমান্টিসিজম শো করত, তা কি তাদের করোনা টেস্ট রিপোর্টের মতোইফেকছিল?

তাদের ভালোবাসার দুর্দশা দেখে হয়তো আপনার হাসি পাচ্ছে। আড্ডা বা ফোনালাপে তাদের প্রসঙ্গে মুখরোচক গল্প করছেন। কিন্তু আপনার ভালোবাসা ঠিক কতটা টেকসই? যাদের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিচ্ছেন; ন্যায়-অন্যায় কেয়ার না করে রাত-দিন সম্পদ অর্জনে লিপ্ত রয়েছেন। কখনো যদি সত্যিই মারাত্মক পরিস্থিতির মুখোমুখি হন, তারা আপনাকে আঁকড়ে ধরে থাকবে তো? করোনা ঝড় কিন্তু অনেকেরই মুখোশ খুলে দিয়েছে। জানি না ঠিক কয়জন এমন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারবেন!

এভাবে বলছি কেন? কারণ দৈনন্দিন জীবনে আমরা সবাই নিজেকে সৎ, উদার বা মহান হিসেবে প্রকাশে সদাতত্পর থাকি। কিন্তু তা বহাল থাকে যতক্ষণ নিজের গায়ে আঁচড় না লাগে। নিষ্ঠুর বাস্তবতা সামনে এসে দাঁড়ালে আমরা খোলস ফেলে স্বরূপে আবির্ভূত হই। ন্যাশনাল জিওগ্রাফির এক মাইন্ড গেমে দর্শকদের রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়। ঘটনাটি ছিল রকম: এক রেললাইনের ওপর চারজন বসে গল্প করছে। সেদিকে এক ট্রেন প্রচণ্ড গতিতে ধেয়ে আসছে, তারা বেখেয়াল। ট্রেনের গতিপথ বদলে দেয়ার সুইচ আপনার হাতে। দেখলেন বিকল্প লাইনে এক ব্যক্তি আনমনে হেঁটে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আপনি কোন লাইনে ট্রেনটি চালাবেন?

সব উত্তরদাতা বলেছিলেন: চারজনকে বাঁচাতে, একজন যে লাইনে হাঁটছেসেদিকে ট্রেনের মুখ ঘুরিয়ে দেবেন। কিন্তু পরের প্রশ্নটা তাদের থমকে দেয়। বলা হলো: কিন্তু ভালো করে দেখে নিশ্চিত হলেনসেটা আপনার সন্তান! এবার কী করবেন? বিস্ময়করভাবে সবাই নিজেদের উত্তর বদলে ফেলেছিলেন! বলেছিলেন, চার কেন একশজনকে মারতে হলেও নিজের সন্তানকে বাঁচাবেন! বুঝতে পারছেন, আমরা কতক্ষণ সৎ নিরপেক্ষ থাকি? অন্যের সন্তানকে খুন করে কিংবা অসংখ্য মানুষকে বিপদে ফেলে নিজের পরিবারের জন্য সম্পদের পাহাড় গড়ার ব্যাখ্যা খুব সম্ভবত এই এক্সপেরিমেন্টের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। 

এক্ষেত্রে এক কৌতুক মনে পড়ছে। এক মহিলা ওষুধের দোকানে গিয়ে বলল, সায়ানাইড বিষ দিন। বিক্রয়কর্মী বললেন, সেটা দিয়ে আপনি কী করবেন? মহিলার স্পষ্ট জবাব, তার স্বামী অন্য নারীর সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়েছে। তাই তাকে বিষ খাইয়ে মারতে চান। দোকানদার বললেন, তিনি বিষ দিতে পারবেন না। কারণ এটা অন্যায়। তাছাড়া তদন্তে ধরা পড়লে তার লাইসেন্স বাতিল হবে, তাকে হয়রানির শিকার হতে হবে ইত্যাদি। তখন ভদ্রমহিলা ব্যাগ থেকে একটা ছবি বের করে লোকটাকে দেখালেন। সেই মহিলার স্বামী আসলে দোকানদারের স্ত্রীর সাথেই পরকীয়ায় লিপ্ত ছিল। তখন তিনি মৃদু হেসে বললেন: আগে বলবেন না যে আপনার কাছে প্রেসক্রিপশন রয়েছে!

তাই চারপাশের মানুষগুলোর ভালো আচরণ, উদারতা কিংবা মহত্ত্ব প্রকাশ ততক্ষণ জারি থাকে যতক্ষণ তাদের স্বার্থে সরাসরি আঘাত না লাগে। কিন্তু যে স্বার্থের লাগি এতটা নীচতা, সেগুলোর ঠিক কতটুকু আমরা ভোগ করতে পারি? অনেকে এটা ভেবে তৃপ্ত হন যে আমার সন্তানেরা বা পরিবার সেটা ভোগ করবে। কিন্তু বলুন তো, আপনার দাদার বাবার নাম কী? লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই, আমরা অধিকাংশই জানি না। অথচ অনেকেই তার অর্জিত সম্পদ ভোগ করছেন! তাহলে এটাও ধরে নিন যে আপনার সন্তানের নাতি আপনার নামটাও জানবে না! তাহলে কার জন্য এমন সম্পদের পাহাড় গড়ার চেষ্টা?

শওকত ওসমানেরদুই মুসাফিরগল্পটা আমাকে বেশ ভাবায়। যে ব্যক্তি জীবদ্দশায় পাগলের মতো সম্পদ অর্জনের পেছনে ছুটেছে, বহু বছর পর তার ফিরে আসায় উত্তরসূরিরা তাকে আপদ ভেবেছে। ওইসব সম্পদ তার বলে উল্লেখ করায় পাগলের প্রলাপ ভেবে তাকে মারতে উদ্যত হয়েছে। অথচ মানুষের জন্য ভালোবাসা বিলানো লালন ফকির ফিরে এলে সবাই তার গুণের প্রশংসা করেছে! আমরা ক্ষুদ্র এই জীবনে অমর হতে চাই। কিন্তু বড় ভুল পদ্ধতিতে। অনেকটা কবি কায়কোবাদের ভাষায়হীরা ফেলে কাঁচ তুলে ভিখারী সেজেছি আমি মতো!     

ছোটবেলানিজাম খুনিযাত্রা দেখেছিলাম। মাত্র একটি প্রশ্ন ডাকাত নিজামের জীবন বদলে দেয়। তা হলোতুমি যাদের জন্য হত্যা-লুণ্ঠন করছ, তারা এই পাপের ভাগ নেবে তো? পরিবারের সদস্যদের কাছে গিয়ে একে একে সবাইকে সেটা জিজ্ঞাসা করে। তখন তার ওপর নির্ভরশীল প্রত্যেকে তার অপকর্মের ভাগ নিতে অস্বীকার করে! তারা বলে, আমরা কি তোমাকে ডাকাতি করতে বলেছি? এই জবাব শুনে তার বোধোদয় হয় এবং সব অপকর্ম ত্যাগ করে। তাহলে আমরা যারা সাগর ডাকাতি (পুকুরচুরি বললে তাদের কীর্তিকে খাটো করা হয়) করে, যাদের সুখের জন্য সর্বাত্মক ঝুঁকি নিয়ে সম্পদ উপার্জন পাচার করছি, তারা ঝামেলায় পড়লে ঘনিষ্ঠরা ঝেড়ে ফেলবে না তার গ্যারান্টি কী?

আগে মানুষ অন্যায় করত অভাবে, এখন করে স্বভাবে। মানুষ দুঃসময়ে সৃষ্টিকর্তাকে বেশি বেশি স্মরণ করে, সুখের সময় দিব্যি ভুলে থাকে। খারাপ সময়ে অসংখ্য সীমাবদ্ধতা কিংবা অসামঞ্জস্যকেও সহজে গ্রহণ করা যায়। রুটির সাথে শুধু লবণ মেখেও দিনের পর দিন খাওয়া যায় (সৈয়দ মুজতবা আলীরদেশে-বিদেশেদ্রষ্টব্য) কিন্তু সুসময়ে তরকারিতে লবণের সামান্য হেরফের হলে সেটা আর সহ্য করা যায় না!

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক গবেষণায় দেখা গেছে, রোদ ঝলমলে দিনে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে যায়! অথচ তীব্র তুষারপাতের সময় সেটা হওয়া যৌক্তিক ছিল। কিন্তু তা হয় না। কারণ মানুষ প্রতিকূল পরিবেশে অনেক বেশি সতর্ক থাকে। আর উষ্ণতায় হয়ে ওঠে বেপরোয়া। তাই সুখে থাকলে, সম্পদশালী হলেবেশি সতর্ক হোন। কারণ আমাদের মস্তিষ্ক কখন কোন কারসাজি করে তা বোঝা সত্যিই মুশকিল!

 

মো. আব্দুল হামিদ: শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন