বিজিএমইএর জরিপ

পোশাক খাতে সক্ষমতার ৫৬ শতাংশ ব্যবহার হচ্ছে

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশে কভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হওয়ার পর ব্যাপকহারে ক্রয়াদেশ হারাতে থাকে দেশের তৈরি পোশাক খাত। নতুন ক্রয়াদেশ না পাওয়ার পাশাপাশি পুরনোগুলোও বাতিল ও স্থগিত হতে থাকে। তবে ক্রয়াদেশের এ খরা কাটতে শুরু করেছে সম্প্রতি। পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর এক জরিপ বলছে, বর্তমানে বিদেশী ক্রেতাদের দেয়া যে পরিমাণ ক্রয়াদেশ আছে তাতে কারখানাগুলোর মোট সক্ষমতার ৫৬ শতাংশ নিশ্চিতভাবেই ব্যবহার করা যাচ্ছে। যদিও জরিপের এ তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্লেষক ও শ্রমিক প্রতিনিধিরা।

করোনাকালে তৈরি পোশাক খাতের রফতানি আদেশ বা বুকিং, উৎপাদন সক্ষমতা ও রফতানি পণ্যের মূল্যের মতো বিষয়গুলো জানতে সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে এ জরিপ পরিচালনা করেছে বিজিএমইএ। জরিপে অংশগ্রহণকারী ১০০ জন সদস্য জানিয়েছেন, চলতি বছরের শুধু জুলাইয়ের জন্য যে ক্রয়াদেশ আছে, তাতে মোট উৎপাদন সক্ষমতার ৫৬ শতাংশ ব্যবহার করা যাবে। তবে বছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য (জুলাই-ডিসেম্বর) এখন পর্যন্ত যে ক্রয়াদেশ আছে, তাতে মোট উৎপাদন সক্ষমতার ৩৫ শতাংশ ব্যবহার করা যাবে।

বর্তমান ক্রয়াদেশগুলোতে পোশাকের মূল্যহার যাচাই-বাছাইয়ে দেখা গেছে, ২০১৯ সালের জুলাই-ডিসেম্বরের তুলনায় চলতি বছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের ক্রয়াদেশে পোশাকের মূল্য কমেছে গড়ে ১৪ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মূল্য কমেছে মেনস আন্ডারগার্মেন্টসের, ৪৩ শতাংশ। একইভাবে বেবিস গার্মেন্টসের মূল্য কমেছে ৩৫ শতাংশ। একমাত্র নিটেড বটমের মূল্য বেড়েছে বিদ্যমান ক্রয়াদেশে। এক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশ।

বিজিএমইএ বলছে, চলতি বছরের ১-২২ জুলাই সময়ে পোশাক রফতানি ১৯৭ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। গত বছরের এ সময়ে রফতানির পরিমাণ ছিল ২১৫ কোটি ডলার। অর্থাৎ আলোচ্য ২২ দিনে রফতানি কমেছে ৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ। রফতানি যে খুব একটা কমেনি, এটা শিল্পের জন্য ভালো লক্ষণ ও আশাব্যঞ্জক।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে সংগৃহীত পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে বিজিএমইএ জানিয়েছে, চলতি জুলাইয়ের ২২ দিনে বাংলাদেশ থেকে বিশ্ববাজারে পোশাক রফতানি হয়েছে ১৯৭ কোটি ডলারের, যা গত ২০১৯ সালের জুলাইয়ের ২২ দিনের তুলনায় ৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ কম। অর্থাৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৫৬ শতাংশ ব্যবহার করেই গত বছরের একই সময়ের চেয়ে মাত্র প্রায় ২০ কোটি ডলারের কম পোশাক রফতানি করতে পেরেছে বাংলাদেশের পোশাক রফতানিকারক সক্রিয় কারখানাগুলো।

বিজিএমইএর জরিপ ও ফলাফল তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, জরিপের ফল বিশ্লেষণে ধারণা করা যাচ্ছে যে দেশের পোশাক কারখানাগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। কারণ সক্ষমতার মাত্র ৫৬ শতাংশ ব্যবহার করে এ করোনাকালেও গত বছরের একই সময়ের চেয়ে মাত্র ৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ রফতানি কম।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বণিক বার্তাকে বলেন, অতিরিক্ত সক্ষমতা ও অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতার মতো বিষয়ে আলোচনাটা পরের। এ জরিপের হিসাবই মিলছে না। সাম্প্রতিককালে গার্মেন্টস খাত নিয়ে আরেকটা গবেষণা হয়েছে, যেখানে বিজিএমইএ-বিকেএমইএ সদস্য মিলিয়ে নমুনা কারখানার সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৭১১। সেখানে জুনের তথ্যেই বলা হচ্ছে, সক্ষমতার ব্যবহার গড়ে ৭০ দশমিক ৬ শতাংশ। সেটার সঙ্গে বর্তমান জরিপের তথ্যের আকাশ-পাতাল তফাৎ। উপরন্তু দেখা গেছে, ৮০ শতাংশ সক্ষমতার ব্যবহার হচ্ছে ৩৩ শতাংশ কারখানায়। ৫০ শতাংশের ওপরে সক্ষমতা ব্যবহারের হার হলো ৭১ শতাংশ কারখানার। বিজিএমইএ বর্তমান জরিপের ফলই খুবই অল্পসংখ্যক নমুনার ওপর ভিত্তি করে বলা। এর আগে আরো বেশিসংখ্যক নমুনা ব্যবহার করে যে তথ্য পাওয়া গেছে, তার সঙ্গে পার্থক্য অনেক বেশি। ফলে বিজিএমইএর তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। দ্বিতীয়ত, সক্ষমতা ব্যবহারের যে হার বলা হচ্ছে তার বিপরীতে রফতানি কমেছে ৮ শতাংশ। এটা সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী একটা চিত্র দিচ্ছে। জুলাই মাসে সক্ষমতা ব্যবহারের হার এবং রফতানির যে প্রবৃদ্ধি তাতে ব্যাপক অসামঞ্জস্যতা দেখা যাচ্ছে।

বিজিএমইএর জরিপকে সরকারের পক্ষ থেকে সুবিধা আদায়ের কৌশলের অংশ মনে করছেন শ্রমিক প্রতিনিধিরা। তাদের দাবি, শিল্পটির বিকাশই হয়েছে সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তায়। শিল্প বড় হলেও সরকারি সহায়তা আদায় কমেনি বরং বাড়ছে। পরিস্থিতিকে পুঁজি করে করোনার আগে থেকেই নানা কৌশল-সুবিধা আদায় অব্যাহত ছিল। এ জরিপ ও তার ফলাফলও তেমনই কৌশল। কারণ করোনার শুরু থেকে সুবিধা আদায় অব্যাহত থাকলেও কারখানা বন্ধ ও লে-অফের নামে শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ হয়নি। ক্ষেত্রবিশেষে পরিস্থিতির বিচারে প্রাপ্যের তুলনায় অনেক বেশি বঞ্চিত করা হয়েছে শ্রমিকদের।

সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, পোশাক শিল্প মালিকরা সরকারের কাছ থেকে নানা সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে এসব কৌশল অব্যাহত রেখেছেন। জরিপের ফলাফলও বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। সক্ষমতা যদি পুরোটা ব্যবহার না করা যায়, তাহলে শ্রমিককে দিয়ে ওভারটাইম কাজ করাতে আইনের ধারা থেকে অব্যাহতি নেয়ার কী প্রয়োজন পড়ে, সেটা পরিষ্কার না। সরকারের থেকে ঋণ সুবিধা নেয়া অব্যাহত থাকলেও শ্রমিক ছাঁটাইও যেমন চলছে, তেমনি তাদের টার্মিনেশন বেনিফিট থেকেও বঞ্চিত করা হচ্ছে। করোনাকালেও মালিকপক্ষের এমন আচরণ গ্রহণযোগ্য না। তাই নীতিনির্ধারকদের উচিত হবে শুধু মালিকদেরই টাকা না দিয়ে করোনাকালে শ্রমিকের কর্মসংস্থান সুরক্ষার বিষয়ে মনোযোগী হওয়া। সুষ্ঠু ট্রেড ইউনিয়ন চর্চা নিশ্চিত করতে পারলে এ ধরনের বঞ্চনা থেকে শ্রমিকদের মুক্ত করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

প্রসঙ্গত, করোনা প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশে ৮ মার্চ শনাক্ত হওয়ার পর ২৫ মার্চ রফতানিমুখী শিল্প খাতের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার। সেই ঘোষণা অনুযায়ী গত এপ্রিল থেকে জুলাই এ চার মাসে রফতানিমুখী কারখানার শ্রমিকদের বেতন পরিশোধে সরকারের তরফ থেকে স্বল্প সুদহারের প্রণোদনা বাবদ সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ বা বিনিয়োগ সুবিধা দেয়া হয়েছে।

এরপর গত ১৬ জুলাই একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর ধারা ৩২৪-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার জনস্বার্থে ১৭ এপ্রিল ২০২০ তারিখ থেকে পরবর্তী ছয় মাসের জন্য শতভাগ রফতানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পকে আইনের ধারা প্রয়োগ থেকে শর্তসাপেক্ষে অব্যাহতি প্রদান করল।

প্রজ্ঞাপনের শর্তাবলির মধ্যে প্রথমেই আছে অতিরিক্ত সময় কাজের জন্য প্রচলিত বিধান অনুযায়ী স্বাভাবিক হারের দ্বিগুণ হারে ভাতা প্রদান করতে হবে। কোনো শ্রমিক দ্বারা তার সম্মতি ছাড়া কোনো কার্যদিবসে অতিরিক্ত ৪ ঘণ্টার বেশি সময় কাজ করানো যাবে না। প্রত্যেক শ্রমিককে পর্যায়ক্রমে প্রতি সপ্তাহে একদিন করে সাপ্তাহিক ছুটি প্রদান করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন