সম্প্রসারিত বহর নিয়ে বিপাকে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস

মনজুরুল ইসলাম

নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে চলতি বছরের মার্চ থেকে একে একে বন্ধ হয়ে যায় বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আকাশপথে যোগাযোগ। বর্তমানে সীমিত আকারে কিছু দেশের সঙ্গে ফ্লাইট চললেও তাতেও রয়েছে নানা শর্তের বেড়াজাল। ফলে লাভজনক আন্তর্জাতিক রুটগুলোতে সহসাই বাণিজ্যিক ফ্লাইট চালু করা সম্ভব হচ্ছে না দেশীয় এয়ারলাইনসগুলোর পক্ষে। আবার অভ্যন্তরীণ রুটে চলমান ফ্লাইটগুলোতেও নেই কাঙ্ক্ষিত যাত্রী। অবস্থায় সম্প্রসারিত বহর নিয়ে এক রকম বিপাকেই পড়েছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস।

ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে তাদের বহরে উড়োজাহাজ রয়েছে ১৩টি। এর মধ্যে ১৬৪ আসনের চারটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০, ছয়টি ৭২ আসনের ব্র্যান্ড নিউ এটিআর ৭২-৬০০ এবং তিনটি ৭৬ আসনের ড্যাশ -কিউ৪০০ উড়োজাহাজ। বহরে থাকা উড়োজাহাজগুলোর মধ্যে কেবল তিনটি ড্যাশ -কিউ৪০০ কিনেছিল ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস। বাকি ১০টি উড়োজাহাজই লিজে আনা। সাধারণত লিজে আনা প্রতিটি ব্র্যান্ড নিউ এটিআর ৭২-৬০০ উড়োজাহাজের জন্য প্রতি মাসে গড়ে লাখ ডলার এবং বোয়িং ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজের জন্য লাখ ডলার ভাড়া পরিশোধ করতে হয়। সে হিসেবে ফ্লাইট চলুক আর না চলুক লিজে আনা ১০টি উড়োজাহাজের জন্য ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসকে প্রতি মাসে ভাড়া পরিশোধ করতে হচ্ছে প্রায় ২৪ লাখ ডলার।

অন্যদিকে বহরে সুপরিসর চারটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজ থাকলেও ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের ফ্লাইট কার্যক্রম চলছে মূলত অভ্যন্তরীণ রুটকে কেন্দ্র করেই। এয়ারলাইনসটি বর্তমানে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে প্রতিদিন পাঁচটি, সৈয়দপুরে চারটি, যশোরে চারটি, সিলেটে দুটি, রাজশাহীতে দুটি বরিশালে দুটি ফ্লাইট পরিচালনা করছে। আর আন্তর্জাতিক রুটে চালু আছে কেবল গুয়াংজুর ফ্লাইট। তাও আবার সপ্তাহে মাত্র একটি। করোনার কারণে বন্ধ রয়েছে কলকাতা, চেন্নাই, মাস্কাট, দোহা, কুয়ালালামপুর, সিঙ্গাপুর ব্যাংকক রুটের ফ্লাইট। ভেস্তে গেছে আবুধাবি, জেদ্দা, রিয়াদ, দাম্মাম, দুবাই, হংকং দিল্লি রুটে ফ্লাইট চালুর পরিকল্পনাও।

ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের মহাব্যবস্থাপক (মার্কেটিং সাপোর্ট অ্যান্ড পিআর) কামরুল ইসলাম প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, শুধু ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসই নয়, করোনার কারণে সংকটে পড়েছে পুরো এভিয়েশন খাতই। ফ্লাইট না থাকায় বহরের উড়োজাহাজগুলোকে বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। কিন্তু মাস শেষে লিজের ভাড়া ঠিকই দিতে হচ্ছে। বোয়িং উড়োজাহাজগুলো ব্যবহার করে পর্যন্ত ৫০টির বেশি চার্টার্ড ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়েছে। তবে থেকে যা আয় হয়েছে সেটা খুবই নগণ্য।

তিনি বলেন, গত কয়েক মাসে বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলো সরকারের কাছে বিভিন্ন ফি মওকুফের জন্য আবেদন করেছিল। এর মধ্যে রয়েছে অ্যারোনটিক্যাল, নন-অ্যারোনটিক্যাল চার্জ (যেমন ল্যান্ডিং, পার্কিং, নিরাপত্তা, নেভিগেশন) এসব চার্জ আগামী পাঁচ বছরের জন্য মওকুফ করার আবেদন করার পাশাপাশি বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একাধিক বৈঠকও হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায়নি সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো থেকে। এছাড়া জ্বালানি তেলের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্যও আবেদন করা হয়েছে। কারণ জেট ফুয়েলের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মূল্যে তারতম্য রয়েছে। ফলে বিদেশী এয়ারলাইনসগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকা কঠিন হয়ে যায়।

চলতি বছরের মধ্যে আরো ১০টি ব্র্যান্ড নিউ এটিআর ৭২-৬০০ উড়োজাহাজ বহরে যুক্ত করার পরিকল্পনা ছিল ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের। যেগুলো দিয়ে অভ্যন্তরীণ কানেক্টিভিটি বাড়ানোর ঘোষণা ছিল তাদের। বর্তমানে অভ্যন্তরীণ রুটগুলো চলছে ঢাকাকে কেন্দ্র করে। ইউএস-বাংলার পরিকল্পনা ছিল বহরে ১০টি এটিআর যুক্ত করে বছরের মধ্যে সিলেট, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, যশোর সৈয়দপুরসহ বিভিন্ন রুটে কানেক্টিং ফ্লাইট চালু করার। তবে করোনার কারণে ভেস্তে গেছে সব পরিকল্পনা। অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রী না থাকায় বিদ্যমান উড়োজাহাজগুলোরও পূর্ণ ব্যবহার করতে পারছে না তারা।

নিয়মিত বাণিজ্যিক ফ্লাইট না থাকায় যাত্রীবাহী এয়ারলাইনসগুলোকে গত মে মাস থেকে কার্গো পরিবহনের অনুমতি দিয়েছে বেবিচক। করোনা পরিস্থিতি বিবেচনা করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য চিকিৎসাসামগ্রী পরিবহনের জন্য দেশীয় এয়ারলাইনস হেলিকপ্টার প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি বিদেশী যাত্রীবাহী এয়ারলাইনসগুলোও সুবিধা নিতে পারবে। এয়ারলাইনসগুলোর জন্য কার্গো পরিবহনের গাইডলাইনও তৈরি করেছে বেবিচক। যার ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গন্তব্যে কার্গো ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করেছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস। এরই মধ্যে ঢাকা থেকে ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, কলকাতা, গুয়াংজুসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গন্তব্যে কার্গো পরিবহন করেছে এয়ারলাইনসটি। বহরের বোয়িং ৭৩৭-৮০০ এয়ারক্রাফটে প্রায় ২০ টন কার্গো পরিবহন করতে পারে এযারলাইনসটি। কার্গো পরিবহনে যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি আছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস সেসব দেশে কার্গো পরিবহন করতে পারবে। তবে এটিও ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসকে রাজস্ব আয়ে খুব বেশি আশা দেখাচ্ছে না।

সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন বণিক বার্তাকে বলেন, ফ্লাইট না চললেও ব্যাংকের কিস্তি, উড়োজাহাজের রক্ষণাবেক্ষণ, বিভিন্ন কর, সিভিল এভিয়েশনের নানা চার্জ, বিদেশের কার্যালয়ের খরচ কর্মীদের বেতন ঠিকই পরিশোধ করতে হচ্ছে। অবস্থায় সরকারের সহায়তা না পেলে বন্ধের ঝুঁকিতে পড়বে এয়ারলাইনসগুলো। দেশীয় এয়ারলাইনস বন্ধ হলে খাতের বহু কর্মী চাকরি হারাবেন। পাশাপাশি বিদেশী এয়ারলাইনসের দখলে চলে যাবে দেশের এভিয়েশন খাতের বাজার। এতে দেশ যেমন রাজস্ব হারাবে, তেমনি উচ্চমূল্যে টিকিট কাটতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রবাসী বাংলাদেশীরা। তিনি বলেন, করোনার কারণে এয়ারলাইনসগুলো দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মধ্যে পড়লেও এখন পর্যন্ত সরকার থেকে কোনো সহায়তা পাওয়া যায়নি। যদিও বিশ্বের অনেক দেশই এয়ারলাইনসগুলোর জন্য বিভিন্ন প্রণোদনা দিয়ে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করছে।

উল্লেখ্য, করোনার কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান চেয়ে গত এপ্রিলে বেসামরিক বিমান পরিবহন পর্যটন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিল ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস। সব উড়োজাহাজ হেলিকপ্টারের যাবতীয় নেভিগেশন, ল্যান্ডিং পার্কিং চার্জ পাঁচ বছরের জন্য মওকুফ করা; প্রণোদনাস্বরূপ এভিয়েশন শিল্পকে আগামী ১০ বছরের জন্য বিবিধ আয়কর ভ্যাট অব্যাহতি প্রদান; অভ্যন্তরীণ আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক হারের জ্বালানি মূল্য ধার্যকরণ; যন্ত্রাংশ আমদানি পর্যায়েআগাম করঅব্যাহতি, বকেয়া পরিশোধের ক্ষেত্রে লেট ফি অন্যান্য দেশের মতো বার্ষিক - শতাংশ হারে ধার্য করা; বাংলাদেশী এয়ারলাইনস আন্তর্জাতিক রুটে চলাচল করলেও তাদের উড়োজাহাজগুলোর ল্যান্ডিং, পার্কিং নেভিগেশন চার্জ অভ্যন্তরীণ রুটের হারে ধার্য করার আবেদন জানানো হয়েছিল ওই চিঠিতে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন