নতুন বিশ্ববাস্তবতায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য এবং সম্ভাব্য সংস্কার

ফাইয়াজ কবির

বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে আগামী বছর। ‘সুবর্ণজয়ন্তী’ সামনে রেখে ‘তারুণ্যের সাথে, সংস্কারের পথে’ প্রতিপাদ্যকে সঙ্গী করে দেশের বিভিন্ন খাতে নীতিনির্ধারণে গবেষণালব্ধ সংস্কার প্রস্তাবনাগুলোকে নীতিনির্ধারকদের সামনে তুলে ধরতে তরুণ প্রজন্মের নীতি গবেষণামূলক প্লাটফর্ম ‘ইয়ুথ পলিসি ফোরাম (ওয়াইপিএফ)’ আয়োজন করেছে ‘ওয়াইপিএফ রোড টু রিফর্মস’ শীর্ষক সেমিনার সিরিজ, যার প্রথম পর্বটি অনুষ্ঠিত হয়েছে।

বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট (বিইআই) ও ইয়ুথ পলিসি ফোরামের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত প্যানেলটির মূল আলোচ্য বিষয় ছিল করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে সৃষ্ট নতুন বিশ্ববাস্তবতার সাথে মিলিয়ে চলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য এবং সম্ভাব্য সংস্কারগুলো নিয়ে। আলোচনায় মূল অতিথি ছিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। অনুষ্ঠানটির অন্যান্য বক্তার মধ্যে ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রদূত ও বিইআইয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হুমায়ুন কবির, অর্থনীতিবিদ ও ওয়াইপিএফের উপদেষ্টা ড. আখতার মাহমুদ এবং সঞ্চালনায় ছিলেন বিইআইয়ের প্রধান নির্বাহী ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ফারুক সোবহান।

আলোচনার শুরুতেই কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিকে ঘিরে গবেষণা টিমের পর্যবেক্ষণ এবং ওয়াইপিএফের তরুণ সদস্যদের সংস্কার প্রস্তাবগুলো আলোচকদের সামনে তুলে ধরেন সংগঠনটির দুজন তরুণ প্রতিনিধি হাসনাত কালাম সুহান ও মিনহাজ চৌধুরী। তাদের আলোচনায় উঠে আসে রোহিঙ্গা সংকট, বিশ্ব জলবায়ু সংকট, জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য নতুন বাজার সম্প্রসারণ, বৈদেশিক বিনিয়োগের সম্ভাবনা, বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর সাথে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নসহ আরো নানা বিষয়। সংস্কার প্রস্তাবনায় সীমান্তে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধে সমন্বিত উদ্যোগ, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আসিয়ানের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন, প্রবাসী শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে অধিকার আদায়ে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ এবং ডিজিটাল ডিপ্লোম্যাসির বিস্তারসহ আরো নানা বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয় সংগঠনটির পক্ষ থেকে।

এরপর বক্তব্য রাখেন অনুষ্ঠানটির মূল অতিথি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। বক্তব্যের শুরুতেই মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির প্রশংসা করে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে দ্রুততার সাথে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে কাজ করা হয়েছে, সেটি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির জন্য একটি মাইলফলক। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও ভারতের সাথে সাম্প্রতিক সম্পর্কের উদাহরণ দিয়ে শাহরিয়ার আলম বলেন, বিশ্বের সব দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে সরকার এবং বাংলাদেশ বিশ্বের যেকোনো চলমান সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়।’

সীমান্তে হত্যাকে অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয় আখ্যা দিয়ে এটি বন্ধে সীমান্তে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার সীমিতকরণের লক্ষ্যে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে আলোচনা হচ্ছে বলে জানান তিনি। এছাড়া আসিয়ান ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মতো আঞ্চলিক ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর সাথে সম্পর্ক স্থাপন, বিশ্ব জলবায়ু সংকট নিরসন ও প্রবাসী শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে বাংলাদেশের অবস্থান, করোনা প্রাদুর্ভাবের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পু্নর্গঠনে সরকারে নেয়া নানা পদক্ষেপের ব্যাপারে কথা বলেন তিনি। 

সেমিনারে উপস্থিত বিইআইয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হুমায়ুন কবির তার বক্তব্যের শুরুতে বলেন, ‘জন্মলগ্ন থেকেই আমরা জাতি হিসেবে একটি কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত। কিন্তু তার পরও আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অভ্যন্তরীণ ইতিহাস সম্পর্কে যতটা জানি, বহির্বিশ্বের সমর্থন আদায়ের ইতিহাস ততটা জানি না। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি মূলত দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়। একটি হলো আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও দেশের আত্মসম্মান সমুন্নত রাখা। দ্বিতীয়ত, বহির্বিশ্বের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের মাধ্যমে দেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করা।’

বিশ্বনিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত সাংগঠনিক কাঠামোগুলোর (জাতিসংঘ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা) দৃশ্যমান দুর্বলতা, বিশ্বজুড়ে ক্রমাগত উগ্রপন্থার উত্থান, দক্ষিণ এশিয়াকে ঘিরে বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর আঞ্চলিক স্নায়ুযুদ্ধ এবং দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের উত্থানকে বর্তমানে বাংলাদেশ পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেছেন হুমায়ুন কবির। কোভিড-১৯-পরবর্তী অর্থনীতির নতুন ধারা নিয়ে তিনি আলোকপাত করে বলেন, ‘এ পরিস্থিতে চিকিত্সা সামগ্রী ও তত্সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়াদি সামাল দিতে গিয়ে অনেকগুলো সম্পর্কের যোগসূত্র তৈরি হয়েছে এরই মধ্যে (যেমন জাপান ও চীনের সম্পর্ক )। এটি নতুন করে একটি আঞ্চলিক বাণিজ্যের দ্বার উন্মোচন করতে পারে।’ এছাড়া কোভিড-১৯ বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী করতে পারে, যা দেশের রফতানি খাতের জন্য হুমকিস্বরূপ বলে মনে করেন তিনি। এক্ষেত্রে দেশের পররাষ্ট্রনীতে বৈচিত্র্যময়তা আনা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির লক্ষ্যে আসিয়ান ডায়ালগ ও আরসিপিতে যোগদান এবং ডিজিটাল ডিপ্লোম্যাসির বিস্তারের ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেন হুমায়ুন কবির। 

‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’ পররাষ্ট্রনীতিটি অত্যন্ত মহান এবং আদর্শিক হলেও বর্তমান বাস্তবতায় এ আদর্শ প্রয়োগ করা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং বলে মত প্রকাশ করেন ওয়াইপিএফের সম্মানিত উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. আখতার মাহমুদের। তার মতে, এ জটিল বাস্তবতায় রাষ্ট্রগুলোর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য রক্ষা করা বাংলাদেশ পররাষ্ট্রনীতির জন্য একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। এ ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দেশের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র নীতিনির্ধারণে সমন্বয় থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। 

আখতার মাহমুদ আরো বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদারের পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরে বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়াতে কাজ করে যাচ্ছে। তবে সেক্ষেত্রে সেসব সম্ভাবনাময় বৈদেশিক বিনিয়োগের সুযোগ কতটুকু আমরা কাজে লাগাতে পারছি সেটি একটি বড় প্রশ্ন।’ বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ও অভ্যন্তরীণ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের (যেমন—জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ব্যাংক) মধ্যকার সমন্বয় নিশ্চিত করা অতি জরুরি বলে মত দেন তিনি। 

অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে চীন-ভারত চলমান দ্বন্দ্ব থেকে বাংলাদেশ কীভাবে লাভবান হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘চীন-ভারত উভয়েই আমাদের বন্ধু। দুটি দেশের মধ্যেই বেশ কয়েক দশক ধরে বৈরিতা লক্ষ করা যাচ্ছে। তবে সম্প্রতি তারা নিজেদের মধ্যকার সংকট সমাধানে রাষ্ট্রপ্রধান পর্যায়ের বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে এবং অন্যান্য যেকোনো সময়ের মতোই চীন-ভারত সাম্প্রতিক সংকটকে বাংলাদেশ খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং দ্রুত এর একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান আশা করছে।’ এছাড়া বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার ব্যাপারে বিডার সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার এবং একটি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করার লক্ষ্য নিয়েই বিডা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।’ এ ব্যাপারে জাপানের বিনিয়োগ ও বাণিজ্য প্রচারণা সংগঠন জাপান এক্সটারনাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেটরো) উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে আমরা কিছু উল্লেখযোগ্য সফলতাও পেয়েছি।’ তবে সামনের দিকে সফলতার মাত্রা আরো বাড়বে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি। সর্বশেষ চলমান করোনাভাইরাস সংকট কাটিয়ে এসডিজি-২০৩০ ও ভিশন-২০৪১ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন শাহরিয়ার আলম। অন্যদিকে বৈদেশিক বিনিয়োগের ব্যাপারে বাংলাদেশের আরো প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান নেয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ফারুক সোবহান। তিনি বলেন, ‘এটি করতে না পারলে চীন থেকে বিনিয়োগ স্থানান্তরের যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে তা বাস্তবায়ন হবে না ।’

অনুষ্ঠানের শেষে পর্যায়ে তিন প্রজন্মের নীতিনির্ধারকদের একই মঞ্চে নিয়ে আসার জন্য ইয়ুথ পলিসি ফোরামের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।

উল্লেখ্য, ‘YPF Road to Reforms’ সিরিজের প্রতিটি পর্ব ওয়াইপিএফের ফেসবুক পেজ Youth Policy Forum ও ইউটিউব চ্যানেলে প্রচারিত হয়। আয়োজনের মিডিয়া পার্টনার বণিক বার্তা।

লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন