করোনার প্রভাব

দুঃসময় পার করছেন সুতা ও কাপড় উৎপাদকরা

বদরুল আলম

বস্ত্র খাতে দেশের অন্যতম বৃহৎ সুতা রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান ম্যাকসন্স স্পিনিং মিলস লিমিটেড। স্বাভাবিক সময়ে প্রতিষ্ঠানটি মাসে ৫০ লাখ ডলারের ঋণপত্র পায়। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে তা অর্ধেকে নেমে এসেছে। চলতি বছরের জুনে প্রতিষ্ঠানটি ঋণপত্র পেয়েছে ২৩ লাখ ডলারের। আর জুলাই মাস শেষে সব মিলিয়ে ২৫ লাখ ডলারের ঋণপত্র পাওয়ার আশা করছে প্রতিষ্ঠানটি।

শুধু ম্যাকসন্স নয়, রফতানি ক্রয়াদেশ পাওয়ার ক্ষেত্রে দুঃসময় পার করছে পোশাক শিল্পের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ সুতা-কাপড় উৎপাদনকারী অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও। ছোট-বড় সব মিলেরই একই অবস্থা। রফতানি কমে যাওয়ায় উৎপাদন সক্ষমতা বিচারে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকেই বেশি সমস্যায় পড়তে হচ্ছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।

তারা বলছেন, ৫০ শতাংশ কম রফতানি আদেশ নিয়ে বর্তমান দুঃসময় পার করছে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো। কবে এই সংকট কাটবে তার কোনো পূর্বাভাস নেই। যদিও আগামী সেপ্টেম্বর মাস থেকে পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে শুরু করবে বলে আশাবাদী রফতানিকারকরা।

দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ হিসেবে পরিচিত প্রাইমারি টেক্সটাইল খাতে সুতা কাপড়ের উৎপাদক প্রতিষ্ঠান আছে হাজার ২৩২টি। এছাড়া কাপড় প্রক্রিয়াজাত করার ডায়িং-প্রিন্টিং-ফিনিশিং মিল আছে আরো ২৪৪টি। এই মিলগুলো দেশের রফতানিমুখী নিট পোশাক কারখানাগুলোর প্রয়োজনীয় সুতার ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ সরবরাহ করে। আর রফতানিমুখী ওভেন পোশাক পণ্যের চাহিদার প্রায় ৪০ শতাংশ সরবরাহ করার সক্ষমতা রাখে। শিল্পে মোট বিনিয়োগ ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি। কিন্তু করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদানির্ভর পোশাক খাতের পাশাপাশি বস্ত্র খাতের উদ্যোক্তারাও ক্রয়াদেশ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন।

বস্ত্র খাতের শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) দাবি, শিল্পের বড়-ছোট সব ধরনের প্রতিষ্ঠানই এখন দুর্দিন পার করছে। সংগঠনটির প্রতিনিধিরা বলছেন, সবচেয়ে বেশি সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে বড়দের। এই বড়রা কারা জানতে চাইলে ২০১৯ সালে সবচেয়ে বেশি রফতানি করেছে এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম পাওয়া যায় সংগঠন থেকে। আর এসব প্রতিষ্ঠান মালিকদের কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারাও রফতানি মন্দার কথা বলেন।

বিটিএমএর হিসাবে ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি সুতা রফতানি করেছে এমন শীর্ষ দশ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রথম অবস্থানে আছে বাদশা টেক্সটাইলস লিমিটেড। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে স্কয়ার টেক্সটাইলস লিমিটেড। তৃতীয় অবস্থানে থাকা প্রতিষ্ঠানটি হলো কামাল ইয়ার্ন লিমিটেড। চতুর্থ থেকে দশম অবস্থানে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে যথাক্রমে পাহাড়তলি টেক্সটাইল অ্যান্ড হোসিয়ারি মিলস, এনআরজি স্পিনিং মিলস লিমিটেড, সিআরসি টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড, ম্যাকসন্স স্পিনিং মিলস লিমিটেড, মোশারফ কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড, এনজেড টেক্সটাইল লিমিটেড এবং তমিজুদ্দিন টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড।

সুতা রফতানিকারকদের মধ্যে অন্যতম বৃহৎ প্রতিষ্ঠান ম্যাকসন্স স্পিনিং মিলস লিমিটেড। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানটির স্পিন্ডল সক্ষমতা এক লাখেরও বেশি। প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক সুতা উৎপাদন সক্ষমতা কোটি লাখ ৫০ হাজার কেজি। ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি ছিল দেশের সপ্তম শীর্ষ সুতা রফতানিকারক।

ম্যাকসন্স স্পিনিং মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বণিক বার্তাকে বলেন, আমার প্রতিষ্ঠানের পরিস্থিতি মূল্যায়নে বলা যায়, রফতানি ৫০ শতাংশ কমেছে। মার্চে বিপুল পরিমাণ ক্রয়াদেশ ছিল কারখানায়। মে মাসে ক্রয়াদেশ পাওয়া গেছে স্বাভাবিক সময়ের ৩০ শতাংশ, যা জুনে ৪০-৪৫ শতাংশে উন্নীত হয়। চলতি মাসের আরো নয়দিন বাকি থাকলেও এখন পর্যন্ত যে ক্রয়াদেশ এসেছে তা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় প্রায় ৪০ শতাংশ কম। গত বছর এপ্রিল-মে-জুনের সঙ্গে তুলনায় চলতি বছরে এপ্রিল-মে-জুনে ক্রয়াদেশ কমেছে গড়ে প্রায় ৫৫ শতাংশ

গোটা শিল্পের গড় ধরলে ক্রয়াদেশ ৫০ শতাংশ কমেছে বলে দাবি করে মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, আশা করছি সেপ্টেম্বর থেকে রফতানি আবারো বাড়তে শুরু করবে। আগামী বছরের শুরু থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। এখন বড়-ছোট সবার ক্রয়াদেশই কম। কারখানার আকার ক্রয়াদেশ বিবেচনায় বড়দের বিপদ আরো বেশি। করোনার প্রাদুর্ভাব না বাড়লে ডিসেম্বর নাগাদ স্বাভাবিক পরিমাণে ক্রয়াদেশ পাওয়া সম্ভব হবে বলে প্রত্যাশা করছি।

বিটিএমএর তথ্যমতে, দেশ থেকে কাপড় রফতানির শীর্ষে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে শাশা ডেনিমস লিমিটেড, নাইস ডেনিম মিলস লিমিটেড, হা-মীম ডেনিম লিমিটেড, এনভয় টেক্সটাইলস লিমিটেড, প্যারামাউন্ট টেক্সটাইল লিমিটেড, এনজেড ফ্যাব্রিকস লিমিটেড, সিস্টার ডেনিম কম্পোজিট লিমিটেড, স্কয়ার ডেনিমস লিমিটেড, আম্বার ডেনিম মিলস লিমিটেড এবং আর্গন ডেনিমস লিমিটেড।

দেশের অন্যতম বৃহৎ পোশাক রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান হা-মীম গ্রুপ। এই গ্রুপেরই একটি প্রতিষ্ঠান হা-মীম ডেনিম। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি প্রতি মাসে ৫০ লাখ মিটার কাপড় উৎপাদনের সক্ষমতা রাখে। ২০১৯ সালে হা-মীম ডেনিম ছিল দেশের তৃতীয় শীর্ষ কাপড় রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে তাদেরও রফতানি অর্ধেকে নেমে এসেছে।

হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে আজাদ বণিক বার্তাকে বলেন, ফ্যাব্রিক রফতানি ৫০ শতাংশ কমেছে। শিল্প গড় হিসাব করলেও বলা যায় যে সুতা-কাপড়ের রফতানি অর্ধেক কমে গেছে।

দেশে কাপড় রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে শাশা ডেনিমস লিমিটেড। ১৯৯৬ সালের অক্টোবরে স্থাপিত এই প্রতিষ্ঠানের বর্তমান বার্ষিক কাপড় উৎপাদন সক্ষমতা কোটি ১৬ লাখ গজ। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত শতভাগ রফতানিমুখী প্রতিষ্ঠানটির রফতানিও অর্ধেকে নেমে এসেছে বর্তমানে।

শাশা ডেনিমস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস মাহমুদ বলেন, এপ্রিল থেকে জুন হিসাব করলে রফতানি প্রায় ৫০ শতাংশ কমেছে। রফতানি এখন আবার বাড়তে শুরু করেছে। কিন্তু সমস্যায় পড়তে হচ্ছে পণ্যের মূল্য নিয়ে। ক্রয়াদেশ ধরার অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতায় পণ্যের মূল্য অনেক কমে গেছে।

শতভাগ রফতানিমুখী এনভয় টেক্সটাইলসের বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৮ সালে। প্রতি মাসে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন সক্ষমতা ৪৫ লাখ গজ কাপড়ের। ২০০৮ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় প্রতিষ্ঠানটি। পরিবেশবান্ধব ডেনিম উৎপাদন সক্ষমতা রাখা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বৈশ্বিক স্বীকৃতির প্রথম দাবিদার প্রতিষ্ঠানও রফতানিতে দুঃসময় পার করছে এখন।

এনভয় গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সংসদ সদস্য আবদুস সালাম মুর্শেদী বণিক বার্তাকে বলেন, শিল্পের ক্রয়াদেশ সংকটের চিত্রটি বাস্তবতা। আমরা যখন করোনায় আক্রান্ত হয়েছি তারও আগেই সুতা-কাপড়ের ক্রয়াদেশগুলো দেয়া হয়েছিল। করোনার প্রভাবে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ মিলগুলোর বিপদ হলো পণ্যের দাম নিয়ে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পণ্যের মূল্য পরিশোধে অনেক বিলম্ব হবে। আবার ডিসকাউন্টও আছে। বিশ্ববাজার সংকুচিত হলে আমাদের ক্রয়াদেশ কমবে, এটাই স্বাভাবিক। আশা করছি, সেপ্টেম্বর থেকে ক্রয়াদেশ বাড়তে শুরু করবে। আরো একটি সমস্যা হলো আমাদের এখানে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় যেভাবে বাড়ছে, তাতে করে চীন-ভারতে বাংলাদেশের চেয়ে কম মূল্যে সুতা-কাপড় পাওয়া যাবে।

 

বিটিএমএ বলছে, দেশের সব শিল্প খাতের উৎপাদন কার্যক্রমই কার্যত স্থবির হয়ে পরেছে। বড়, শ্রমঘন বৈশ্বিক সরবরাহ চক্রের সঙ্গে যুক্ত থাকায় উৎপাদন নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিপাকে রয়েছে বস্ত্র পোশাক শিল্প। একদিকে পশ্চিমা ক্রেতারা ক্রয়াদেশ বাতিল করছেন, অন্যদিকে কারখানায় ক্রমেই করোনা ভীতির ব্যাপ্তি ঘটছে। সব মিলিয়ে শিল্পের স্থবিরতা কতদিন দীর্ঘায়িত হবে তাও অনুধাবন করতে পারছেন না কোনো শিল্পোদ্যাক্তাই। তাই সরকারের কাছে চিঠির মাধ্যমে বেইলআউট প্যাকেজও দাবি জানিয়েছিলেন তারা। গত ২২ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব . আহমদ কায়কাউসকে চিঠি পাঠায় বিটিএমএ।

গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের উহানে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ার পর পরই ধাক্কা লাগে দেশের তৈরি পোশাক বস্ত্র খাতে। প্রথম ধাক্কাটি আসে চীন থেকে শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে। তবে অল্প কিছুদিনের মধ্যে কেটে যাওয়ার পর বড় ধাক্কাটা আসে রফতানিতে। তৈরি পোশাকের প্রধান রফতানি গন্তব্য আমেরিকা ইউরোপের দেশগুলোয় চাহিদা পতন হওয়ায় ব্যাপক হারে রফতানি আদেশ হারাতে থাকে পোশাক খাত। 

দেশের পোশাক শিল্প মালিক সংগঠন বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, গত ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের মোট হাজার ১৫০ কারখানার ৩১৮ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি ক্রয়াদেশ বাতিল-স্থগিত হয়েছে। এর মধ্যে অনেক ক্রয়াদেশ ক্রেতারা পুনরায় ফিরিয়ে দিচ্ছেন বলেও সাম্প্রতিক সময়ে বলতে শুরু করেছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ হিসেবে এই পোশাকের বেশির ভাগ সুতা কাপড়ের ক্রয়াদেশ দিয়ে দেয়া হলেও পরে সেগুলো বাতিল স্থগিত করতে হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন