পশু উদ্বৃত্তের মধ্যেও ১১ মাসে ৫৭ লাখ কেজি মাংস আমদানি

সাইদ শাহীন

দেশে মাংসের জন্য পশু উৎপাদন কয়েক বছর ধরেই ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। কোরবানিতেও এখন চাহিদার শতভাগ পূরণ হচ্ছে দেশের উৎপাদিত পশু দিয়ে। এর মধ্যে আবার কভিড-১৯-এর কারণে চলতি বছর চাহিদা কমে যাওয়ায় উদ্বৃত্ত হতে যাচ্ছে পশুর সংখ্যা। ফলে খামারিদের লোকসানে পড়ার শঙ্কাও এখন অনেক বেশি। এর পরও থেমে নেই দেশে মাংস আমদানি। পরিসংখ্যান বলছে, গত ১১ মাসে প্রায় ৫৭ লাখ কেজি মাংস আমদানি হয়েছে বাংলাদেশে।

চট্টগ্রাম বন্দর কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, গত অর্থবছরের জুলাইয়ে দেশে মাংস ওফালস (যকৃৎ, ফুসফুসসহ অনান্য) আমদানির পরিমাণ ছিল লাখ ৪৭ হাজার কেজি। এরপর গত অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয়েছে ডিসেম্বরে লাখ ৪০ হাজার কেজি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লাখ হাজার কেজি মাংস আমদানি হয়েছে অক্টোবরে। এছাড়া আগস্টে লাখ ৯১ হাজার কেজি, সেপ্টেম্বরে লাখ ৫৯ হাজার, নভেম্বরে লাখ ৩৬ হাজার জানুয়ারিতে লাখ ৫৯ হাজার কেজি মাংস আমদানি হয়েছে। এরপর ফেব্রুয়ারির পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে মার্চে লাখ ১১ হাজার কেজি, এপ্রিলে লাখ ২৫ হাজার, মে মাসে ১০ লাখ ৪৫ হাজার জুনে প্রায় ২৫০ কেজি মাংস আমদানি হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় লাখ ১৬ হাজার কেজি মাংস আমদানি হয়েছে দেশে। এসব মাংসের প্রধান উৎস ভারত। কোনো ধরনের উন্নত পরীক্ষা ছাড়াই এসব মাংস প্রবেশ করেছে দেশে। ফলে এতে করে এক ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিতেও পড়ছে দেশের মানুষ।

অনিয়ন্ত্রিত মাংস আমদানিতে দেশের পশুসম্পদ খাত বিশেষ করে খামারিদের উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। উপরন্তু এটিকে দেশের পশু সম্পদ খাতের বিকাশের অন্তরায় হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ মাংস আমদানি না হলে স্থানীয় চাহিদা মেটানোর জন্য প্রতি মাসে পশুর প্রয়োজন হতো পাঁচ হাজারের বেশি। মাংস আমদানির কারণে এসব পশুর চাহিদা কমে গেছে।

বিষয়ে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) মহাব্যবস্থাপক প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞ . শরীফ আহমেদ চৌধুরী বলেন, একটি গরু উৎপাদন থেকে ভোক্তার কাছে মাংস পৌঁছাতে ১০ জন মানুষের কর্মসংস্থান হয়। কর্মসংস্থানটি মূলত সমাজের প্রান্তিক গ্রামীণ পর্যায়ে হয়ে থাকে। ফলে আমদানি অবারিত রাখলে তা তরুণ উদ্যোক্তাসহ এসব মানুষের দারিদ্র্যকে আরো প্রকট করে তুলবে। এখন ডাম্পিং প্রাইসে বাংলাদেশে এসব মাংস প্রবেশ করছে। ফলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে আমদানি মাংসের কম দাম। কিন্তু মাংসে আমরা আমদানিনির্ভর হলে তাদের প্রকৃত রূপ দেখা যাবে। হিমায়িত মাংস আমদানিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য বাংলাদেশে উন্নত মানের পরীক্ষাগার নেই। ফলে ভোক্তারাও বিরাট স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে প্রাণিসম্পদ খাতও। আবার আমদানির কারণে খামার বন্ধ হয়ে পড়লে কৃষিতেও জৈব সারের সংকট দেখা দেবে। খাদ্য নিরাপত্তা হুমকি পড়বে। চামড়া শিল্প বিরাট সংকটে পড়বে। আমদানি বন্ধ করতে না পারলে দেশের প্রায় চার কোটি মানুষ ক্ষতির শিকার হবে।

বিষয়ে দেশের অন্যতম বৃহৎ গরু পালনকারী খামার সাদিক অ্যাগ্রোর স্বত্বাধিকারী মো. শাহ এমরান বণিক বার্তাকে বলেন, বিদেশ থেকে মাংস আনা হলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ধস নামার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর হবে। তাতে দেশের অন্যতম রফতানি খাত চামড়া শিল্পে কাঁচামালের সংকট দেখা দেয়ার পাশাপাশি দুগ্ধ উৎপাদন শিল্প বাধাগ্রস্ত হবে। তাছাড়া খাতে নিয়োজিত ৭০ লাখ তরুণ খামারি হুমকিতে পড়বেন। শিক্ষিত তরুণরা ইদানীং গবাদিপশুর খামার গড়ে তুলেছেন। ভালো লাভ পাওয়ায় সাধারণ কৃষকরাও গরু-ছাগল লালন-পালন বাড়িয়ে দিয়েছেন। করোনায় গত কয়েক মাসের অবিক্রীত গরু-ছাগলও এবার কোরবানির ঈদে যুক্ত হবে। করোনা পরিস্থিতি চলতে থাকলে হাটেও ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগম কম হতে পারে। আর্থিক মন্দা, করোনার স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিসহ নানা কারণে অন্যান্য বারের চেয়ে এবার কোরবানি কম হবে। তাই উদ্বৃত্ত পশু থাকবে। ফলে সব ধরনের মাংস আমদানি নিষিদ্ধ করতে এখনই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

জানা গেছে, কোনো ধরনের হিমায়িত মাংস বা প্রক্রিয়াজাত মাংস আমদানি অনুমোদন না দেয়ার জন্য এরই মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছে মত্স্য প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পুরোপুরি নিষিদ্ধ না করলেও আমদানিকে নিরুৎসাহিত করতে উদ্যোগী হচ্ছে বলে জানা গিয়েছে।

সংকটকে গভীর করে তুলতে পারে কোরবানির পশুর চাহিদা পতন: প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে কোরবানির জন্য মজুদ রয়েছে কোটি ১৮ লাখ ৯৭ হাজার ৫০০টি গবাদিপশু। এর মধ্যে কোরবানি হতে পারে সর্বোচ্চ কোটি ১০ লাখ। এবারের কোরবানিতে পশুর চাহিদা বিক্রি নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে খামারিদের। পাঁচ মাসেরও বেশি সময় ধরে কোরবানির জন্য পশু হূষ্টপুষ্ট করেছেন দেশের খামারিরা। মহামারীর কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এবার চাহিদা না বেড়ে উল্টো ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে বলে মনে করছেন একুশে পদক প্রাপ্ত কৃষি অর্থনীতিবিদ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক . জাহাঙ্গীর আলম।

তিনি বলেন, গত বছর কোরবানিতে বিক্রীত কোটি ১১ লাখ গবাদিপশুর বাজারমূল্য ছিল প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা। প্রতি বছর কোরবানিতে প্রায় ১০ শতাংশ হারে পশুর চাহিদা বাড়ে। সে হিসেবে এবার কোরবানির জন্য পশুর চাহিদা হতে পারে কোটি ২০ লাখের মতো। কিন্তু করোনাকালে মানুষের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ কম। অনেকের আয় কমে গেছে। চাকরিচ্যুত হয়েছেন অনেকে। তাতে হ্রাস পেয়েছে ক্রয়ক্ষমতা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে কোরবানির পশুরহাটে যাওয়া, পশু কেনা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এবার আর্থিক সংকটের কারণে শরিকে কোরবানির সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। যিনি একটি গরু কোরবানির কথা ভাবছিলেন, তিনি হয়তো ভাগে; যিনি একাধিক ভাগে কোরবানির কথা ভাবছিলেন, তিনি হয়তো একভাগে কোরবানি দেবেন। আবার যিনি একভাগের কথা ভাবছিলেন তিনি হয়তো কোরবানি দেয়া থেকে সরে দাঁড়াতে পারেন, যে কারণে এবার পশুর চাহিদা কম হতে পারে ২০ শতাংশ। বড়জোর এক কোটি গবাদিপশুর কার্যকর চাহিদা সৃষ্টি হতে পারে এবারের কোরবানির ঈদে। তার বিপরীতে এবার পশুর জোগান থাকবে প্রায় কোটি ১৯ লাখ। ফলে উদ্বৃত্ত পশুর বিষয়ে কী করণীয় হবে সেটি নিয়ে ভাবতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন