কর্মসংস্থান ও সামাজিক সুরক্ষায় চাই সম্মিলিত এবং সুসংহত কর্মকৌশল

ড. রিজওয়ানুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সাবেক বিশেষ উপদেষ্টা। অধ্যাপনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। একই প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি গ্রহণ শেষে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস থেকে পিএইচডি অর্জন করেন। উন্নয়ন অর্থনীতি তার গবেষণার প্রধান বিষয়। তিনি কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য অর্থনৈতিক সংকটের মতো বিষয় নিয়ে কাজ করেন। তার রচিত (একক যুগ্মভাবে এবং সংকলিত) বইয়ের সংখ্যা ১৪। বিশ্বের প্রথম শ্রেণীর গবেষণামূলক সাময়িকী বিভিন্ন গ্রন্থে তার উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গবেষণামূলক রচনা প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি বণিক বার্তার সঙ্গে কভিড পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে শ্রমবাজারের পরিবর্তিত অবস্থা, অর্থনীতিতে প্রভাব, উত্তরণের কর্মকৌশলসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা

 কভিডের কারণে বাংলাদেশের শ্রমবাজারে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটতে দেখছেন? ভবিষ্যতে আরো কী ধরনের পরিবর্তন যোগ হতে পারে?

কভিডের কারণে সারা পৃথিবীতেই বড় ধরনের সংকট চলছে। কভিডের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যে ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে, তারই অভিঘাত পড়ছে অর্থনীতির ওপরে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হলে কর্মসংস্থানের ওপর তার প্রভাব পড়বে, যা সাধারণ বিষয়। বৈশ্বিক অর্থনীতি সংকটের মধ্যে আছে। সংকটে রয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতিও। অবস্থায় কর্মসংস্থানের বিষয়কে দুই ভাগে ভাগ করে দেখা যেতে পারে। একটা হচ্ছে যে তাত্ক্ষণিক কী অবস্থা হয়েছিল? হয়েছিল বলছি কারণে, আমাদের দেশে কভিডের সংকট মোকাবেলা করার জন্য চলতি বছর মার্চের শেষ সপ্তাহেই ব্যবস্থা নেয়া হয়। সারা দেশে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। তারপর এপ্রিল থেকে শুরু করে মে মাসের কিছুটা সময় পর্যন্ত জনজীবন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় সবই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমি এটাকে বলি তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। কিন্তু তারপর যখন অর্থনীতি, জনজীবন পুনরায় চালুর চেষ্টা করা হলো, তখন থেকে ভিন্ন একটি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তখন থেকে আমরা অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। অবস্থা কতদিন চলতে থাকবে, তা বলা মুশকিল। আমি গোটা বিষয়কে এই দুই পর্যায়ে ভাগ করেছি।

 বিভিন্ন গবেষণা বলছে যে তিন মাসের মধ্যে বেকারত্বের সংখ্যা বেড়ে গেছে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

আমাদের দেশে শ্রমবাজার সম্পর্কে তথ্য খুব কম এবং হালনাগাদ তথ্য বলতে গেলে নেই-ই। শ্রমবাজারের ওপর শেষ জরিপ করা হয় ২০১৬-১৭ সালে। সুতরাং এখন যে ধরনের হিসাব করা হচ্ছে বা বেকারত্বের যে সংখ্যার কথা বলা হচ্ছে, কে কী বলছেন, সেদিকে বিস্তারিত না গিয়ে আমি এটুকু বলতে পারি যে সবই অনুমান করা হিসাব, বাস্তব জরিপভিত্তিক নয়। সরকারি সংস্থা কোনো সংখ্যা নিয়ে আসছে না, বলছে না যে এটা হয়েছে। অন্যদের মতো আমিও কিছু হিসাব করেছি। আমার হিসাব, এরই মধ্যে যেমনটি উল্লেখ করেছি, দুই পর্যায়ের জন্য আলাদা। আলাদা আলাদাভাবে। এপ্রিল-মে মাসের অবস্থা এখন আর নেই। এখন কিছু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু হয়েছে, শ্রমবাজার কাজ করছে। কিছু অনুমানের ভিত্তিতে আমি এপ্রিলের জন্য হিসাব করেছিলাম যে এক কোটিরও বেশি লোক কর্মহীন হয়ে পড়েছে। কিন্তু এখন কিছু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু হওয়ার ফলে আগের সে অবস্থাটা নেই। আমরা যদি সবসময় বলতে থাকি যে এক কোটি লোক বেকার হয়েছে, তা বোধহয় ঠিক হবে না। আমি দ্বিতীয় একটা হিসাবও করেছি। ২০১৯-২০ সালের সার্বিক অবস্থার কথা চিন্তা করে কিছু অনুমানের ভিত্তিতে আমি হিসাব করে বের করেছি যে অন্তত ৫০ লাখ মানুষ নতুন করে কর্মহীন হয়ে পড়েছে। বিষয়টি  দুই পর্যায়ে দেখতে হবে। প্রথম পর্যায়ে এক কোটির মতো মানুষ কর্মহীন এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে অর্থাৎ বর্তমানে যখন কিছু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু হয়েছে তখন কর্মহীনের সংখ্যাটা অন্য রকম।

 সাধারণ ছুটি তুলে নিয়ে স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার কথা বলা হলেও তার পরও তো অর্থনীতি থমকে থাকছে। আমরা যদি কভিড পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারি তাহলে এখন যেমন চলছে, কর্মসংস্থানের ওপর তার ভবিষ্যৎ প্রভাব কী হতে পারে?

সরকারের সদিচ্ছার তো কোনো অভাব নেই। যে কথাটা আপনি বললেন, জীবন জীবিকার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে নীতিমালা গ্রহণ করা হচ্ছে যেন জীবিকা একেবারে থমকে না যায়। কিন্তু আমরা যতই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, স্বাভাবিক জীবনযাত্রা আবার চালু করে দিতে চেষ্টা করি, বাস্তবে তা হচ্ছে না। আমরা চাইলেই মানুষ দোকান, রেস্তোরাঁয় যাচ্ছে না, ভ্রমণে উৎসাহী হচ্ছে না। এই যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে কিন্তু মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ও আছে। মানুষের মধ্যে একটা ভীতির সৃষ্টি হয়েছে। এটা একটা দিক। অন্য দিক হচ্ছে মানুষের আয়, কর্মসংস্থান নিয়ে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হলে মানুষ কিন্তু অর্থ ব্যয়ে অনাগ্রহী হয়। মানুষ যদি ব্যয় না করে তাহলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিকভাবে চলতে পারে না। সুতরাং আমি যতই চেষ্টা করি যে দুটোই পাশাপাশি চালিয়ে যাব, তা কিছুটা ব্যাহত হতে বাধ্য। যতদিন ধরনের অবস্থা চলতে থাকবে ততদিনই এর প্রতিক্রিয়া অভিঘাত শ্রমবাজারে পড়তে থাকবে।

 কভিড পরিস্থিতি দীর্ঘমেয়াদি হলে শ্রমবাজারের অবস্থা আরো খারাপ হবে?

হতে পারে। ভাইরাসের আক্রমণ এবং এর প্রভাবে স্বাস্থ্যগত যে অবস্থা, তা চলতে থাকলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারে না। এছাড়া আমাদের গোটা বিশ্ব পরিস্থিতিও দেখতে হবে। বৈশ্বিক অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা এবং আগামী কয়েক মাস বা বছরখানেকের কথা চিন্তা করতে আমাদের তাকাতে হবে বিভিন্ন ধরনের আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কী ধরনের পূর্বাভাস দিচ্ছে তার দিকে। আইএমএফ দুটো পূর্বাভাস দিয়েছে। তাদের সর্বশেষ পূর্বাভাসে পরিস্থিতি যে খারাপের দিকে যাচ্ছে, তা উল্লেখ করা হয়েছে। গত জুনে দেয়া আইএমএফের সর্বশেষ পূর্বাভাস বলছে, বিশ্বের উৎপাদনের নেতিবাচক হার হবে দশমিক শতাংশ। যেখানে এপ্রিলে বলা হয়েছিল শতাংশ। বিভিন্ন পূর্বাভাস অনুসারে, পুরো বছর ধরেই ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি অর্থাৎ উৎপাদন কমে যাওয়ার ধারা চলতে থাকবে। ২০২১ সালের আগে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির ধারা পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই। আমাদের অর্থনীতি তো বৈশ্বিক অর্থনীতি থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। আমাদের বড় ধরনের অভ্যন্তরীণ চাহিদা, অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি আছে। তবে আমরা আবার বৈদেশিক চাহিদার ওপরও অনেকাংশে নির্ভরশীল। সুতরাং আমার মনে হয় না, আগামী ছয় মাসে বড় রকমের কোনো উন্নতি আমরা আমাদের অর্থনীতিতে দেখতে পাব।

 অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আগে থেকেই আশানুরূপভাবে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছিল না। নতুন করে করোনা পরিস্থিতি যোগ হওয়ায় বিষয়টি কতটা নেতিবাচক অবস্থার দিকে যাবে বলে মনে করেন?

আমাদের দেশে উচ্চহারে প্রবৃদ্ধি হলেও সে অনুপাতে কর্মসংস্থানের হার বাড়ছে তো না-, বরং কমে যাচ্ছে। সুতরাং বলা যায়, আমাদের দেশে এক ধরনের কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। একেবারেই কর্মসংস্থান হচ্ছে না, তা কিন্তু নয়। আক্ষরিক অর্থে কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধির অর্থ কিন্তু একেবারেই কর্মসংস্থান হচ্ছে না, তা নয়। তবে তুলনামূলক হারটা কম এবং আরো কমে যাচ্ছে, যা ঘটছিল কভিড-পূর্ববর্তী অবস্থাতেই। অর্থাৎ সাধারণ অবস্থাতেই। এখন যেখানে উৎপাদন বৃদ্ধির হার কমছে, শ্রমবাজারের অবস্থা আরো খারাপ হচ্ছে, সেখানে কর্মসংস্থানের অবস্থা, বেকারত্বের হার কিংবা কর্মহীনতার হার অনেকটা খারাপ হবে। তবে বাংলাদেশের মতো দেশে বেকারত্বের হারে অবস্থার যথাযথ প্রতিফলন ঘটে না। কারণ বেকারত্বের একটা সংজ্ঞা আছে। যেখানে কোনো সামাজিক সুরক্ষা নেই, যেখানে তিন থেকে সাতদিনের বেশি কোনো মানুষ আয় না করে থাকতে পারে না, তাকে কিছু না কিছু করতেই হয়, সেখানে আমাদের শ্রমবাজারের সার্বিক অবস্থার দিকে তাকাতে হবে।

 কভিডের কারণে কৃষি শিল্প সেবা খাতে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে?

সৌভাগ্যবশত কৃষি খাতে প্রভাব এতটা নেতিবাচক নয়। যদিও কৃষিপণ্য বাজারজাত করা ইত্যাদিতে সমস্যা হয়েছে, বিশেষ করে যখন সবকিছু বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তবে সার্বিকভাবে কৃষি এখনো ভালো করছে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিল্প সেবা খাত। শিল্প খাতের একটা অংশ বৈদেশিক চাহিদার ওপর নির্ভরশীল এবং সে চাহিদা যতদিন পর্যন্ত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে না আসবে ততদিন খাতটির স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। আর শিল্প খাতের যে অংশটি অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদার ওপর নির্ভরশীল, সেটির সম্ভাবনা একটু ভালো কিন্তু একেবারে স্বাভাবিক হচ্ছে না। কারণ সাধারণ জনগণ যদি বাজারে না যায়, তারা পণ্য ক্রয় করবে না; তাদের যদি চাকরির নিশ্চয়তা না থাকে তাহলে যা অবশ্য প্রয়োজনীয় নয়, তা কেনাকাটায় উৎসাহী হবে না। যখন চাহিদা ব্যাহত হয় তখন উৎপাদন ব্যাহত হতে বাধ্য। সুতরাং শিল্প খাত একটা বড় ঝুঁকির মুখে। সেবা খাতেরও একই রকম অবস্থা। কারণ সেবা খাতের অনেকটাই শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। তাছাড়া হোটেল, রেস্তোরাঁ, ভ্রমণসংক্রান্ত চাহিদা কমে গেছে। খাতগুলোও বেশ উচ্চমাত্রার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

 আমাদের দেশে তো আনুষ্ঠানিক খাতের চেয়ে অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান বেশি। আনুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছিল। কভিড পরিস্থিতিতে আমরা দেখছি আনুষ্ঠানিক খাতের কর্মীরাও ঝুঁকিমুক্ত নন। এখানেও যদি নিয়ম অনুসরণ করা না হয় তাহলে আনুষ্ঠানিক খাতের কর্মসংস্থান বৃদ্ধির যৌক্তিকতা কতটা?

খুব কৌতূহলোদ্দীপক প্রশ্ন। যখন আমরা আনুষ্ঠানিক খাত শব্দটা ব্যবহার করি তখন কিন্তু এর কিছু বৈশিষ্ট্যের কথাও বলি। যেমন আনুষ্ঠানিক খাতে কর্মীর কাজের নিরাপত্তা থাকবে, সামাজিক সুরক্ষা থাকবে, স্বাস্থ্যগত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে। কিন্তু আমাদের দেশে তো তথাকথিত আনুষ্ঠানিক খাত।  ‘তথাকথিতশব্দটা ব্যবহার করছি কারণ উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যের বেশির ভাগই এখানে অনুপস্থিত। শুধু নামেই আনুষ্ঠানিক, প্রকৃতভাবে নয়। যখন কোনো ধরনের সংকট বা অর্থনৈতিক সংকট এখানে আঘাত করে তখন তথাকথিত আনুষ্ঠানিক খাতের প্রকৃত চেহারাটা বেরিয়ে পড়ে, যেটা আমরা দেখছি এখন। সুতরাং ধরনের আনুষ্ঠানিক খাতে বেশি জোর দিয়ে লাভ নেই। আগে সত্যিকারের আনুষ্ঠানিক খাত হওয়া চাই।

 উন্নত দেশগুলো কভিড পরিস্থিতিতে বেকারদের জন্য ভাতা বা বিভিন্ন সুরক্ষা কার্যক্রম গ্রহণ করছে। বাংলাদেশে এগুলো চালু হয়নি, কবে হবে তাও নিশ্চিত নয়। অবস্থায় বাংলাদেশের করণীয় কী?

করণীয় তো অনেক কিছুই আছে। উন্নত দেশগুলোয় বেকারত্ব ভাতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্যবস্থা আছে। তবে এগুলো কিন্তু মোটাদাগে সরলীকরণ করে দেখা উচিত হবে না। উন্নত দেশগুলোয় বিভিন্ন ধরনের মডেল আমরা দেখতে পাই। চলমান বৈশ্বিক সংকটের সময় আবার সেটি বেরিয়ে আসছে। একটা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধরনের মডেল, যেখানে এক ধরনের সামাজিক সুরক্ষা বেকারত্ব ভাতা আছে এবং বেকারত্ব ভাতাকে আরো কিছুদিন প্রলম্বিত করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কিন্তু সেখানে ছাঁটাই খুব সহজ। গত ফেব্রুয়ারিতে  আমেরিকায় বেকারত্বের হার যেখানে শতাংশের নিচে  ছিল, এপ্রিলে তা ১৩ শতাংশ হয়। পরে কিছুটা কমলেও বর্তমানে দুই অংকের ঘরেই রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রকম উচ্চহার আর দেখা যায়নি। এটা এক ধরনের মডেল, যেখানে আপনি সহজে বেকার হয়ে যান, কিন্তু বেকারত্ব ভাতা আছে; যা দিয়ে কোনো রকমে জীবন চালিয়ে নেয়া যায়। আরেকটা মডেল আছে, যা ইউরোপের অনেক দেশ অনুসরণ করে এবং তারা কিন্তু এটা চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে বেকারত্বটা বেড়ে না যায়। আমরা যদি ফ্রান্স, জার্মানির বেকারত্ব হারের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাই ফেব্রুয়ারির তুলনায় মে মাসে একটু বেড়েছে কিন্তু খুব বেশি বাড়েনি। কেননা তারা প্রণোদনা প্রদানের মাধ্যমে এমন একটা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, যেখানে উদ্যোক্তা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো কর্মীদের ছাঁটাই না করে কাজে রেখে দিতে পারছে। প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মীদের যেন তাদের বেতনের একটা বড় অংশ দিতে পারে এমনভাবেই প্রণোদনাটা দেয়া হচ্ছে। এসব দেশেও বেকারত্ব ভাতা আছে। অনেক দেশ এক বছরের বেকারত্ব ভাতা বাড়িয়ে দেড় বছর করেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রণোদনা এমনভাবে দেয়া হচ্ছে যে তাত্ক্ষণিক ছাঁটাই যেন না হয়। ধরনের বিভিন্ন মডেল রয়েছে আমাদের সামনে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর বেশকিছু উদাহরণ রয়েছে। এগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে আমরা আমাদের মতো করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি। আমি বলছি না যে অমুক দেশ এটা করেছে সে অনুযায়ী করতে, সেটি সম্ভবও নয়। আমাদের একটু হলেও শিক্ষা হয়েছে। আমরা যদি শিক্ষাটাকে কাজে লাগাই তাহলে বোধহয় অনেক কিছুই করতে পারি। প্রসঙ্গে আমি একটু ইতিহাসের দিকেও তাকাব। ১৯৯৭-৯৮ সালে এশিয়া বিশেষ করে পূর্ব দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে শুরু করে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া এক বড় অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। কিন্তু তার আগে এসব দেশে যখন অতি উচ্চহারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছিল, তখন তাদের বলা হতো এশিয়ান টাইগার্স। অথচ ১৯৯৭-৯৮-এর সংকটে দেশগুলোয় দারিদ্র্যের হার, বেকারত্বের হার অনেক বেশি বেড়ে গেল। তার পরে কিন্তু দেশগুলো শিক্ষা গ্রহণ করে কিছু হলেও সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা চালু করেছে। সুতরাং আমাদেরও বোধহয় সময় এসেছে শিক্ষা গ্রহণ করে কিছু ব্যবস্থা নেয়ার।

 ইউরোপে প্রণোদনা দিয়ে কর্মসংস্থান ধরে রাখার কথা আপনি বললেন, বাংলাদেশে  গার্মেন্টসহ রফতানি খাতের জন্য প্রণোদনা দেয়া হলেও  কর্মচ্যুতি বা মজুরি কর্তনের ঘটনা ঘটছে। এক্ষেত্রে প্রণোদনা প্রদানের বিষয়টি কি কাজ করছে না? তাহলে তা কীভাবে বণ্টন করা উচিত ছিল?

প্রণোদনা কাজ করছে কি করছে না, এটা তো পর্যালোচনা, পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষণের ব্যাপার। আশা করি, কেউ না কেউ এটা করবে। তবে আমি একটি ছোট উদাহরণ নিয়ে বিশ্লেষণে যেতে পারি। যেমন পোশাকসহ রফতানিমুখী শিল্প খাতের জন্য হাজার কোটি টাকা প্রণোদনার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্যাকেজের অংশ খুবই সহজ শর্তে মাত্র শতাংশ খরচে ঋণ হিসেবে দেয়া হচ্ছে। প্রথম যখন প্রণোদনার কথা বলা হলো, তখন কি খুব পরিষ্কার ছিল যে এটা ঋণ হবে; এটা শুধু শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতনের জন্য হবে, বেতনের কত অংশ কতদিন ধরে টাকা থেকে তাদের দেয়া হবে প্রশ্নগুলো প্রথম থেকে পরিষ্কার ছিল কিনা, এটা আমার জানা নেই। কিন্তু কালক্রমে আমরা জানলাম এটা ঋণ। এটা থেকে কর্মচারীদের তিন মাসের বেতন প্রদানের কথা। কিন্তু পূর্ণ বেতন নাকি আংশিক, তা নিয়ে যে আলোচনা চলছিল, আমি জানি না সে আলোচনার নিষ্পত্তি হয়েছে কিনা। একটা হিসাবে আমরা দেখেছি শুধু পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতনও যদি দিতে হয় তাহলে তাদের এক মাসের বেতনও ওই প্রণোদনা থেকে দেয়া যাবে না। সেখানে তিন মাসের জন্য দিতে হলে টাকা যথেষ্ট  কিনা, সেটা একটা প্রশ্ন। এর পরে আসে পদ্ধতিপ্রণোদনা কীভাবে দেয়া হবে। কিছুদিন পর জানা গেল এটা শ্রমিকদের ব্যাংক হিসাবে সরাসরি পাঠানো হবে। খুবই ভালো ব্যবস্থা।  এসব বিষয় আগে থেকে যদি ঠিক করা যেত তাহলে তা আরো মসৃণভাবে বাস্তবায়ন করা যেত। আমি আশা করছি, এটা হয়তো বাস্তবায়ন হচ্ছে। কিন্তু অর্থের অংক অপ্রতুল বলে স্বাভাবিকভাবে ছাঁটাই, চাকরিচ্যুতি ইত্যাদি ঘটছে। এখানে আমার আরো একটি প্রশ্ন আছে। আমাদের পোশাক শিল্পের বয়স এখন ৪০ বছরের কাছাকাছি, এত বছর পরেও শিল্পকে এতটা কেন সাহায্য করতে হচ্ছে? ধরনের আপৎকালীনের জন্য তারা কি তহবিল গঠন করতে পারত না! তারা তো ২০০৭-০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট দেখেছে। সুতরাং ধরনের ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, যেখানে একটি শিল্প শুধু রফতানির ওপর নির্ভরশীল এবং বৈশ্বিক বাজার মসৃণভাবে চলে না, সেখানে আমাদের তো কিছু ব্যবস্থা আগে থেকেই রাখা উচিত  ছিল। সবকিছু মিলিয়ে আমার মনে হয়, শিল্পের অবস্থা একটু মিশ্র ধরনের।

 প্রণোদনাটা কীভাবে দিলে কর্মসংস্থানকে ধরে রাখতে পারি?

আমরা যদি কাজ বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রণোদনা দিতে চাই, তাহলে খুব পরিষ্কার করে বিষয়টি বলতে হবে যে লক্ষ্যে এতদিনের জন্য প্রণোদনা দেয়া হবে। টাকার অংক হিসাব করে বের করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বাস্তবায়ন পদ্ধতি থাকতে হবে। এর মানে গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে স্পষ্টভাবে বলতে হবে। একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ দিই। দরিদ্রদের এককালীন আড়াই হাজার টাকা অনুদানের ব্যবস্থা ছিল, যদিও অর্থের পরিমাণ খুবই সামান্য। আমরা একটা হিসাব করে বের করেছিলাম দরিদ্রদের পরিবারপিছু মাসে অন্তত ১০ হাজার টাকা প্রয়োজন। যাই হোক, ৫০ লাখ দরিদ্র পরিবার যদি মাসে আড়াই হাজার টাকা করে পায় তাহলে দুই কোটি লোক সুবিধা পাবে যদি পরিবারপ্রতি আমরা চারজন করে সদস্য ধরি। সম্প্রতি সংবাদে দেখলাম এটি বাস্তবায়নের চিত্র খুবই করুণ। বিস্তারিত কথায় আমি আর না-ইবা গেলাম। সুতরাং দেখা যাচ্ছে আমাদের সদিচ্ছা থাকলেও প্রস্তুতির অভাব আছে এবং বাস্তবায়নের জন্য যে ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার, আমরা তা নিতে পারছি না। যাই হোক, চলমান পরিস্থিতি থেকে আমরা অনেক কিছুই শিখছি এবং আশা করছি নিকট ভবিষ্যতে শিক্ষাগুলোকে কাজে লাগিয়ে উন্নত কিছু ব্যবস্থা নিতে পারব।

 আমাদের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার কাজ চলছে। আবার কভিড পরিস্থিতির কারণে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। তাই কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় কী ধরনের পদক্ষেপ রাখা উচিত?

প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ জটিল। ষষ্ঠ সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে কর্মসংস্থানের কথা উল্লেখ আছে। আমাদের সদিচ্ছার কোনো অভাব নেই। এমনকি লক্ষ্যমাত্রাও নির্দিষ্ট করা আছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বলা হয়েছিল, প্রতি বছর ২০ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে কিন্তু বাস্তবে তা অর্জিত হয়নি। বিস্তারিত কোনো কর্মকৌশল তাতে উল্লেখ ছিল বলে আমার জানা নেই। সংক্ষেপে রফতানিমুখী শিল্প ইত্যাদি প্রসারের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্য অর্জনের কথা বলা হয়েছিল। আমাদের ২০১৬ সালের শিল্পনীতি আছে, যা অত্যন্ত ভালোভাবে প্রণয়ন করা হয়েছে কিন্তু বাস্তবে প্রয়োগের কী ব্যবস্থা, তা আমার জানা নেই। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে কভিড পরিস্থিতি সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার আগেই আমাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পরিকল্পনায় বাস্তবায়ন সমস্যা ছিল। এখন সমস্যা আরো ঘনীভূত হয়েছে এবং ভবিষ্যতে সমস্যা আরো প্রকট হবে। এর সঙ্গে আসে বাজেট প্রসঙ্গ। পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে কী করে। পরিকল্পনা যারা করেন, তাদের কাছে কিন্তু বাস্তবায়নের হাতিয়ারগুলো সেভাবে থাকে না। আমরা অনেকদিন থেকেই বলে আসছি, একটি মাত্র রফতানিমুখী শিল্পের ওপর নির্ভর করে একটা অর্থনীতি বেশিদিন দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। এখানে ভঙ্গুরতা থাকতে বাধ্য। বাস্তব অবস্থায় আমরা তা আজ দেখতে পারছি। ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী পাঁচ বছরে দেড় কোটি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য নীতিমালা গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। বাজেটেও তা উল্লেখ ছিল। পাঁচ বছরে দেড় কোটি হলে প্রতি বছরে ৩০ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়ার কথা। আমি বলছি না, সরকারই শুধু কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। ধরনের অর্থনীতিতে সরকার বিশেষ কোনো কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে না কিন্তু সরকারের নীতিমালার সাহায্যে অর্থনীতি এমনভাবে চালিত হয়, যার মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। ২০২০-২১ সালের বাজেটে কর্মসংস্থানের অংশে গিয়ে আমি লক্ষ করলাম যে কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওই লক্ষ্যমাত্রার কথা আর উল্লেখ নেই এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বলা আছে যে এত প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে, যার মাধ্যমে অর্থনীতি আবার চালু হবে, পুনরুজ্জীবিত হবে। অনুমান করা হচ্ছে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আবার চালু হলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। অনুমান যে সবসময় বাস্তবে খাটবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই।

 বর্তমানে আমরা যে পর্যায়ে রয়েছি, অবস্থায় কভিড নিয়ন্ত্রণ না করে কি উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব?

আমি স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ নই, তবে বিষয়গুলো নিয়ে গণমাধ্যমে অনেক কিছু উঠে আসছে। আমি কিছু অভিজ্ঞতার কথা জানি। আমাদের দেশে এখন যে ব্যবস্থাটা চলছে, মনে হয় একদিক থেকে চিন্তা করলে এটা অবশ্যম্ভাবী ছিল। কারণ যেখানে দরিদ্র কিংবা সাধারণের জন্য সংকটজনক পরিস্থিতিতে সুরক্ষা দেয়া বা সহায়তার কোনো ব্যবস্থা নেই, তখন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু রাখতে হবে, যাতে সাধারণ লোক কিছু করে খেয়ে বাঁচতে পারে। অনাহারে মারা যাওয়া বা কভিডের আক্রমণে মারা যাওয়ার মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, সে দ্বন্দ্বের সমাধান হিসেবে আমরা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাব বলে ঠিক করেছি। তবে এটা চালিয়ে যাওয়াটা কতটা বাস্তবসম্মত, তা একটা বড় প্রশ্ন। আমার কাছে কোনো জবাব নেই। তবে সুইডেন, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক নরওয়ের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখতে পারি। সুইডেন চেষ্টা করেছে সবকিছু স্বাভাবিক রেখে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু রেখে অবস্থা কী দাঁড়ায়, তা দেখার। সুইডেন কিন্তু বেশি সফল হয়নি। তাদের জনগণের মৃত্যুর হার, সংক্রমণের হার যেমন উচ্চমাত্রায়, অর্থনীতির অবস্থাও তেমন ভালো নয়। ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধিসহ তাদের বেকারত্বের হারও বেড়ে যাচ্ছে। সুতরাং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু রাখতে চাইলেই যে চালু থাকবে এবং অর্থনীতির অবস্থা স্বাভাবিক থাকবে তা মনে করার বিশেষ কোনো কারণ দেখছি না।

 যেকোনো পরিকল্পনা প্রণয়নে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকে চিহ্নিত করতে তথ্য-উপাত্ত-পরিসংখ্যান প্রয়োজন। আমরা কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে ন্যূনতম মজুরি বা প্রকৃত মজুরির আপ-টু-ডেট তথ্য পাই না। সঠিক তথ্য ছাড়া পরিকল্পনা প্রণয়ন বা সুবিধাবঞ্চিতদের চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ কী?

এককথায় এর জবাব হচ্ছে, আমাদের অনেক কিছুই অনুমানভিত্তিক করতে হবে। বিস্তারিতভাবে বললে, আমাদের কর্মসংস্থানসংক্রান্ত তথ্যের মূল উৎস হচ্ছে শ্রমবাজার জরিপ। ২০১৬-১৭ সালের পর আর জরিপ করা হয়নি। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার মতো উন্নয়নশীল দেশেও প্রতি তিন মাস পর জরিপ পরিচালনা করা হয়। বছরে চারবার তারা জরিপ কার্যক্রম চালায়। আর আমরা প্রতি বছরে একবারও তা করছি না। শিল্প খাত সম্পর্কে তথ্য কোথায়? ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প জরিপ হয়েছিল ২০১২ সালে। আট বছর আগে। ২০১৯ সালে একটি জরিপ হয়েছে। বিবিএসের ওয়েবসাইটে এক পাতার সংক্ষিপ্ত তথ্য দেখে বিষয়টি আমি জানতে পেরেছি। আট বছরের পুরনো তথ্য দিয়ে আমরা যদি পরিকল্পনা বা নীতিমালা প্রণয়ন করতে চাই তাহলে তো কিছুটা অনুমানভিত্তিক করতে হবে। তবে একমাত্র মজুরিসংক্রান্ত হালনাগাদ তথ্য দেখছি। শুধু হালনাগাদ তথ্য হলে হবে না, ভালো এবং নির্ভরযোগ্য তথ্য চাই। আমরা যদি ভালো এবং হালনাগাদ তথ্যের ভিত্তিতে নীতিমালা প্রণয়ন বাস্তবায়নের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিই তাহলে এক্ষেত্রে জোর দিতে হবে এবং সম্পদ ব্যয় করতে হবে।

 কভিডের কারণে আমাদের জনশক্তি রফতানি খাতে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে?

এটি আমাদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খাত। বিশেষ করে কর্মসংস্থানের অন্যতম বড় উৎস এটি। সরকারি উপাত্ত অনুযায়ী গত কয়েক বছরে গড়ে প্রায় সাত লাখ লোক বিদেশে চাকরি নিয়ে গেছে। কভিড পরিস্থিতিতে এই ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়লে এক ধরনের ভিন্ন অবস্থার সৃষ্টি হবে। রেমিট্যান্স আমাদের বড় শক্তি। যদি বিদেশে কর্মসংস্থানের সংখ্যা কমে যায় তাহলে এর নেতিবাচক প্রভাব রেমিট্যান্সের ওপর কোনো না কোনো সময় পড়তে বাধ্য।  যদিও সরকার চেষ্টা করছে প্রণোদনার মাধ্যমে রেমিট্যান্সের ধারাটা বজায় রাখতে। কিন্তু ২০২০ সালে কতজন লোক বিদেশে চাকরি নিয়ে যেতে পারছে, এটি একটি বড় প্রশ্ন থেকে যাবে। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন দেখে মনে হচ্ছে বিদেশ থেকে ফেরত আসার সংখ্যাই বাড়ছে এবং আরো কয়েক মাস তা চলবে। সুতরাং আমি মনে করি, ২০২০ সাল বিদেশে কর্মসংস্থান হারানোর বছর।

 কর্মসংস্থান ধরে রাখতে সরকার স্বল্প, মধ্য দীর্ঘমেয়াদে কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে?

স্বল্পমেয়াদে কিছু পদক্ষেপ অবশ্যই নিতে হবে। সার্বিকভাবে বললে, অর্থনীতি একটা সংকটের মধ্যে এবং আমরা সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। কিন্তু বাস্তব সম্ভাবনার দিকে তাকালে মনে হয়, ২০২০ সালের বাকি সময়টা সংকটের মধ্য দিয়েই কাটবে। সুতরাং আমাদের কিছু কর্মকাণ্ড হাতে নিতে হবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরায় চালু করা, পুনরুজ্জীবিত করা চালিয়ে যেতে হবে, তবে সেখানে আমরা কতটা সফল হব বা সফল হলেই যে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে থাকবে, এমনটা মনে না করে কিছু পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। চাকরি বা কর্মসংস্থান ধরে রাখাএটাও কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যতটা সম্ভব চাকরিচ্যুতি কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য কী কী করা যায় সেগুলো আমাদের জানা আছে, নতুন করে কিছু আবিষ্কার করতে হবে না। প্রয়োজন শুধু সুচিন্তিতভাবে পদক্ষেপগুলো নির্ধারণ বাস্তবায়ন করা। দ্বিতীয়ত, জরুরি ভিত্তিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির ব্যবস্থা করা। এখানেও আমাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে, জানা আছে কী করা দরকার। আমরা যদি চাই তা করতে পারি। যেমন কর্মসংস্থান প্রকল্প। আমাদের দেশে প্রচলিত ভাষায় এটাকে বলা হয় পাবলিক ওয়ার্কস প্রোগ্রাম। যদিও এই গণপূর্ত কর্মসূচির নামে অনেক দুর্নাম জড়িত, সব খারাপ জিনিসের মধ্যে সবকিছুই খারাপ নয়। এর মধ্য থেকেও আমরা কিছু ভালো জিনিস বের করতে পারি, যার মাধ্যমে কিছুটা হলেও জরুরি অবস্থা মোকাবেলা সম্ভব। গণপূর্ত কর্মসূচি মানেই কিন্তু শুধু রাস্তাঘাট মেরামত, যা কিনা পরের বছর বর্ষা মৌসুমে ধুয়ে চলে যাবে তা নয়। আমরা অন্যভাবেও চিন্তা করতে পারি, বিশেষ করে জরুরি ভিত্তিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রকল্প গ্রহণ করা যেতে পারে। সরকারের ধরনের প্রকল্প কিন্তু এখনো চালু আছে, কিন্তু খুব ছোট আকারে। এগুলোকে আবার বড় করা যায় কিনা, তা দেখতে হবেএগুলো হচ্ছে স্বল্পমেয়াদের বিষয়। আর মধ্য দীর্ঘ দুটোকে আমি একসঙ্গে করব। কারণ যেটাকে আমরা মধ্যমেয়াদের বলব, সেটাই আস্তে আস্তে দীর্ঘমেয়াদে চলবে।

এখানে আমি তিনটি বিষয় বলব। এক. কর্মসংস্থানের জন্য একটি সার্বিক পরিকল্পনা এবং কর্মকৌশল প্রয়োজন। আমরা একটি বাক্যে বলে দিলাম যে এভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবেবিষয়টি কিন্তু এত সরল নয়। দুই. কর্মসংস্থানের সঙ্গে সামাজিক সুরক্ষাকে একীভূত করে একটি সুসংহত কর্মকৌশল প্রণয়ন করা উচিত, যেখানে বেকারত্ব ভাতার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অন্তর্ভুক্ত হবে। তিন. সেই কর্মকৌশলে থাকতে হবে পরিকল্পনার সঙ্গে বাস্তবায়নের ঘনিষ্ঠ মেলবন্ধনের ব্যবস্থা। পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঘটে বাজেট বরাদ্দের মাধ্যমে। আর বাজেট বরাদ্দের সময় দেখতে হবে কীভাবে বিভিন্ন ধরনের নীতিমালা কর্মকৌশলকে বাস্তবে রূপ দেয়া যায়। কর্মকৌশল তৈরি করে শেলফে রেখে দিলে বিশেষ কিছু কাজ হবে না; তাকে বাস্তবমুখী করে বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করতে হবে।

 শ্রুতলিখন: রুহিনা ফেরদৌস

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন