ওষুধ কোম্পানির বিপণন কার্যক্রম

করোনায় কমেছে উপঢৌকন দেয়ার প্রতিযোগিতা

তবিবুর রহমান

পণ্যের প্রচার বিপণন বাড়াতে প্রধানতম উপায় বিজ্ঞাপন। প্রায় সব পণ্যের বিপণনে উপায় অবলম্বন করা হলেও বিধিনিষেধ থাকায় ওষুধের ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপন প্রচার করতে পারে না উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে বিক্রি বাড়াতে ভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নেয় তারা। বিক্রয় প্রতিনিধির মাধ্যমে চিকিৎসকদের কাছে পৌঁছে দেয়া হয় বিনা মূল্যে ওষুধের স্যাম্পল, সেই সঙ্গে নানা উপঢৌকন সামগ্রী, যাতে চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে ওই কোম্পানির ওষুধ লেখেন। উপঢৌকন দেয়ার চর্চাটা অনৈতিক হলেও প্রায় সব ওষুধ কোম্পানিই কাজে রীতিমতো প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। তবে চলমান কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে চিকিৎসকদের উপঢৌকন দেয়ার প্রতিযোগিতা অনেকটা কমে এসেছে।

ভয়াবহ ছোঁয়াচে রোগ কভিড-১৯- আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে চেম্বারে রোগী দেখা অনেকটা কমিয়ে দিয়েছেন চিকিৎসকরা। রোগীর পাশাপাশি চেম্বারে ওষুধ কোম্পানির বিপণন কর্মীদেরও আগমন নিরুৎসাহিত করছেন তারা। মূলত কারণেই ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলোর ওষুধ প্রচারণা পণ্য বা উপঢৌকন বিতরণ কমেছে অর্ধেকের বেশি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনার মহামারীর কারণে ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিপণন কার্যক্রম কিছুটা ব্যাহত হলেও একেবারে থেমে নেই উপহার দেয়ার চর্চা। অনেকে প্রতিষ্ঠিত  চিকিৎসকদের তালিকা তৈরি করে মহামারীর মধ্যেও বাড়িতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের উপহার সামগ্রী দিয়ে আসছে।

জানতে চাইলে ওষুধ প্রস্তুতকারী অন্যতম শীর্ষ একটি কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, করোনা আতঙ্কে অনেক চিকিৎসক এখন রোগী দেখছেন না। কারণে প্রচারণা পণ্য বিতরণ অর্ধেকের নিচে নেমে আসছে। তবে আমাদের কোম্পানির মান বাজার ধরে রাখার স্বার্থে কিছু চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করে এসব পণ্য বিতরণ অব্যাহত রেখেছি। রাজধানীর মধ্যে বিতরণের হার বেশি কমে আসছে।

ওষুধের বিজ্ঞাপন প্রচার বেআইনি হলেও নিজস্ব ব্র্যান্ডের পরিচিতি বাড়াতে ফ্রি স্যাম্পল বিতরণের বিধান রয়েছে। এরও ব্যয়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর। ওষুধ প্রশাসনের করা ২০২০ সালের আইনে বলা হয়েছে, কোনো কোম্পানির টার্নওভার কোটি টাকা হলে এর শতাংশ, কোটি টাকা থেকে ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত হলে শতাংশ এবং ১০ কোটি টাকার ওপরে হলে শূন্য দশমিক শূন্য শতাংশ ওষুধ স্যাম্পল হিসেবে বিনা মূল্যে বিতরণ করতে পারবে কোম্পানিগুলো। যদিও দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো নিয়ম মেনে চলে না। প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নিজেদের ইচ্ছামতো খাতে অর্থ ব্যয় করে তারা। এর ফলে একদিকে নিম্নমানের ওষুধ বাজার দখল করছে, অন্যদিকে ওষুধের দাম চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে। ওষুধ প্রশাসনের নানা পদক্ষেপ এমন অনৈতিক কর্মকাণ্ড ঠেকাতে ব্যর্থ হলেও মহামারী নভেল করোনাভাইরাস চর্চা অর্ধেকের বেশি কমাতে সক্ষম হয়েছে।

খাতসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশী-বিদেশী ২৬৯টি অ্যালোপ্যাথি কোম্পানির ২৮ হাজার ব্র্যান্ডের ওষুধ বিক্রি হচ্ছে দেশের অভ্যন্তরে। ওষুধের বাজারমূল্য বছরে অন্তত ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। অর্থের কমপক্ষে হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে চিকিৎসকদের উপঢৌকন প্রদানের পেছনে। কোম্পানির বিক্রয় লক্ষ্য পূরণের জন্য চিকিৎসকের পাশাপাশি অনেক সময় ফার্মেসিগুলোতেও নানা ধরনের উপহারসামগ্রী দিয়ে থাকেন বিক্রয় প্রতিনিধিরা। আর ডাক্তারদের উপঢৌকন হিসেবে ফ্রিজ, টেলিভিশন, বিদেশ ভ্রমণের খরচ এমনকি ফ্ল্যাট গাড়ির মতো দামি উপহারও দেয় কোম্পানিগুলো।

নভেল করোনাভাইরাস কোম্পানির প্রচারণা পণ্য বিতরণে প্রভাব ফেলেছে বলে স্বীকার করেছেন ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক তাবিবুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, করোনা আতঙ্কে চিকিৎসক-রোগী কেউই হাসপাতালমুখী হচ্ছে না। অনেক চিকিৎসক চেম্বার করলেও ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের যেতে নিষেধ করছেন। ফলে কোম্পানির প্রচারণা পণ্য বিতরণে প্রভাব পড়েছে। জাতীয়ভাবে এসব উপহার সামগ্রী বিতরণে ৪০ শতাংশ কমে এলেও রাজধানীতে এসব বিতরণ ৫০ শতাংশের বেশি কমেছে। তবে আমাদের কর্মীরা প্রতিনিয়ত ডাক্তারদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। প্রচারণা পণ্য বিতরণ কমার কারণে ওষুধের বিপণন ব্যয় কিছুটা কমতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, প্রচারণার নামে উপঢৌকন বিতরণ করা খুবই অনৈতিক। এটি জরুরি ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। উপঢৌকনের প্রভাবে চিকিৎসকরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অনুমাননির্ভর প্রয়োজন ছাড়া অতিরিক্ত ওষুধ দিয়ে থাকেন। ওষুধ কোম্পানিগুলো এমন অনৈতিক কাজ নিয়ন্ত্রণ করা গেলে বিশ্ববাজারের তুলনায় ওষুধের দাম অন্তত ৬০ শতাংশ কমে আসবে।

বাংলাদেশ স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি রশিদ--মাহবুব বলেন, ওষুধের ক্ষেত্রে কোম্পানির আর চিকিৎসকের মধ্যে যে লেনদেন হয়, তা সম্পূর্ণ অনৈতিক। আমি ধরনের কোনো উপহার গ্রহণ করি না। ব্যক্তিগতভাবে এটা অনৈতিক মনে করি। এসব অপকর্ম বন্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। কিছু ওষুধ প্রচারণার জন্য চেম্বারে দিতে পারে, তবে বাড়িতে উপহার দেয়া উচিত নয়। আর কোম্পানিগুলো তাদের ওষুধ প্রচারণার জন্য কত টাকা খরচ করবে, তারও সীমাবদ্ধতা রাখা উচিত।

বিপণনের জন্য উপঢৌকন দেয়াটা অনৈতিক বলে মনে করেন বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব এসএম শফিউজ্জামানও। হাডসন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিউজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, করোনা আতঙ্কে চিকিৎসকরা রোগী না দেখায় ওষুধ কোম্পানিগুলোর প্রচারণা পণ্য বিতরণ কমে আসছে। তবে ওষুুধ শিল্পে প্রচারণার ব্যবস্থা না থাকায় কোম্পানিগুলো নিজেদের ইচ্ছামতো ব্র্যান্ডের পরিচিতির জন্য অর্থ ব্যয় করে থাকে। তবে অনৈতিক কাজে এমন প্রতিযোগিতা করা ঠিক নয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন