দেউলিয়াত্বের আবেদন ৪৫ মার্কিন জায়ান্টের

বণিক বার্তা ডেস্ক

কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাবে বিপর্যয়ের মুখে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বৃহদায়তন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো। এরই মধ্যে দেউলিয়া হিসেবে সুরক্ষা পাওয়ার আবেদন করেছে দেশটির ৪৫টি জায়ান্ট কোম্পানি। এসব কোম্পানির মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই আবেদনের আগে কর্মীদের ছাঁটাই অবৈতনিক ছুটিতে পাঠালেও নির্বাহীদের বড় অংকের বোনাস পরিশোধ করেছে বলে রয়টার্সের এক বিশ্লেষণে উঠে এসেছে।

এসব প্রতিষ্ঠানের তালিকায় জেসি পেনির মতো নামি বড় কোম্পানিও রয়েছে। মহামারী শুরুর কারণে এখন পর্যন্ত ৮৪৬টি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে জেসি পেনি। কোম্পানির মোট ৮৫ হাজার কর্মীর মধ্যে ৭৮ হাজারকেই পাঠানো হয়েছে অবৈতনিক ছুটিতে। গত ১৫ মে দেউলিয়া হিসেবে সুরক্ষা পাওয়ার আবেদন করে জেসি পেনি। কোম্পানিটি সম্প্রতি জানিয়েছে, জেসি পেনির ১৫২টি স্টোর চিরতরে বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে ছাঁটাই হচ্ছে হাজার কর্মী।

তবে দেউলিয়াত্বের আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ আবেদন করার ঠিক আগ মুহূর্তে নির্বাহীদের রিটেনশন বোনাস (কর্মীদের অন্য কোম্পানিতে যোগ দেয়া থেকে বিরত রাখার জন্য দেয়া বোনাস) পরিশোধ করেছে বলে রয়টার্সের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে। ২০০৫ সালে প্রণীত মার্কিন দেউলিয়াত্ব আইন অনুযায়ী, নির্দিষ্ট কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো কোম্পানি দেউলিয়া অবস্থায় নির্বাহীদের কোনো ধরনের বোনাস পরিশোধ করতে পারবে না। যদিও আইনের ফাঁকফোকরের সুবিধা নিয়ে ১৪টি কোম্পানি দেউলিয়াত্বের আবেদন করার আগেই নির্বাহীদের এসব বোনাস পরিশোধ করেছে।

১৪টি কোম্পানির মধ্যে ছয়টি দেউলিয়াত্ব সুরক্ষার আবেদন করার আগের এক মাসের মধ্যেই রিটেনশন বোনাস পরিশোধের ঘোষণা দিয়েছে। মহামারীজনিত অসুবিধা থেকে কর্মীদের সুরক্ষা দিতে বোনাস দেয়া হয়েছে বলে দেউলিয়াত্বের আবেদনে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো।

আবেদনের আগের পাঁচদিনের মধ্যে বোনাস পরিশোধ করেছে জেসি পেনি হার্টজ গ্লোবাল হোল্ডিংস লিমিটেডের মতো প্রতিষ্ঠানও। জ্বালানি খাতের প্রতিষ্ঠান হাই-ক্রাশ নির্বাহীদের বোনাস পরিশোধ করেছে দেউলিয়াত্বের আবেদন করার দুদিন আগে।

আদালতে আবেদন করার ঠিক আগে আগে নির্বাহীদের প্রায় কোটি ডলারের বোনাস দিয়েছে জেসি পেনি। বিষয়টি নিয়ে কোনো ধরনের মন্তব্য করতে রাজি হয়নি প্রতিষ্ঠানটি। তবে আগে প্রকাশিত এক বিজ্ঞপ্তিতে প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, মহামারীর আগে প্রতিষ্ঠানটির অগ্রযাত্রায় ভূমিকা রাখামেধাবী ব্যবস্থাপকদেরধরে রাখতেই রিটেনশন বোনাস  দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

লাক্সারি রিটেইলার প্রতিষ্ঠান নেইমান মার্কাস গ্রুপ মার্চে অস্থায়ীভাবে ৬৭টি স্টোরের সবগুলোই বন্ধ করে দেয়। এপ্রিলে ১১ হাজারেরও বেশি কর্মীকে অবৈতনিক ছুটিতে পাঠায় প্রতিষ্ঠানটি। ফেব্রুয়ারিতে চেয়ারম্যান প্রধান নির্বাহী জিওফ্রে ভ্যান রায়েমডঙ্ককে ৪০ লাখ ডলার বোনাস পরিশোধ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। মার্কিন আদালতের নথি বলছে, মে দেউলিয়াত্বের আবেদন করার আগে অন্যান্য শীর্ষ নির্বাহীকে বোনাস হিসেবে আরো ৪০ লাখ ডলারেরও বেশি বোনাস দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বিষয়টি নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

সম্প্রতি ১৪ হাজারেরও বেশি কর্মীকে ছাঁটাই করেছে হার্টজ। ২২ মে দেউলিয়াত্বের আবেদন করার আগ মুহূর্তে জ্যেষ্ঠ নির্বাহীদের রিটেনশন বোনাস হিসেবে ১৫ লাখ ডলার পরিশোধ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এর কারণ হিসেবে আদালতে দেউলিয়া ঘোষণার আবেদনে প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, ভ্রমণে মহামারীর প্রভাব পড়ার কারণে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, সেটি থেকে সুরক্ষা পেতেই বোনাস দিয়েছে হার্টজ।

হোয়াইটিং পেট্রোলিয়াম করপোরেশন দেউলিয়াত্বের আবেদন করে এপ্রিল। এর আগে নির্বাহীদের অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ হিসেবে কোটি ৪৬ লাখ ডলার পরিশোধ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। চেসাপিক এনার্জি করপোরেশন মে মাসে নির্বাহী নিম্নপদস্থ কর্মীদের বোনাস হিসেবে মোট আড়াই কোটি ডলার পরিশোধ করেছে। এর ঠিক আট সপ্তাহের মাথায় আদালতে দেউলিয়াত্বের আবেদন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। উভয় প্রতিষ্ঠানই তাদের আবেদনে জানিয়েছে, মহামারীর কারণে সৌদি আরব রাশিয়ার মধ্যকার মূল্যযুদ্ধের কারণে প্রতিষ্ঠান দুটির ব্যবসায়ে ধস নেমেছে। এতে করে প্রতিষ্ঠানগুলোর ইনসেনটিভ প্ল্যানও অকার্যকর হয়ে পড়েছে। 

দেউলিয়াত্বের আবেদন করার আগে ধরনের বোনাস নিয়ে নানা মহল থেকে দীর্ঘদিন ধরেই আপত্তি তোলা হচ্ছে। এক্ষেত্রে তাদের আপত্তির জায়গাটি হলো, যেখানে দেউলিয়াত্বের সুবিধা 

পেতে কোম্পানিগুলো কর্মীদের ছাঁটাই করছে এবং ঋণদাতা শেয়ার বিনিয়োগকারীদের বিপাকে ফেলছে, সেখানে নির্বাহীদের ধরনের বোনাস পরিশোধের মাধ্যমে আরো সমৃদ্ধ করে তোলা হচ্ছে।

চলতি বছরের মার্চে খেলনা রিটেইলার প্রতিষ্ঠানআর’-এর বিপক্ষে ঋণদাতারা মার্কিন আদালতে একটি মামলা করে। ওই মামলায় ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠানটিকে দেউলিয়া ঘোষণার আবেদন করার আগে শীর্ষ নির্বাহীদের বোনাস পরিশোধের পাশাপাশি আরো অনেক অনিয়মে যুক্ত থাকার অভিযোগ তোলা হয় কোম্পানির শীর্ষ নির্বাহী পরিচালকদের বিরুদ্ধে। ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠানটির লিকুইডেশনের সময় চাকরি হারিয়েছিল ৩১ হাজারেরও বেশি কর্মী।

জুনে মহামারীর কারণে দেউলিয়াত্বের আবেদনের ঝড় বয়ে গেলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির নির্বাহীদের ধরনের বোনাস পরিশোধ থেকে বিরত রাখায় ঋণদাতাদের ক্ষমতা বাড়িয়ে নতুন একটি আইন প্রণয়ন করতে চেয়েছিলেন মার্কিন কংগ্রেসের ডেমোক্র্যাট আইনপ্রণেতারা। তবে -সংক্রান্ত বিল শেষ পর্যন্ত রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত সিনেটের দরজা পেরিয়ে কার্যকর হয়ে উঠবে কিনা, সে বিষয়ে বড় ধরনের সন্দেহ রয়েছে ডেমোক্র্যাটদের।

যুক্তরাষ্ট্রে দেউলিয়াত্ব সংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখার দায়িত্ব পালন করে থাকে দেশটির বিচার বিভাগের অধীন ইউএস ট্রাস্টি প্রোগ্রাম। সংস্থাটির পরিচালক ক্লিফোর্ড জে হোয়াইট বলেন, দেউলিয়াত্বের আগে নির্বাহীদের ধরনের বোনাস পরিশোধ করার সময়েই প্রতিষ্ঠানগুলো জানে, বিষয়টি নিয়ে পরবর্তী সময়ে অনুসন্ধান করা হবে। কিন্তু দেউলিয়াত্বের আবেদন করার কয়েকদিন আগে ঘোষিত বোনাস পরিশোধ করা থেকে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে বিরত রাখার কোনো ক্ষমতা দেয়া হয়নি ট্রাস্টি প্রোগ্রামকে। ফলে কোম্পানিগুলো বরাবরই স্বচ্ছতা আদালতের রিভিউ এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন