ওয়াইপিএফ সংলাপ

‘পূর্ব এশীয় মিরাকল থেকে বাংলাদেশ কী শিখতে পারে’

অরিন হাসান নোভা

 ইয়ুথ পলিসি ফোরাম (ওয়াইপিএফ) YPF ইতিহাস নামে একটি নতুন সিরিজ চালু করেছে। জুলাইয়ের ১২ তারিখ সিরিজের উদ্বোধনী পর্বে "পূর্ব এশীয় মিরাকাল থেকে শিক্ষা" ওয়েবিনারটিতে এক প্রজন্মের মধ্যে কীভাবে দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর এবং হংকংয়ের মতো পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি চরম দারিদ্র্য থেকে উঠে এসে দ্রুত অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করেছিল তার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিল।

পলিসি সংলাপের প্যানেলিস্ট হিসেবে ছিলেন বাংলাদেশ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) এর পরিচালক ড. আহমদ আহসান; ড. মনজুর হোসেন, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ বিআইডিএস-এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো এবং যুক্তরাষ্ট্রের অরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরাল প্রার্থী শফিকুর রহমান, অধিবেশনটির সঞ্চালনায় ছিলেন মাস্তুরা তাসনিম, ওয়াইপিএফ বিষয়বস্তু ও সম্পাদকীয় প্রধান, এবং ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ওয়েলিংটনে অধ্যয়নরত একজন কমনওয়েলথ স্কলার। ওয়েবিনার সিরিজের মিডিয়া পার্টনার বণিক বার্তা।

পূর্ব এশীয় মিরাকাল ঘটনাটি বিশ্বব্যাংকের ১৯৯৩ সালের; ঐতিহাসিকভাবে নজিরবিহীন দ্রুত বিকাশমান পূর্ব এশীয় অর্থনীতির প্রতিবেদনে ব্যবহৃত একটি শব্দ। এই অভূতপূর্ব প্রবৃদ্ধি মূলত দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, হংকং, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ডের মতো উচ্চ পারফর্মিং এশিয়ান অর্থনীতির (এইচপিএই) HPAEs জন্য প্রযোজ্য ছিল। পরে ভিয়েতনাম এবং চীন যোগ দেয় । এই প্রবৃদ্ধির পেছনে দেশগুলোর সরকারের অর্থনৈতিক নীতি পরিকল্পনা, বাস্তাবায়নের বিশাল ভূমিকা ছিল। এছাড়া বিভিন্ন সময় নানাবিধ অর্থনৈতিক সংকটকে সফলভাবে কাটিয়ে উঠার অভিজ্ঞতাও রয়েছে এ দেশগুলোর। প্রতিকূল অর্থনৈতিক প্রভাব কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশের, বিশেষত চলমান মহামারীর সময়ে, এই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া প্রয়োজন।

প্যানেল আলোচনাটি ইয়ুথ পলিসি ফোরামের গবেষণা টিমের সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনার মাধ্যমে শুরু হয়। গবেষণা দলের অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে, ১৯৬০ এর দশক থেকে, এইচপিএইসের অর্থনীতিক কর্মকান্ড লাতিন আমেরিকা এবং দক্ষিণ এশিয়ার চেয়ে প্রায় ৩ গুণ দ্রুত এবং সাব-সাহারান আফ্রিকার চেয়ে ৫ গুণ বেশি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছিল।


তারা আরও যোগ করেছেন যে, ব্যাংকিং ব্যবস্থার সামর্থ্য বৃদ্ধির মাধ্যমে বেসরকারি অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ উৎসাহিত করার ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে এউ অগ্রগতি সম্ভব হয়েছিল। এছাড়া দক্ষ ম্যাক্রোইকোনোমিক পরিচালনার মাধ্যমে আর্থিক ঘাটতি সীমাবদ্ধ করতে এবং বেসরকারী ক্ষেত্রকে প্রনোদনা দিতে দেশগুলো সক্ষম হয়েছিল। এছাড়া বেসরকারী এবং সরকারী উদ্যোগের জন্য সহায়ক কাঠামো বিকাশ করা, মানবসম্পদে বিনিয়োগ করে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা এবং বিদেশী সরাসরি বিনিয়োগ (এফডিআই) উত্সাহিত করা রফতানিমুখী কৌশল বাস্তবায়নও এই অর্থনৈতিক উন্নতির পেছনে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রেখেছে।

প্যানেল আলোচনার সময় ড. আহমদ আহসান পূর্ব এশিয়ার উন্নতির পেছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ বর্ণনা করেছিলেন। তার মতে, "প্রতিযোগিতামূলক বিনিময় হার, অবকাঠামো ও মানবসম্পদ উন্নয়নে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ, এবং বিশ্বায়ন ও আঞ্চলিক বনিজ্যে অন্তর্ভুক্তিসহ শক্তিশালী সামষ্টিক অর্থনৈতিক মূলনীতিগুলি মূল কারণ ছিল।" তাদের বিকাশের জন্য পূর্ব এশীয় দেশগুলির মধ্যে সহযোগিতা এবং অংশীদারিত্বের বৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারণ নেতারা সচেতন ছিলেন যে ঐক্য ও সহযোগিতা বৃদ্ধি ছাড়া বেঁচে থাকা কঠিন হবে। "তারা তাদের বেঁচে থাকার প্রয়োজন থেকেই উন্নয়েনর অনুপ্রেরনা খুজে পেয়েছিল।

” ড. মনজুর হোসেন আরও যোগ করেন, এফডিআই, প্রযুক্তিগত জ্ঞান এবং অন্যান্য বিভিন্ন সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে জাপান পূর্ব এশীয় অর্থনৈতিক বিকাশের প্রধান স্থপতির ভূমিকাটি পালন করে। তিনি বিশ্বাস করেন পূর্ব এশিয়ার বিকাশের অভিজ্ঞতা অন্যান্য অর্থনীতির পক্ষে বহুলাংশে প্রতিরূপযোগ্য নয়। উদাহরণস্বরূপ, জাপান দক্ষ আমলাদের সমর্থন নিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে দ্রুত পুনরুদ্ধার শুরু করেছিল। সাংস্কৃতিক সাদৃশ্যের কারণে জাপান বেশিরভাগ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিকেও সহযোগিতা করেছিল। এছাড়াও, ‘জাপানের মতো পূর্ব এশীয় হস্তক্ষেপবাদী রাষ্ট্রগুলিও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, এবং গবেষণা ও উন্নয়নে নির্বাচনী বিনিয়োগের দিকে বেশি মনোনিবেশ করেছে’, তিনি যোগ করেন। তাদের করের হার কম ছিল, ব্যক্তিগত সঞ্চয় এবং বেসরকারী বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়েছিল।

 রাষ্ট্রের কার্যকরী ক্ষমতা, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির উন্নয়নের পেছেনে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে বলা মনে করেন জনাব শফিকুর রহমান। তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে, জাপান জার্মান মডেলকে উন্নয়নের জন্য অনুসরণ করে যা একটি ‘রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপবাদী মডেল’ ছিল।

ডেইলি স্টার-এ প্রকাশিত ‘পূর্ব এশিয়ার দর্শনীয় উত্থান’ প্রবন্ধে ড. আহসান যুক্তি দিয়েছিলেন যে, নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা, বিভিন্ন মতাদর্শ এবং বিকেন্দ্রীভূত সরকার পূর্ব এশিয়ার উত্থানের পেছনের মূল পরিচালক। এই উপাদানগুলি কীভাবে বাংলাদেশে কার্যকর করা যায় সে সম্পর্কে জানতে চাইলে ড. আহসান উন্নয়নশীল দেশের সরকারের বিভিন্ন স্তরে নেতৃত্বের দক্ষতা বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করেন। তিনি চীনের প্রাদেশিক এবং কাউন্টি সরকারের নগরায়ন, এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে ভূমিকার কথা মনে করিয়ে বলেন ক্যে একটি মূল শিক্ষা হল শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ছাড়া বাংলাদেশে উন্নয়ন সম্ভব না।

দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে প্রকাশিত ডক্টর মনজুর হোসেনের ‘কোভিড যুগে এক্সচেঞ্জ রেট ম্যানেজমেন্ট’ প্রবন্ধের কথা উল্লেখ করে, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বাংলাদেশ কীভাবে আরও ভাল এক্সচেঞ্জ রেট পরিচালনা করতে পারে এবং মহামারী ও স্বাভাবিক উভয় সময়েই বেশি এফডিআই আকর্ষণ করতে পারে সে প্রশ্নটি করলে তিনি বলেন, ‘কভিড পরবর্তী যে কোনও সঙ্কটের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার অংশ হিসাবে আমাদের এখন থেকেই নিজেদের সংশোধন করতে হবে’। তিনি আরও যোগ করেন যে বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সঙ্কটের জন্য আন্তর্জাতিক মজুদ রক্ষণাবেক্ষণ করা উচিত।

বাংলাদেশে সম্পর্কে প্যানেলিস্টদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে কীভাবে অংশীদারিত্ব বৃদ্ধির মূলনীতিটি বাস্তবায়িত করা যায়, যার বিষয়ে ড. আহসান জবাব দিয়েছিলেন, ‘মানুষের মূলধন বিনিয়োগই অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি বাস্তবায়নের মূল চাবিকাঠি। উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষিত ও দক্ষ শ্রমশক্তির উপর বিনিয়োগ জরুরি। স্থানীয় পর্যায়ে জবাবদিহিতার গুরুত্ব, স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতার জবাবদিহিতা ও পর্যবেক্ষণের অভাব কীভাবে উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে সে বিষয়েও তিনি কথা বলেন।

বাংলাদেশ দ্রুত শিল্প প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছে, যেখানে জাপানের মতো পূর্ব এশীয় দেশগুলি এসএমইগুলিকে (SME) উৎপাদন নেটওয়ার্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে প্রচার করেছে এবং কার্যকর শিল্প নীতি করেছে। বাংলাদেশে কীভাবে এটি অর্জন করা যায় সে সম্পর্কে ড. হোসেন বলেন, ‘আমাদের নীতি স্থায়িত্বের ক্ষেত্রে একটি সমস্যা আছে’। আমাদের দেশে এসএমইগুলির অবদান জিডিপির (GDP) প্রায় ২৫ শতাংশ এবং শিল্প কর্মসংস্থানের ৮৬ শতাংশ। যেহেতু বড় শিল্পগুলিতে বিনিয়োগের সক্ষমতা আমাদের নেই, তাই এসএমইগুলির উন্নয়নে আমাদের অবশ্যই মনোনিবেশ করতে হবে। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির মতো এসএমইগুলিকে ঋণ দেওয়ার জন্য আমাদের কাছে কোনও বিশেষায়িত ব্যাংক নেই। তদুপরি, এসএমই উন্নয়নের জন্য তাদের কর্মক্ষমতা এবং দক্ষতা পর্যবেক্ষণ, মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণের জন্য পর্যাপ্ত সংস্থান নেই। তিনি বলেন, ‘এসএমইগুলিকে অর্থনীতির লাইফলাইন হিসেবে চিন্তা করে আরও অগ্রাধিকার দিতে হবে।’

‘ড. আহসান এবং জনাব রহমান তাইওয়ানের মডেলের প্রাসঙ্গিকতার বিষয়ে একমত হয়েছিলেন, যেখানে সরকার উন্নয়নের ক্ষেত্রে নাগরিকদের সঞ্চয়, আর্থিক নীতি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগগুলিতে বেশি মনোনিবেশ করেছে। তারা প্রস্তাব করেন যে বংলাদেশ তাইওয়ানের মত অ্যাপ্রোচ অনুসরণ করতে পারে।

সর্বোপরি, নাগরিকদের দক্ষতা বিকাশ, প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে সকল স্তরে সুস্বাস্থ্য ও মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ, দক্ষ আমলাতন্ত্র এবং সুশাসন নিশ্চিতকরণ উপর জোর দিয়েছেন বক্তারা। পূর্ব এশীয় দেশগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের প্রয়োজনে তা যেভাবে ব্যবহার করা দরকার তা করতে সরকারকে আহ্বান জানিয়েছেন।

ওয়েবিনারের রেকর্ড করা সংস্করণটি Youth Policy Forum-এর  ফেসবুক পেজ  এবং ইউটিউব চ্যানেলে পাওয়া যাবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন