করোনার প্রভাব

ভাড়া বাড়িয়েও ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না সড়ক পরিবহন খাত

শামীম রাহমান

মহামারীর কারণে ঘোষিত সাধারণ ছুটি চলাকালে অলস বসিয়ে রাখতে হয়েছে সড়কপথের যাত্রীবাহী সব পরিবহন। অন্যদিকে সাধারণ ছুটির পর পরিবহন চলাচল শুরু হলেও আগের মতো যাত্রী পাওয়া যায় না এখন। উপরন্তু যাত্রী চাহিদা না থাকায় এখনো অলস বসিয়ে রাখতে হচ্ছে অধিকাংশ পরিবহন। ক্ষতি কাটাতে ৬০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানো হলেও এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না সড়ক পরিবহন খাত।

একসময় দিনে এক হাজারের বেশি বাস চলত হানিফ এন্টারপ্রাইজের। নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতিতে বর্তমানে ৬৫০টি বাস অলস বসে আছে প্রতিষ্ঠানটির। বেকার হয়ে পড়েছেন চালক, সুপারভাইজারসহ একেকটি বাসের অন্তত তিনজন কর্মী। অলস বসিয়ে রাখায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বাসের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। এসব বাসের সিংহভাগই কেনা হয়েছে ব্যাংকঋণ নিয়ে। মালিকের কাঁধে ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপ। দেশের অন্যতম শীর্ষ পরিবহন কোম্পানির বর্তমান দশা এটি। বড়-ছোট সব পরিবহন কোম্পানিকেই চরম বিপদে ফেলে দিয়েছে কভিড-১৯।

ঢাকার কল্যাণপুরের বাস কাউন্টারগুলোয় সব সময় ভিড় লেগে থাকত। ঘণ্টায় ঘণ্টায় ছেড়ে যেত গাড়ি। গাড়ির চালক-সুপারভাইজার আর কাউন্টার কর্মীর হাঁকডাকে সরগরম থাকত পুরো এলাকা। কাউন্টারের চেয়ারে ঠিকমতো বসার জায়গাই পেতেন না যাত্রীরা। কিন্তু নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বদলে গিয়েছে পুরো দৃশ্যপট। কাউন্টারে কাউন্টারে এখন তীর্থের কাকের মতো যাত্রীর অপেক্ষায় থাকছেন কর্মীরা। একজন যাত্রী এলে আগবাড়িয়ে তাকে ধরতে ছুটে যাচ্ছেন কর্মীরা। হচ্ছে যাত্রী নিয়ে টানাটানিও। ঘণ্টায় ঘণ্টায় গাড়ি ছেড়ে যাওয়ার দিন আর নেই। ঘণ্টা কখনো ঘণ্টার মতো বিরতি দিয়েও একটি গাড়িতে হচ্ছে না ১০-১২ জনের বেশি যাত্রী।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির তথ্য বলছে, বাস, ট্রাক, ট্যাংক লরি, কাভার্ড ভ্যানসহ সারা দেশে চলাচলরত পরিবহনের সংখ্যা প্রায় চার লাখ। নভেল করোনাভাইরাসের কারণে চাহিদা কমে যাওয়ায় এগুলোর ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বর্তমানে চলতে পারছে। স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন এসব গাড়ির ৭০ শতাংশের বেশি চলাচল করত। এতগুলো গাড়ি বসিয়ে রাখার কারণে বিপুল পরিমাণ ক্ষতির মুখে পড়েছেন পরিবহন ব্যবসায়ীরা। বেকার হয়ে পড়েছেন পরিবহন খাতের অন্তত পাঁচ লাখ শ্রমিক।

মহামারীর কারণে পরিবহন সেক্টরে ক্ষতির প্রকৃত পরিমাণ কত, সে বিষয়ে সঠিক কোনো তথ্য দিতে পারেননি খাতসংশ্লিষ্টরা। তবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব এনা পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খন্দকার এনায়েতুল্লাহ বণিক বার্তাকে ক্ষতি সম্পর্কে আনুমানিক একটা ধারণা দিয়েছেন। তার মতে, ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটি চলাকালে প্রতিদিন ৫০০ কোটি টাকা করে লোকসান দিয়েছে দেশের পরিবহন খাত। জুন থেকে সীমিত পরিসরে চালু হওয়ার পর প্রতিদিন অন্তত ১০০ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হচ্ছে। হিসাবে গত সাড়ে তিন মাসে পরিবহন খাতে অন্তত ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শ্যামলী পরিবহনের মালিক রমেশ চন্দ্র ঘোষের দাবি, বর্তমান পরিস্থিতিতে পরিবহন খাতের দৈনিক ক্ষতির পরিমাণ আরো বেশি। অন্তত ২০০ থেকে ২৫০ কোটি টাকা প্রতিদিন ক্ষতির মুখে পড়ছেন খাতের ব্যবসায়ীরা। তার হিসাবে গত সাড়ে তিন মাসে দেশের পরিবহন খাতে ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে।

কীভাবে ক্ষতি হচ্ছে জানতে চাইলে রমেশ চন্দ্র ঘোষ বণিক বার্তাকে বলেন, দুই মাসের বেশি দেশের সিংহভাগ গাড়ি বসে ছিল। রাস্তার ধার, টার্মিনাল, পেট্রল পাম্পসহ বিভিন্ন জায়গায় রাখা হয়েছিল এসব গাড়ি। সময় গাড়িগুলো থেকে কোনো আয় না এলেও গাড়ি পাহারা দেয়ার জন্য বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ হয়েছে মালিকদের। অন্যদিকে দীর্ঘদিন বসে থাকার কারণে গাড়ির ব্যাটারি, ইঞ্জিন, ব্রেক সিস্টেম, টায়ারসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশের ক্ষতি হয়। পুনরায় চালু করার আগে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটা বড় অংকের টাকা খরচ করতে হচ্ছে। এখনো সারা দেশের অন্তত ৭০ ভাগ গাড়ি অলস বসে আছে। এগুলো পাহারা দেয়া যন্ত্রাংশের ক্ষতি কিন্তু অব্যাহত রয়েছে। এর বাইরে বর্তমানে যেসব গাড়ি চলছে, বিশেষ করে বাসের ক্ষেত্রে তিনভাগের একভাগ যাত্রীও পাওয়া যাচ্ছে না। একটা ট্রিপ দিয়ে গাড়ির জ্বালানি খরচ কর্মীদের বেতন দেয়াই কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। যদিও এসব গাড়ি থেকে প্রতিদিন নির্দিষ্ট হারে মুনাফা আসার কথা মালিকের। বেশির ভাগ গাড়ি কেনা হয় ব্যাংকঋণ নিয়ে। মুনাফা না হওয়ায় ঋণ পরিশোধ করতে গিয়েও বিপুল অংকের ক্ষতির মুখে পড়ছেন পরিবহন মালিকরা।

মহামারীর কারণে দেশের পরিবহন খাতই সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে বলে মনে করছেন হানিফ পরিবহনের মহাব্যবস্থাপক মোশারফ হোসেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, মহামারী দেশের পরিবহন খাতটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এনে দিয়েছে। পরিবহন মালিকরা প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ ক্ষতির মুখে পড়ছেন। আর খাতের শ্রমিকরা কাজ না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। শ্রমিকরা অন্য কোনো কাজও করতে পারেন না। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া কোনোভাবেই খাতটিকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।

সরকারি প্রণোদনা চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সড়ক পরিবহন সেতু মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কাছে আবেদন করেছিলেন পরিবহন মালিকরা। মে মাসে আবেদন করা হলেও বিষয়টি নিয়ে সরকারের কাছ থেকে এখনো কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন