করোনাকাল

দরিদ্রদের খাদ্য সংকট বেশি সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগে

সাইদ শাহীন

সিলেটের বাসিন্দা তোফাজ্জল হোসেন। পেশায় রাজমিস্ত্রির সহকারী। প্রতিদিন কাজ করে যে মজুরি পেতেন, তা দিয়ে পরিবারের ছয় সদস্যের মুখে কোনো রকমে দুবেলা খাবার তুলে দিতে পারতেন দিনমজুর। কিন্তু নভেল করোনাভাইরাস এসে তা জুটছে না এখন। সদ্য মা হওয়া স্ত্রীর জন্য পুষ্টিকর বাড়তি খাবারের প্রয়োজন পড়লেও বাড়তি খাবার দূরে থাক, আয় না থাকায় দুবেলা ক্ষুধা নিবারণের ব্যবস্থাও করতে পারছেন না তিনি।

শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার টিলা বনভূমিবেষ্টিত গ্রাম নকশির বাসিন্দা দিপালীর পরিবারে চার সদস্য। পেশায় দিনমজুর দিপালীর আয়ও বন্ধ করোনার কারণে। স্বাভাবিক সময়ে দুবেলা পেটপুরে খেতে পারলেও করোনা আসার পর দুবেলা খাবার জোগাড় করাটা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে তার কাছে। খাবারের চাহিদা মেটাতে মাঝে মাঝে জংলী আলুও খেয়েছে তার পরিবারের সদস্যরা। তবে শেষদিকে সম্বল হয়ে দাঁড়িয়েছে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের হাজার ৬০০ টাকা।

তোফাজ্জল দিপালীর মতো অবস্থা সারা দেশের দিনমজুরদের অধিকাংশেরই। নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর কাজ হারিয়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটছে তাদের। তবে কভিড-১৯-এর কারণে সরকারি বন্ধের সময় সবচেয়ে বেশি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছে ময়মনসিংহ সিলেট বিভাগে দরিদ্র মানুষেরা। দুই বিভাগে খাবারের ঘাটতি তুলনামূলকভাবে বেশি ছিল। প্রয়োজনীয় পুষ্টি ব্যবস্থাও ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে তাদের। বিশেষ করে শিশু গর্ভবতী নারী এবং স্তন্যদানকারী মায়েদের পুষ্টির অবস্থা নাজুক ছিল।

করোনাকালীন দরিদ্র মানুষের খাদ্য পুষ্টি নিয়ে খাদ্য অধিকার বাংলাদেশ পরিচালিত এক গবেষণার তথ্যমতে, সাধারণ ছুটি বা লকডাউনের সময়ে দেশের প্রায় ৮৭ শতাংশ দরিদ্র মানুষ পর্যাপ্ত খাদ্য এবং পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করতে অসুবিধায় পড়েছে। গবেষণাটি পরিচালনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো . নাজনীন আহমেদ। আজ গবেষণা প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে।

গবেষণায় কেবল সেই ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যারা প্রাক-কভিড পরিস্থিতিতে দরিদ্র বা অতিদরিদ্র ছিল। দৈবচয়ন পদ্ধতিতে নির্বাচিত বিভিন্ন অনানুষ্ঠানিক পেশার সঙ্গে জড়িত অর্থনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর ওপর কভিড-১৯-এর প্রভাব বোঝার জন্য গবেষণা চালানো হয়েছিল। চলতি বছরের মে মাসের মধ্য ভাগ থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে উত্তরদাতাদের সঙ্গে 

সরাসরি কথোপকথন ফোনকলের মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছিল জরিপ। গবেষণায় চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে চারটি জেলা, রংপুর থেকে সাতটি, রাজশাহী থেকে ছয়টি এবং ঢাকা থেকে পাঁচটি জেলার তথ্য রয়েছে। উত্তরদাতাদের ২১ দশমিক শতাংশই ছিল খুলনা বিভাগের। এছাড়া মোট উত্তরদাতার ৭২ শতাংশ চারটি বিভাগ খুলনা, ঢাকা, রাজশাহী রংপুরের বাসিন্দা।

গবেষণাটির বিষয়ে খাদ্য অধিকার বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক ওয়েভ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলী বণিক বার্তাকে বলেন, কভিড-১৯ মহামারীর ফলে জীবিকা নির্বাহের পরিস্থিতি, খাদ্য গ্রহণ এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে দরিদ্র মানুষের পুষ্টির অবস্থা বোঝার জন্য আমরা গবেষণাটি পরিচালনা করি। এজন্য সব প্রশাসনিক বিভাগকে অন্তর্ভুক্ত করে ৩৭টি জেলার ৮৩৪ জন দরিদ্র মানুষের মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত জরিপ চালানো হয়েছিল। বিভিন্ন পেশার দরিদ্র লোকদের মধ্যে ১১টি কেস স্টাডি করা হয়েছিল। গবেষণায় দেখা গেছে, সিলেট ময়মনসিংহ জেলার দরিদ্র মানুষের খাদ্য পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ ছিল। তাই সামনের দিনে পুষ্টি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দরিদ্র মানুষের জরুরি খাদ্য সহায়তা সহজলভ্য করার জন্য বিভিন্ন সরকারি উদ্যোগ (নগদ বা স্বতন্ত্রভাবে) বাড়ানো প্রয়োজন। বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা সুবিধাসহ নগদ অর্থ মোবাইল পরিষেবা ব্যবহার করে নিয়মিত সুবিধাভোগীদের কাছে প্রেরণ করতে হবে। দরিদ্র শিশুদের জন্য পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ করতে হবে।

মহামারীজনিত কারণে ৯৮ দশমিক শতাংশ দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রা লকডাউন দ্বারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের কারো আয় হ্রাস পেয়েছে, কেউ চাকরি হারিয়েছে, দোকানপাট ব্যবসায়িক ক্রিয়াকলাপ বন্ধসহ এমনকি আয়ের পথ সম্পূর্ণ বন্ধের মুখোমুখি হয়েছে। অর্থনৈতিক সমস্যার মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও মাত্র কয়েকজন উত্তরদাতা তাদের পেশা পরিবর্তন করেছেন, যা থেকে বোঝা যায় পরিস্থিতিতে নতুন কাজ পাওয়া সহজ নয়। মোট উত্তরদাতার অর্ধেক দরিদ্র মানুষ সরকার বা বেসরকারি খাত থেকে সামান্য কিছু সহায়তা (শুকনো খাবার, নগদ বা রান্না করা খাবার) পেয়েছিল।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন