রাজধানীর ফকিরাপুলে অবস্থিত মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান আবারণ প্রিন্টার্স। দেশে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর আগে প্রতি মাসে প্রতিষ্ঠানটির আয় ছিল প্রায় ২৫ লাখ টাকা। করোনার কারণে মাঝখানে তিন মাস বন্ধ ছিল ছাপাখানাটি। এখন সীমিত পরিসরে কাজ চললেও আয় নেমে এসেছে ২ লাখ টাকায়।
প্রতিষ্ঠানটির মালিক নূরুল ইসলাম বলেন, আয় ২ লাখে নেমে এলেও থেমে নেই প্রতিষ্ঠানের ব্যয়। ভাড়া, কর্মীদের বেতন ও বিদ্যুৎ বিলসহ সব মিলিয়ে প্রতি মাসে প্রায় ১০ লাখ টাকা গুনতে হচ্ছে। এমন স্থবির পরিস্থিতি চলতে থাকলে ঈদের পর প্রতিষ্ঠান বিক্রি করে দিতে হবে।
বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতি সূত্রে জানা গেছে, করোনার প্রভাবে সারা দেশে প্রায় সাত হাজার ছাপাখানা বন্ধ ছিল। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল প্রায় পাঁচ লাখ কর্মজীবী বেকার হয়ে পড়েন। মুদ্রণ শিল্পে বছরে ১২ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়। এর মধ্যে রয়েছে কাগজ, কালি ও নকশার ব্যবসাও। তবে কাগজ ও কালির দাম ওঠানামার সঙ্গে বিক্রিও বাড়ে-কমে। নভেল করোনাভাইরাসের কারণে গত চার মাসে মুদ্রণ শিল্পে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করছে সংস্থাটি।
করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত আরেক প্রতিষ্ঠানের মালিক তৌফিক আলম সোহাগ। নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার আগে তার প্রতিষ্ঠানে ৩০ জন কর্মী ছিলেন। তিন মাস বন্ধ রাখার পর বর্তমানে মাত্র একজন কর্মী নিয়ে প্রতিষ্ঠান চালু রেখেছেন। এ মুদ্রণ ব্যবসায়ী জানান, কভিড-১৯ আসার আগে মাসে ৩ লাখ টাকা আয় থাকলেও বর্তমানে ৩০ হাজার টাকাও আসছে না। গত ১৪ দিন কোনো কাজ পাননি তিনি। অর্থ সংকটে গত ছয় মাসের ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে পারেননি, এখন নিজের সংসার চালাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে।
নূরুল ইসলাম ও সোহাগের মতোই পরিস্থিতি মুদ্রণ শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় সব ব্যবসায়ীরই। দুর্দশায় আছেন মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নির্ভরশীল পাঁচ লাখ কর্মচারী। শিল্পের এ দুর্দিনে কাজ হারিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটছে তাদের।
রাজধানী ফকিরাপুল-আরামবাগে প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছোট-বড় অনেক ছাপাখানা অবস্থিত। পাশাপাশি রয়েছে কাগজ ও কালির দোকান। স্বাভাবিক সময়ে নটর ডেম কলেজের পাশের গলিতে ঢুকলেই শোনা যেত ছাপাখানার শব্দ। গলির দুই পাশের দোকানগুলোয়ও লেগে থাকত গ্রাহকদের ভিড়। তবে করোনা মহামারী এ চিত্র পাল্টে দিয়েছে। একই অবস্থা রাজধানীর পল্টন, নীলক্ষেত, সূত্রাপুর, গুলিস্তান, ওয়ারী, নারিন্দাসহ দেশের অন্য এলাকার ছাপাখানাগুলোরও।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ক্যালেন্ডার-ডায়েরি ও বই-পুস্তক ছাপানোর পাশাপাশি তৈরি পোশাক, ওষুধ ও হিমায়িত চিংড়ি খাত থেকে ভালো অংকের ব্যবসা পেয়ে থাকে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো। করোনার কারণে গত চার মাসে এসব খাত থেকে তেমন কোনো কাজ মেলেনি। এসব খাত থেকে প্রতি মাসে গড়ে ১৬৫ কোটি টাকার ব্যবসা হারিয়েছে মুদ্রণ শিল্প। এছাড়া এ বছর সরকারি বই ছাপানো ব্যয় ১১ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করলেও কাগজের দাম কম ও কাজ পেতে প্রতিযোগিতার কারণে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় কমবে, যার প্রভাব পড়বে মুদ্রণ খাতে। পরিস্থিতি এভাবে চলতে থাকলে সঠিক সময় শিক্ষার্থীদের কাছে বই তুলে দেয়া নিয়েও শঙ্কা দেখা দিতে পারে। গত বছর অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ে ৩০০ কোটি টাকার ক্যালেন্ডার-ডায়েরিসহ প্রচারণামূলক উপকরণ তৈরি হলেও এবার এর ১০ শতাংশও ছাপা হবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা আছে।
মুদ্রণ শিল্পের সার্বিক অবস্থা নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির চেয়ারম্যান শহীদ সেরনিয়াবাত বণিক বার্তাকে বলেন, মুদ্রণ শিল্পে কাজ মূলত চার মাস হয়। করোনার কারণে সেই চার মাসের অধিকাংশ সময় লকডাউনের মধ্যে কাটছে। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তেমন কোনো কাজই পাননি ছাপাখানার মালিকরা। যদিও গত চার মাসে বাড়িভাড়া, বিদ্যুৎ বিল ও বেতন-ভাতা দিতে গুনতে হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। এমন পরিস্থিতিতে এ শিল্পের জন্য ২ শতাংশ সুদে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারলে আবার হয়তো স্বাভাবিকভাবে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারত প্রতিষ্ঠানগুলো।