সংকট কাটাতে ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকামের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা

বণিক বার্তা ডেস্ক

স্পেন সরকারের নেয়া পদক্ষেপটি পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক নিরীক্ষা হিসেবে একসময় স্মরণ করা হবে। ১৫ জুন করোনাভাইরাস সংকট এবং এর অর্থনৈতিক পরিণতির পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির সরকার একটি ওয়েবসাইট চালু করে, যার মাধ্যমে দেশের দরিদ্রতম পরিবারগুলোকে মাসে হাজার ১৫ ইউরো পর্যন্ত প্রদান করার পরিকল্পনা রয়েছে।

এই প্রকল্পটি সহায়তা করবে দেশের লাখ ৫০ হাজার পরিবারকে। ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম (ইউবিআই) নামে পরিচিত এই ধারণাটির এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় পরীক্ষা এটি। যার মাধ্যমে মানুষকে প্রতি মাসে ক্যাশ টাকা দেয়া হচ্ছে তাদের ইচ্ছামতো খরচ করার জন্য। এটি নিয়ে অনেকবার আলোচনা হয়েছে। কিন্তু সন্তোষজনকভাবে কখনো পরীক্ষা করে দেখা হয়নি। এই পদ্ধতি মানুষের জীবিকায় কী ধরনের প্রভাব ফেলছে, তা অর্থনীতিবিদরা এখন বেশ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখছেন।

এই পদক্ষেপটি নেয়া হয়েছে করোনাভাইরাস মহামারীর ফলে সৃষ্ট অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সময়ে। মহামারীর শুরুতে যারা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে স্পেন তাদের একটি। দেশব্যাপী লকডাউন ভাইরাসের বিস্তারকে সংকুচিত করলেও এর জন্য অর্থনৈতিকভাবে মূল্য দিতে হয়েছে। অর্থনীতি যতই সংকুচিত হয়েছে লাখো মানুষ তাদের চাকরি হারিয়েছে। দেশের ভঙ্গুর জনগোষ্ঠীকে ঝুঁকির মাঝে ফেলে দিয়েছে।

অবশ্য কভিড-১৯ আঘাত হানার আগেও দেশের বামপন্থী জোট সরকার এই প্রকল্পটি প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু  অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা এই টাইমলাইনকে সামনে এগিয়ে নিয়ে আসে। সিস্টেমটি প্রতিটি উপযুক্ত পরিবারের জন্য একটি নির্দিষ্ট মাসিক অংক বরাদ্দ করবে। স্পেনের সামাজিক নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রী হোসে লুুইস এসক্রিবা বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে গ্রহীতাকে উপযুক্ত পারিমাণে ক্যাশ দেয়া, যাতে তারা তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারে। অবশ্য এটা সরকার করতে চায় তাদের দারিদ্র্যের মাঝে আটকে না রেখে। একইভাবে বিদ্যমান কল্যাণমূলক প্রকল্পের মাধ্যমে সহায়তা পাবে তারা যাদের চাকরি কিংবা অন্য কোনো আয় নেই।

তার হিসাব মতে এটি প্রয়োগে সরকারকে প্রতি বছর অন্তত বিলিয়ন ইউরো খরচ করতে হবে। স্পেনের নাগরিকদেরও এর প্রতি আগ্রহ রয়েছে। ১৫ জুন প্রক্রিয়ার জন্য ওয়েবসাইটটি চালু করার পর ঘণ্টায় ৫০ হাজারের বেশি ফরম জমা পড়েছে।

আরো কিছু দেশ ইউবিআই পরীক্ষা করে দেখছে। তবে এখন পর্যন্ত বেশির ভাগ ট্রায়াল সীমাবদ্ধ আছে কয়েকশ কিংবা হাজারের মতো মানুষের মাঝে। স্পেনের পদ্ধতিটিই যা ২৯ মে সংসদে পাস হয়েছে, সেটিই প্রথম সারা দেশে প্রয়োগ করা হয়েছে। গবেষকদের জন্য এটি বড় পরীক্ষার সুযোগ করে দিয়েছে।

স্কটল্যান্ড কানাডাসহ অন্য দেশগুলোও এখন ইউবিআইয়ের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করছে। যা মহামারীতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলোকে সহযোগিতা করার একটা উপায় হতে পারে।

ইউনিভার্সিটি অব ম্যানিটোবার অর্থনীতিবিদ ইভেলিন ফরগেট বলেন, আমরা এখন যেসব প্রোগ্রাম দেখছি তার সীমাবদ্ধতা আমাদের অনেকেই বুঝতে পারছি এবং আমি অবাক নই যে সবর্জনীন বেসিক আয়ের আগ্রহ বাড়ছে। আমি মনে করি মানুষ বুঝতে শুরু করেছে যে পুরনো নীতিগুলো বিভিন্ন ধরনের মন্দার জন্য নির্মিত হয়েছে এবং এটি সমাধানের জন্য যথেষ্ট নয়।

কিছু না করেই টাকা

ইউবিআইয়ের ধারণা একেবারেই নতুন নয়। ইংরেজ দার্শনিক থমাস মোর ১৫১৬ সালে তার লেখা বই ইউটোপিয়া ধারণার কথা বলেছিলেন। যদিও ১৯৬০ ১৯৭০-এর দশকে এসে অর্থনীবিদরা এটাকে কীভাবে প্রয়োগ করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। মার্কিন অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যান ১৯৬২ সালে একটি ধারণা প্রস্তাব করেন, যা কিনা ইউবিআইয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত, যাকে বলা হচ্ছিল নেগেটিভ ইনকাম ট্যাক্স। যে উপায়ে নির্দিষ্ট আয় করা মানুষজন কর প্রদানের পরিবর্তে সরকারের কাছ থেকে পরিপূরক গ্রহণ করবে।

১৯৭০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা শহর নগরগুলোতে একটি পাইলট গবেষণা পরিচালনা করেছে পালাক্রমে নেগেটিভ ইনকাম ট্যাক্স গ্যারান্টিযুক্ত বার্ষিক আয় নিয়ে। ১৯৮০ দশকের রক্ষণশীলতার জোয়ার এই নীতিগুলো নিয়ে আগ্রহকে শেষ করে দেয়। ১৯৮২ সাল থেকে আলাস্কা রাজ্য তেল উত্তোলন থেকে পাওয়া লভ্যাংশ রাজ্যের সব অধিবাসীকে দিয়ে আসছে। যা দেয়া হয়েছে বয়স চাকরির অবস্থা নির্বিশেষে বিবেচনায় সবাইকে।

সম্প্রতি অটোমেশন অনেক চাকরির জায়গা দখল করেছে। ইউবিআই অন্য ধারণাগুলো প্রান্তিক অবস্থা থেকে অনেক বেশি মূলধারার অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, বলছিলেন অর্থনীতিবিদ গে স্ট্যান্ডিং। ইলোন মাস্ক মার্ক জাকারবার্গও উৎসাহী হয়ে ইউবিআইয়ের ধারণাকে সমর্থন করেছেন।

মহামারীর দারিদ্র্য

এসক্রিবা স্পেনের গ্যারান্টেড বার্ষিক আয়ের প্রজেক্ট থেকে ফল লাভের ব্যাপারে আশাবাদী। এর বাজেট মোট দেশীয় পণ্যের . শতাংশে সীমাবদ্ধ। তিনি বলেছেন, সরকার কেবল

সেই পরিবারগুলোকে লক্ষ্যে রেখেছে যাদের আয় সর্বনিম্ন।

তহবিলগুলো প্রতিটি পরিবারকে মাসে মাসে বিতরণ করা হবে। ছোট বড় পরিবার হিসাব করে ৪৬২ থেকে হাজার ১৫ ইউরো পর্যন্ত দেয়া হবে। আবেদন করার জন্য ওয়েবসাইট চালু হলেও এখন পর্যন্ত শতাংশ নিম্ন আয়ের পরিবার জুনের শেষ দিকে গিয়ে প্রথম কিস্তি গ্রহণ করেছে কোনো ধরনের আবেদন ছাড়াই। যদিও কেউ কেউ হতাশা প্রকাশ করেছেন স্পেনের প্রত্যেকেই এটা গ্রহণ করতে পারবে না বলে। তাই এটা সত্যিকার অর্থে সর্বজনীন বলে মনে করছেন না তারা। তাই কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করেন ট্রায়াল যদি কাজ না করে তবে ইউবিআইয়ের ধারণাটি ব্যর্থ বলে প্রতীয়মান হতে পারে। পাশাপাশি আয়ের ভিত্তিতে ভাতা নির্ধারণ করার বিষয়টিও বেশ জটিল হতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিদি আইওনা ম্যারিনেস্কু। তবে এসক্রিবা বলছেন তারা এটাকে পরীক্ষা হিসেবে দেখছেন না, যদিও এটি দারিদ্র্য হ্রাস জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করছে কিনা তা পর্যবেক্ষণের একটি বিষয় রয়েছে। তবে অন্য অনেক দেশ এখনো স্পেনের দিকে তাকিয়ে আছে, কারণ তারা নিজেরাও একই পথ অনুসরণ করতে চায়।

নেচার ম্যাগাজিন

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন