করোনাকালে দৃষ্টি গেল খুলে

ডা. পলাশ বসু

মানুষের মন যেমন ভীতিপ্রবণ তেমনিভাবে আবার সাহসীও বটে। অর্থাৎ এ যেন মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। তবে, সমস্যা প্রকট হয়ে উঠে যখন এ ভয় বা সাহস অযৌক্তিকভাবে তৈরি হয়। এর ফলে পরিস্থিতি হয়ে ওঠে জটিল। অথচ একটু যৌক্তিকভাবে আমরা যদি আমাদের চিন্তাচেতনাকে ব্যবহার করতে পারতাম বা করতাম তাহলে হয়ত অনেক জটিলতা সহজেই এড়ানো সম্ভবপর হতো।

এখন তো বিশ্বব্যাপী সচেতন চোখে মানুষ খুঁজে ফিরছে করোনা প্রতিরোধের দাওয়াই। বেঁচে থাকার তাড়না থেকে সংক্রামক এ রোগের জন্য ভ্যাকসিন বা যথাযথ ওষুধের দিকে আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। এর মাঝে করোনা চিকিৎসায় যেসব ওষুধের নাম আমরা শুনেছি তার কোনটাই এ রোগের চিকিৎসার জন্য যথাযথ বলে প্রমাণিত হয় নি। এটা আসলেই হতাশার। তবে ভ্যাকসিন নিয়ে আমাদের আশার আলো এখনও জাজ্জ্বল্যমানই রয়ে গেছে। ইংল্যান্ড, আমেরিকা এবং চীন এ প্রক্রিয়ায় অনেকদূর এগিয়ে গেছে। হয়ত এ বছর শেষ হওয়ার আগেই আমরা পজিটিভ খবর পেয়ে যেতে পারি। সেটা হলেও ভ্যাকসিন বাজারে আসতে আসতে হয়ত ২০২১ সালের জানুয়ারি/ফেব্রুয়ারি হয়ে যাবে। এমন হলে এটা ভ্যাকসিনের ইতিহাসে নবতর সংযোজন হবে। কারণ এত দ্রুত আর কোনো ভ্যাকসিন এর আগে বাজারে আসতে পারে নি। এ কারণেই এ ভ্যাকসিনকে বলা হচ্ছে ‘সুপার ভ্যাকসিন’। আপাতত সে আশায়ই আমরা চেয়ে আছি। দেখা যাক শেষাবধি ‘সুপার ভ্যাকসিন’ বাজারে আসে কিনা!

এদিকে, করোনাকাল আমাদের এখানে ৪ মাসের অধিক সময় পার করে ফেললো। শুরুর ২ মাস সাধারণ ছুটি থাকলেও জুনের ১ তারিখ হতে তা উঠে যায়। গত ঈদের আগেই দোকানপাট, মার্কেট খুলে যায়। ঈদের সময় ঢাকা থেকে গ্রামে যেতে না দেয়ার জোরদার ঘোষণা দেয়ার পরেও তা আর শেষতক বাস্তবায়ন করা যায় নি।পরে অবশ্য জীবন ও জীবিকার বাস্তবতায় আর ছুটির ঘোষণা আসেনি; যদিও অনেকে ধারণা করেছিলেন বাজেট পাশের পর হয়ত আবার ছুটি নামক লকডাউন শুরু হতে পারে। সেটা আর হয়নি। বিদ্যমান বাস্তবতায় জোনভিত্তিক লকডাউনের কথা শুনেছিলাম আমরা। কিন্তু সেটাও অক্কা পেয়েছে মনে হয়। সেই অর্থে লকডাউন বলে এখন আর কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই। জীবন চলছে অনেকটাই স্বাভাবিক নিয়মে।

তবে, আর্থিক যে টানাপোড়েনে মানুষ পড়েছে সেখান থেকে অনেকেই আর বের হতে পারেনি। বেসরকারি খাতের অনেক মানুষ এখন বেকার হয়ে পড়েছে। সরকারের দেয়া বিভিন্ন খাতে প্রণোদনা প্যাকেজ যে দেয়া হলো তার ইতিবাচক ফলাফল বেসরকারি খাতের অনেক জায়গায়ই পড়েনি। এতে করে জীবন ও জীবিকার সংকট দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে। তবে, করোনাকে ক্যাশ করে অনেক ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান যেভাবে তাদের রুটি-রুজির জন্য অনৈতিক কাজ চালিয়ে গেলো, অযথা তাদের কর্মীদেরকে ছাঁটাই করলো, স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে করোনাকালে চিকিৎসক ছাঁটাই থেকে শুরু করে, বেতন কম দেয়া, বেতন-ভাতা না দেয়ার মতোও ঘটনা ঘটালো তাতে আমরা ভীষণরকম অবাক হয়েছি। 

বিশেষ করে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ যেখানে অনুমোদনের সময় অলাভজনক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অনুমোদন নিয়েছে তারা করোনার এ সময়ে ইনকাম কমে গেছে বলে শুরু থেকেই কর্মরত চিকিৎসক-শিক্ষকদেরকে যেভাবে বঞ্চিত করার নমুনা প্রদর্শন করলো তা এক কথায় বিস্ময়কর, অভাবিত, অকল্পনীয়! অথচ প্রতিষ্ঠার পর থেকে বছরের পর বছরের এসব প্রতিষ্ঠান যে লাভ করেছে তা থেকে একটি পয়সা কি কর্মরত চিকিৎসক, শিক্ষক, কর্মকর্তা বা কর্মচারীদেরকে দিয়েছে? না, তা দেয়নি। তাহলে, আয় কমে গেছে বলে এখন বেতন কমানো বা না দেয়ার দায় কেনো অন্যদের ওপর চাপানো হবে? করোনার সেই শুরু থেকেই কীভাবে চিকিৎসক সহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী, কর্মকর্তা, কর্মচারীদেরকে বেতন বঞ্চিত করা যায় তার বাহানা কিন্তু আজ অবধি তাদের চালিয়ে যেতে দেখছি । সে ধারাবাহিকতায় বেতন কাটছাঁট করা হয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠানেই। বোনাসের বালাই তো নেই-ই। সামনে অনেক প্রতিষ্ঠানে কাটছাঁটকৃত এ বেতনও না দেয়ার প্রচেষ্টা চলমান রয়েছে বলে আমরা উদ্বেগজনক খবর পাচ্ছি। এমন হলে বেসরকারি চিকিৎসা শিক্ষা ও সেবা খাত সামনে ধসে পড়বে বলে অনেকেই মনে করছেন। এদিকে জিকেজি, রিজেন্টের ঘটনা আর ইতালিতে করোনার ভুয়া সার্টিফিকেট নিয়ে গিয়ে দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার যে আয়োজন দেখলাম তাতে আমরা সকলেই রীতিমতো বিস্মিত। ক্যাশ, ক্রাইম আর করাপশানের- ত্রিচক্রে পড়ে আমাদের অনেক অর্জন যে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে- এটা খুবই হতাশার।

সামনে আবার ঈদ আসছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় মনে হচ্ছে এ ঈদেও মানুষ গ্রামমুখী হবে। করোনার বিস্তার এখনও যেভাবে চলছে তাতে ভয়ের বিষয় যথেষ্টই রয়ে গেছে। শহরকেন্দ্রিক সংক্রমণ এখন গ্রামেও ছড়িয়েছে। এ ঈদে মানুষ গ্রামে গেলে হয়ত তা পরে ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। তাছাড়া কোরবানির পশুর হাট থেকেও সংক্রমণ ছড়ানোর সমূহ সম্ভাবনা রয়ে গেছে। 

তাই বিদ্যমান বাস্তবতায় আসুন করোনাকে উদাসীনভাবে নয়; বরং আরও অনেকটা সময় ধরে একে আমরা ভয়ের চোখেই দেখি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি। অন্ততপক্ষে ৩টি কাজ যেন আমরা ব্যক্তিগতভাবে ঠিকঠাক মতো করি। প্রথমত- মাস্ক ছাড়া কেউই আমরা যেন বাইরে বের না হই। দ্বিতীয়ত- সাবান দিয়ে যেন নিয়মিত হাত ধুয়ে ফেলি বা স্যানিটাইজ করি। আর তৃতীয়ত- জনসমাগম এড়িয়ে চলতে যেন অবশ্যই আমরা সকলেই বিশেষ সতর্ক থাকি। সেই সাথে পশুর হাটও যেন যত্রতত্র না বসে সে ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করব। পরিশেষে মানুষের বাড়ি যাওয়া এবং আসাটা যেন যতটা সম্ভব ভিড় কমিয়ে করানো যায় সেদিকেই এখন নজর দিতে হবে। তাহলেও সেটা হয়ত মন্দের ভালো হিসেবে পরিগণিত হতে পারে।

ডা. পলাশ বসু, চিকিৎসক ও শিক্ষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন