টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলে দেশের নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিভিন্ন জেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে। সপ্তাহের ব্যবধানে দ্বিতীয় দফা বন্যায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে বানভাসি মানুষ। অন্যদিকে, বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন জেলায়। বিশেষ করে কুড়িগ্রাম, বগুড়া, লালমনিরহাটসহ উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ জেলায় খাদ্য ও সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিচ্ছে। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর—
কুড়িগ্রাম: জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে নয় উপজেলার ৪৬ ইউনিয়নের নদ-নদীর অববাহিকার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের দেড় লক্ষাধিক মানুষ। অনেকেই ঘর-বাড়ি ছেড়ে পাকা সড়ক, উঁচু বাঁধ ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিতে শুরু করেছে। দ্বিতীয় দফার বন্যার কবলে পড়া কর্মহীন এসব মানুষের খাদ্য সংকটের পাশাপাশি সুপেয় পানির সংকটও দেখা দিয়েছে।
সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের খেয়ার আলগার চরের মোজাম্মেল হক জানান, গত কয়েকদিন আগের বন্যায় কষ্ট করে বাড়িতে ছিলাম। এখন আবার পানি বাড়ছে। এবার মনে হচ্ছে আর বাড়ি থাকা যাবে না।
উলিপুর উপজেলার সাহেবের আলগা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সিদ্দিক মন্ডল জানান, আমার ইউনিয়নের পুরোটাই বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। যাদের বাড়িতে থাকার উপায় নেই, তারা উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিচ্ছে। এ বন্যাকবলিত মানুষেরা কেউ চুলা জ্বালাতে পারছেন না। তাদের জন্য শুকনো খাবার জরুরি হয়ে পড়েছে।
সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. আইয়ুব আলী জানান, আমার ইউনিয়নের প্রায় ৩২ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় পুরো ইউনিয়নের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। মানুষজন ঘর-বাড়ি ছেড়ে সড়কে অবস্থান নিচ্ছে। এখন পর্যন্ত সরকারি কোনো ত্রাণ সহায়তা পাওয়া যায়নি।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় নির্বাহী প্রকৌশলী মাহমুদ হাসান জানান, গতকাল বেলা ৩টার রেকর্ড অনুযায়ী কুড়িগ্রামে সেতু পয়েন্টে ধরলার পানি বিপত্সীমার ৯৪ সেন্টিমিটার, চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপত্সীমার ৬২ সেন্টিমিটার, নুনখাওয়া পয়েন্টে ৬৩ সেন্টিমিটার ও তিস্তার পানি কাউনিয়া পয়েন্টে বিপত্সীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। বেড়েছে অন্যান্য নদীর পানিও। আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে।
কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. রেজাউল করিম জানান, জেলার নয় উপজেলায় বন্যাকবলিত মানুষের জন্য ১৬০ টন চাল, জিআর ক্যাশ ৪ লাখ টাকা, শিশুখাদ্যের জন্য ২ লাখ টাকা ও গো-খাদ্যের জন্য ২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, যা দ্রুত বন্যাকবলিতদের মাঝে বিতরণ করা হবে।
বগুড়া: দ্বিতীয় দফায় যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। গতকাল পানি বৃদ্ধির কারণে বেশকিছু এলাকা নতুন করে তলিয়ে গেছে। বগুড়ার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলায় যমুনা নদীর অববাহিকার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলগুলো প্লাবিত হয়ে প্রায় ৭৭ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে।
বগুড়ার শেরপুর পৌরসভার ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নিমাই ঘোষ জানান, করতোয়া নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় তার ওয়ার্ডের ঘোষপাড়া, পূর্বদত্তপাড়া ও উত্তরসাহাপাড়া এলাকায় বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। এসব এলাকার ৪০ থেকে ৫০টি বাড়িঘরে পানি উঠেছে। ডুবে গেছে রাস্তাঘাট। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন অর্ধশতাধিক পরিবার। এর মধ্যে ১৫টি পরিবারের লোকজন বাসাবাড়ি ছেড়ে স্থানীয় একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছেন।
বগুড়া জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আজাহার আলী বলেন, যমুনা নদীর পানি বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নের ৯৮টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। দুর্গত এলাকার ১৯ হাজার ৭২ পরিবারের ৭৭ হাজার ৬২০ জন মানুষ দুর্ভোগে পড়েছেন।
রংপুর: গতকাল বেলা ১১টায় ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপত্সীমার ৪৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি গত ২৪ ঘণ্টায় ৩১ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপত্সীমার ৫১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং ঘাঘট নদীর পানি ১২ ঘণ্টায় ১৯ সেন্টিমিটার বেড়ে গাইবান্ধা শহরের নতুন ব্রিজ পয়েন্টে বিপত্সীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এছাড়া কুড়িগ্রাম জেলায় ধরলা নদী ব্রহ্মপুত্র চিলমারী পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
রংপুর বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয়ের উপপরিচালক ডা. সুলতান আহমেদ বলেন, দুর্গত এলাকায় সার্বক্ষণিক চিকিৎসা সহায়তা দিচ্ছে একাধিক মেডিকেল টিম। এখন পর্যন্ত বন্যাজনিত ডায়রিয়াসহ সব রোগ নিয়ন্ত্রণে আছে। স্যালাইন ও প্রয়োজনীয় ওষুধের স্বল্পতা নেই। তবে পুনরায় বৃষ্টি ও পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সংশ্লিষ্ট এলাকার স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে সব সময় তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
সিরাজগঞ্জ: জেলায় যমুনার পানি আবারো বিপত্সীমা অতিক্রম করেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি ১১ সেন্টিমিটার বেড়ে গতকাল সকালে বিপত্সীমার ৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
সিরাজগঞ্জের পাউবোর পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ (পওর) শাখার উপবিভাগীয় প্রকৌশলী (এসডি) একেএম রফিকুল ইসলাম বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বরাত দিয়ে জানান, যমুনায় আগামী ৭২ ঘণ্টা পানি আরো বাড়তে পারে।
দ্বিতীয় দফায় যমুনার পানি বিপত্সীমা অতিক্রম করায় জেলার সদর, কাজিপুর, শাহজাদপুর, বেলকুচি ও চৌহালী উপজেলার অভ্যন্তরীণ নদ-নদী ও শাখাগুলোতে পানি বাড়তে শুরু করেছে। যমুনার তীরবর্তী অঞ্চলও প্লাবিত হয়েছে।
লালমনিরহাট: ভারতের গজলডোবা ব্যারাজ থেকে আসা পানি নিয়ন্ত্রণ করতে জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে দেয়ায় লালমনিরহাটের আদিতমারী, কালীগঞ্জ, হাতীবান্ধা, পাটগ্রাম ও সদর উপজেলার ২৫টি ইউনিয়নের প্রায় ৪০ হাজার পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে।
মহিষখোচা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক হোসেন জানান, পানিবন্দি পরিবারগুলো মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সরকারিভাবে উপজেলার দুটি ইউনিয়নের পানিবন্দি পরিবারগুলোর জন্য ৩৫ টন জিআর চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল।
আদিতমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ মনসুর উদ্দিন বলেন, পানিবন্দি পরিবারগুলোর সার্বক্ষণিক খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। পানিবন্দি পরিবারগুলোর জন্য সরকারিভাবে ৩৫ টন জিআর চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
তিস্তা ব্যারাজ ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম জানান, ব্যারাজের উজান ও ভাটিতে বিশেষ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন সার্বক্ষণিক মনিটরিং করছে।