সময়ের ভাবনা

বাংলাদেশী মিলেনিয়ালদের সামনে চ্যালেঞ্জগুলো

মো. শরীফ হাসান

নভেল করোনাভাইরাস মহামারীজনিত দীর্ঘ শাটডাউনের কারণে যে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়েছে, তা বিশ্বজুড়ে জীবন জীবিকার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। গ্রহের সবচেয়ে ধনী দেশ আমেরিকাতেই বৈশ্বিক সংক্রমণ মৃত্যুর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ঘটেছে এবং গবেষণায় দেখা যাচ্ছে একটি নির্দিষ্ট গ্রুপের লোকেরা এর ফলে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী।

তারা হলো মিলেনিয়াল জনগোষ্ঠী, যারা ১৯৮০ থেকে ১৯৯৭ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছিল। অ্যানি লোরে লেখেন, আমেরিকান মিলেনিয়ালরা প্রায় সব ঠিকঠাকই করেছিল: তারা মাদক এবং অ্যালকোহল থেকে দূরে ছিল, রেকর্ড সংখ্যায় কলেজে গিয়েছিল এবং স্থিতিশীল, অর্থবহ চাকরি ক্যারিয়ার চেয়েছিল। কিন্তু তারা হলো সেই হতভাগ্য, যাদের অনেকেই এখন হারানো প্রজন্ম বলতে চাইবে, কেননা তারা দ্বিতীয় মন্দার সম্মুখীন হতে চলেছে; যা সম্ভবত মহামন্দার মতোই মারাত্মক হতে পারে। তারা এরই মধ্যে ২০০৮-এর অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন হয়েছে, যার রেশ তাদের তিন-চতুর্থাংশই এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

এমন এক সময়ে যখন আমেরিকান মিলেনিয়ালরা, যারা কমপক্ষে কলেজের পড়াশোনা শেষ করেছেন, তারা পরিবর্তনের প্রত্যাশায় ছিলেন। কিন্তু মহামারীটির আক্রমণ আক্ষরিক অর্থেই তাদের আশা স্বপ্ন ধ্বংস করে দিয়েছে। তাদের অতিরিক্ত ভঙ্গুরতা যেন এই মারাত্মক ভাইরাসের মাধ্যমে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটের মাধ্যমে আরো বাজেভাবে উন্মোচিত হয়েছে। তারা যে আর্থিক সুনামির মুখোমুখি হচ্ছে, তা ডাটা ফর প্রগ্রেসের এক সমীক্ষার মাধ্যমে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। দেখা গেছে যে ৪৫ বছরের কম বয়সী আমেরিকানদের ৫২ শতাংশই চাকরি হারিয়ে ফেলেছেন, বাধ্যতামূলক লম্বা ছুটি গ্রহণে বাধ্য হয়েছেন অথবা তাদের কর্মঘণ্টা হ্রাস পেয়েছে। অথচ তা এর উপরের বয়সসীমার ক্ষেত্রে ২৬ শতাংশ। সবই হয়েছে মহামারীর কারণে।

তাদের বাংলাদেশী সহকর্মীরা অর্থাৎ বাংলাদেশী মিলেনিয়ালরা কেমন আছে? তারা কতটা সফল? নিশ্চিতভাবেই মার্কিন আর্থসামাজিক ব্যবস্থাগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের অসামঞ্জস্য খুব স্পষ্টতই দৃশ্যমান। তবুও প্রশস্তভাবে বলতে গেলে প্রশান্ত মহাসাগরপাড়ের মিলেনিয়ালরা বহুক্ষেত্রেই অভিন্ন অগ্নিপরীক্ষার শিকার হয়। বাংলাদেশে আশি নব্বইয়ের দশকে সামান্য সময়ের জন্য সেনা-সমর্থিত সরকার ব্যতীত সামরিক বা স্বৈরাচারী শাসনের সাক্ষী ছিল না।

যদিও প্রজন্মকে প্রায়ই বিভিন্ন একাডেমিক গবেষণার শিকার করা হয়, যেমন নৈর্ব্যত্তিক পদ্ধতির প্রবর্তন, পরীক্ষায় কাঠামোগত বা জনপ্রিয়, যাকে সৃজনশীল পদ্ধতি বলা হয়, তার প্রবর্তন, মেধা মূল্যায়নের গ্রেডেশন এবং উন্মুক্ত প্রক্রিয়ায় পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন। প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা অবশ্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রসার লাভের সুবিধাভোগী ছিল, যেখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যোগ্যতার বদলে বাণিজ্যিক বিবেচনার ভিত্তিতে উচ্চশিক্ষা লাভ করা যায়।

প্রমিতকরণের এই অভাব কীভাবে বাংলদেশী মিলেনিয়ালদের তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য সহায়তা করেছিল? নিশ্চিতভাবেই বিদেশী পাঠ্যক্রম এবং পরীক্ষা পদ্ধতি অনুসরণ করা ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষার্থীদের -জাতীয় শিথিল কোনো ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়নি। অন্যদিকে মাদ্রাসাশিক্ষাও চূড়ান্তভাবে পিছিয়ে গেছে।

সামগ্রিকভাবে প্রজন্মের বেশির ভাগের জন্যই পরিস্থিতি শুরু থেকেই কখনো আশাব্যঞ্জক হয়নি। এর প্রতিচ্ছবি দেশের বেকারত্বের নির্মম ছবিতে বেশ স্পষ্ট। আমেরিকান মিলেনিয়ালরা যদি জেনারেশন এক্স (১৯৬৫ ১৯৮০-এর মধ্যে জন্মগ্রহণকারী মানুষ) বা তাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের বেবি বুমারদের (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে প্রজন্মের মানুষ) চেয়ে খারাপ অবস্থায় থাকে, তবে এখানে বাংলাদেশের স্নাতক বা স্নাতকোত্তররা তাদের শিক্ষিত মা-বাবার চেয়ে ভালো কোনো অবস্থায় নেই। ২০১৯ সালে দেশে বেকারত্বের হার ছিল দশমিক শতাংশ। তবে যুব বেকারত্বের হার ছিল ১২ শতাংশ। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয়টি হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের ৪৬ শতাংশই বেকার।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষার্থীরা ফেডারেল  গভর্নমেন্ট ফান্ড থেকে পড়াশোনার জন্য ঋণ পায় এবং মিলেনিয়ালরা কলেজ বা উচ্চতর পড়াশোনার জন্য তা গ্রহণ করে; যা তাকে চাকরির বাজারে প্রবেশের পর দিতে হয়। এখন আমেরিকায় মিলেনিয়ালরা গড়পড়তা ৩৩ হাজার ডলার ঋণ নিয়ে রেখেছে। উল্লেখযোগ্য, মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা এরূপ সুবিধা উপভোগ করে না এবং -জাতীয় ঋণের বোঝাও হয় না। এছাড়া আমেরিকান বেকাররা সামাজিক সুবিধার জন্য নিবন্ধন করতে পারেন।

রকম বিশেষ কোনো সরকারি নিরাপত্তা ছাড়া ক্রমবর্ধমান শিক্ষার ব্যয়ের ফলে বাংলাদেশী মিলেনিয়ালরা, বিশেষত বেসরকারি খাতের শিক্ষার্থীরা এরই মধ্যে অসুবিধায় পড়েছে। তাদের মধ্যে দরিদ্ররা আরো বেশি। এবার আসুন দেখে নেয়া যাক কীভাবে নভেল করোনাভাইরাস মহামারী আমেরিকান মিলেনিয়ালদের হতাশার দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে। ২০০৮ সালের মন্দার সময় তত্কালীন আমেরিকার সাম্প্রতিক স্নাতকদের অর্ধেকই কর্মসংস্থান খুঁজে পাননি এবং তাদের আনুষ্ঠানিক বেকারত্ব ২০ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে ছিল।

ঋণের বোঝা, অনিশ্চিত চাকরি এবং খুবই অল্প বা কোনো রকম সঞ্চয় ছাড়াই মার্কিন মিলেনিয়ালরা বিশাল আর্থিক নিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি হয়েছে। আমেরিকান ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো প্রজন্ম তাদের মা-বাবার চেয়ে দরিদ্র হবে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকরা কীভাবে নভেল করোনাভাইরাস মহামারী দ্বারা উদ্ভূত এরূপ উদীয়মান উচ্চ বেকারত্বের চ্যালেঞ্জের সঙ্গে মোকাবেলা করবেন? এরই মধ্যে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা চাকরির বাজারের প্রয়োজনীয়তার মধ্যে একটি অনৈক্য রয়েছে, যা নিয়ে সব অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ প্রায়ই একই সুরে অভিযোগ করেন।

প্রথাগত শিক্ষা ব্যবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিভাগের সংখ্যা বাড়ানো ছাড়া খুব কমই কোনো মৌলিক পর্যালোচনা আছে, যা প্রয়োজনীয় জ্ঞান, বিশেষত প্রয়োজনীয় দক্ষতার চাহিদা পূরণ করতে পারে। রাশিয়া নির্মিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বাংলাদেশী বিজ্ঞানী প্রযুক্তিবিদরা রাশিয়ায় ব্যাপক গবেষণা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। কিন্তু শিল্প অন্যান্য উৎপাদনশীল খাতের বিশেষ প্রয়োজনীয়তাগুলো কেন প্রথমে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয় না এবং সেই অনুসারে শিক্ষার পাঠ্যক্রম বিন্যাস করা হয় না? একটি মানবসম্পদ মন্ত্রণালয় -জাতীয় মূল্যায়ন করতে পারে এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় এটি মানবসম্পদের চাহিদা সরবরাহের মধ্যে ব্যবধান দূর করতে শিক্ষা ক্ষেত্রের যথাযথ সংস্কার করতে পারে। এই লকডাউনের সময়টি উদ্দেশ্যে আরো ভালোভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে।

 

মো. শরীফ হাসান: শিক্ষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন