যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভবিষ্যৎ কেমন

অ্যামি মেককেবার

জুলাই ট্রাম্প প্রশাসন জাতিসংঘকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দেয় যে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে। যদিও তাদের সরে দাঁড়ানো জুলাই ২০২১ সালের আগে কোনো প্রভাব ফেলবে না। তবে মহামারীকালে সংস্থাটি তাদের শীর্ষস্থানীয় তহবিলদাতাদের একজনকে হারাতে যাচ্ছে।

কয়েক মাস ধরে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মহামারীতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিক্রিয়া নিয়ে সমালোচনা করে আসছিলেন। চীনকে বাড়তি পক্ষপাত দেখানোর অভিযোগ এনে সংস্থাটিকে শাস্তি দেয়ার কথাও বলেন তিনি। এছাড়া ভাইরাসের বিস্তৃতির রিপোর্ট সংস্থাটি এড়িয়ে গেছে এমন মিথ্যা অভিযোগও আনেন তিনি।

কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টারের পাবলিক হেলথ প্রফেসর প্যাট্রিক কাচুর বলেন, একজন বৈশ্বিক নেতার জন্য এভাবে একটি সংস্থা থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করা বিস্ময়কর অস্বাভাবিক। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহারকে বুঝতে আমরা দেখতে পারি কীভাবে সংস্থাটি সৃষ্টি হয়েছে এবং এটি বর্তমানে কীভাবে কাজ করে।

কীভাবে গঠিত হয়েছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা

বিশ্বব্যাপী রোগের বিস্তৃতি ঠেকাতে এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে উৎসাহিত করতে ১৯৪৮ সালে আবির্ভাব ঘটে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার। অবশ্য এর আগে থেকেই দেশগুলো জনস্বাস্থ্য সংকট দূর করার জন্য একসঙ্গে কাজ করে আসছিল।

আঠারো শতকের শুরুতে কলেরা ইউরোপে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে। সে সময় ইউরোপ রেলওয়ে ব্যবস্থার বিকাশ ঘটে এবং স্টিমশিপ তৈরি হয়, যা মানুষের জন্য ভ্রমণকে সহজ করে দেয়। একই সঙ্গে বিকাশ ব্যাকটেরিয়া অন্যান্য সংক্রামক রোগের বিস্তৃতি ঘটানোরও সুযোগ করে দেয়।

এরপর নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৫১ সালে ইউরোপীয় দেশগুলো সিদ্ধান্তে আসে যে তাদের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন এবং তারা ইন্টারন্যাশনাল স্যানিটারি কনফারেন্সের ডাক দেয় কোয়ারেন্টিনের মানদণ্ড ঠিক করার জন্য। কিন্তু প্রথম ইন্টারন্যাশনাল স্যানিটারি কনভেনশন অনুমোদন করার জন্য ৪০ বছর সাতটি মিটিং করতে হয়। যা অনুষ্ঠিত হয় ১৮৯২ সালে। তবে পরের দশকটি আরো ফলপ্রসূ বলে প্রমাণিত হয়। জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিনের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর অ্যালেকসান্দার হোয়াইট বলেন, আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ভঙ্গুর অবস্থায় ছিল।

সবশেষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পারস্পরিক সহযোগিতার আন্তর্জাতিক যুগের শুরু হয়। দেশগুলো ভীত ছিল যে যুদ্ধ রোগের নতুন প্রকোপ নিয়ে আসবে। অনেকটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ১৯১৮ সালের ইনফ্লুয়েঞ্জা যেভাবে সম্পর্কিত ছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৮ সালের এপ্রিলের তারিখ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আবির্ভাব ঘটে। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কী করে

বর্তমানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ১৯৪টি সদস্য দেশ প্রতি বছর একবার অ্যাসেম্বলিতে মিলিত হয় সংস্থার অগ্রাধিকার, নেতৃত্ব বাজেট ঠিক করার জন্য। মিশনটি ডাক্তার, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, বিজ্ঞানী, এপিডেমিওলজিস্ট, অর্থনীতিবিদ, পরিসংখ্যানবিদসহ সাত হাজারের বেশি স্টাফ দ্বারা বিশ্বব্যাপী ১৫০টি অফিসে পরিচালিত হয়।

সংস্থার বাজেট দুই বছরের চক্রে পরিচালিত হয়। ২০১৮-১৯ সালে সংস্থার বাজেট ছিল . বিলিয়ন ডলার, যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় হাসপাতালের খরচের চেয়ে কম। সংস্থার অর্থায়ন আসে দুটি উৎস থেকে। ২০ শতাংশেরও কম আসে সদস্য দেশগুলোর বকেয়া থেকে। বাকিটা আসে সদস্য দেশগুলোর স্বেচ্ছা দান এবং জনহিতকর, আন্তঃসরকারি বেসরকারি খাতগুলো থেকে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জনস্বাস্থ্যসম্পর্কিত আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াগুলো তদারক করে। সদস্য দেশগুলোকে প্রমাণভিত্তিক গাইডলাইন প্রদান করে রোগের শ্রেণীকরণ দূরীকরণের জন্য। সদস্য দেশগুলো তাদের রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং প্রাদুর্ভাবের খবর দেয়ার জন্য দায়বদ্ধ। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাই কেবল পারে জনস্বাস্থ্যে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে। তারাই বিশ্ব জনস্বাস্থ্যে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থা জারি করতে পারে। যা অতিরিক্ত অর্থনৈতিক সহায়তাও উন্মুক্ত করে। সেই প্রক্রিয়ায়ই কভিড-১৯ নিয়ে ৩০ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে তারা।

সংস্থাটির প্রায়োগিক ক্ষমতা নেই। এটা আইন কিংবা আদেশ তৈরি করতে পারে। যদিও আন্তর্জাতিক কমিউনিটি সংস্থাটিকে আদর্শিক কর্তৃত্ব দেয় সদস্য দেশগুলোর মাঝে। যা সাধারণত এটাকে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় জনস্বাস্থ্য সংস্থার স্বীকৃতি দেয়।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহার কেন জটিল

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে প্রত্যাহার করে নেয়ার ঘটনা নজিরবিহীন। ১৯৪৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন সরে গিয়েছিল সংস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যে উদ্বেগ দেখিয়ে। সে সময় সংস্থার গঠনতন্ত্রে প্রত্যাহারের কোনো বিধান ছিল না, যে কারণে সোভিয়েতও টেকনিক্যালি প্রত্যাহার করতে পারেনি। মূলত ১৯৫৬ সালে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত সোভিয়েত নিষ্ক্রিয় সদস্য হিসেবে ছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নাম প্রত্যাহার করা জটিল প্রক্রিয়ার বিষয়। কারণ সংস্থা ছাড়ার জন্য এক বছরের নোটিস দিতে হবে এবং বর্তমান অর্থবছর শেষ করতে হবে। আরেকটি জয়েন্ট কংগ্রেশনাল রেজল্যুশনের মাধ্যমে কেবল সরে আসা সম্ভব। এছাড়া প্রেসিডেন্টের সরে আসার একতরফা সাংবিধানিক কর্তৃত্বও নেই। তবে আসন্ন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনও এখানে বিবেচনার বিষয়। কারণ নতুন প্রেসিডেন্টও এর মাঝে চলে আসতে পারেন। সেক্ষেত্রে ডেমোক্র্যাটদের সম্ভাব্য প্রার্থী জো বাইডেন এরই মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

যদি তা হয় তবে কী হবে?

শেষ পর্যন্ত তবে কী হবে তা নিয়ে পর্যবেক্ষকরা বেশ উদ্বিগ্ন। ২০১৮-১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র সংস্থার শীর্ষ অনুদানদাতা। যাদের অনুদানের পরিমাণ ৮৯৩ মিলিয়ন ডলার। সংস্থার দ্বিবার্ষিক বাজেটে যুক্তরাষ্ট্রের অনুদান প্রায় ১৫ শতাংশ। অর্থায়ন ঘাটতি দেখা দিলে বৈশ্বিক জরুরি অবস্থা মোকাবেলায় সংস্থার ক্ষমতা হ্রাস পাবে। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন গবেষণাসহ আরো নানা দিকে সংস্থাটিকে ক্ষতির মুখে ফেলবে।

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন