বিদেশযাত্রা বন্ধ

খুচরা বাজারে ডলারের কোনো চাহিদাই নেই

হাছান আদনান

প্রতি বছর হজ মৌসুমে ডলারের চাহিদা তুঙ্গে ওঠে খুচরা বাজারে (কার্ব মার্কেট) চাহিদা বাড়ায় ব্যাংকিং চ্যানেলের সঙ্গে দামের ব্যবধান বড় হয়। অনেক সময় ব্যবধান ছাড়িয়ে যায় টাকা। কিন্তু এবার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ উল্টে দিয়েছে নভেল করোনাভাইরাস।

বর্তমানে ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়েও কম দামে ডলার বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। চাহিদা না থাকায় লেনদেনও নেমে এসেছে প্রায় শূন্যের কোটায়।

করোনাভাইরাসের তাণ্ডবে এবার হজে যেতে পারছেন না ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। অভিবাসন, ভ্রমণ, চিকিৎসা কিংবা অন্য যেকোনো প্রয়োজনেও বাংলাদেশীদের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে বিশ্বের দুয়ার। কর্মস্থলে ফিরতে পারছেন না দেশে আসা প্রবাসী বাংলাদেশীরা। নতুন ভিসা ইস্যু হওয়ার পথও প্রায় বন্ধ। বিপর্যয়কর পরিস্থিতিই খুচরা বাজারে ডলারের বিপুল দরপতনের কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

গতকাল রাজধানীর মানি চেঞ্জারগুলো (খুচরা বাজার) গ্রাহকদের কাছ থেকে ডলার কিনেছে সর্বোচ্চ ৮৪ টাকা ৬০ পয়সায়। আর ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রতি ডলারের মূল্য ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা। অথচ বছরের শুরুতে খুচরা বাজারে প্রতি ডলারের দাম ৯১ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। তখন ব্যাংকিং চ্যানেলের সঙ্গে খুচরা বাজারে প্রতি ডলারের মূল্য ব্যবধান ছিল প্রায় টাকা। একই পরিস্থিতি হয়েছে বহুল ব্যবহূত অন্যান্য আন্তর্জাতিক মুদ্রায়ও। ক্রেতা না থাকায় বৈদেশিক মুদ্রার খুচরা বাজারের লেনদেন কাঠামো পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে।

ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়েও খুচরা বাজারে ডলারের দাম কমে যাওয়াকে নজিরবিহীন বলছেন ব্যাংকাররা। বাংলাদেশ ব্যাংকও বিষয়টিকে দেখছে অস্বাভাবিক হিসেবে। এজন্য ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রতি ডলারের দাম এক ধাপে ১৫ পয়সা কমিয়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ১৭ জুন ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রতি ডলারের নির্ধারিত দাম ছিল ৮৪ টাকা ৯৫ পয়সা। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দর ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় নামিয়ে এনেছে। যদিও এর চেয়ে কম দরে গ্রাহকদের কাছে ডলার বিক্রি করার প্রস্তুাব দিচ্ছে অনেক ব্যাংক, যেখানে তিন মাস আগেও বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত দরের চেয়ে ডলারপ্রতি অন্তত এক টাকা বেশি আদায় করত ব্যাংকগুলো।

পরিস্থিতিতে বাজারে ডলারের দর ধরে রাখতে তত্পরতা বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি মাসের প্রথম দিনেই বাজার থেকে ৩৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার কিনে নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তার পরও ব্যাংকগুলোর হাতে অতিরিক্ত ডলার থেকে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন শীর্ষ নির্বাহীরা।

চাহিদা না থাকায় ডলারের দরপতন হয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক কাজী সাইদুর রহমান। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক বণিক বার্তাকে বলেন, রেমিট্যান্সে বড় প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি দেশের রফতানি খাতও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। অন্যদিকে আমদানি খাত এখনো সচল হয়নি। বাংলাদেশীদের বিদেশ যাওয়ার পথও প্রায় বন্ধ। এসব কারণে ডলারসহ বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা একেবারেই কম। ডলারের দর ধরে রাখতে ব্যাংকগুলো থেকে আমরা প্রতিনিয়ত ডলার কিনছি।

কয়েক বছর ধরেই ডলারের সংকট চলছিল দেশের বাজারে। আমদানির অস্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি সংকটকে তীব্র করে তুললে ব্যাংকগুলোর কাছে প্রতিনিয়ত ডলার বিক্রি করতে হয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। ধারাবাহিকতা ছিল ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম আট মাস পর্যন্ত। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস সংক্রমণের ব্যাপকতা ছড়িয়ে পড়লে ফেব্রুয়ারি থেকেই কমতে থাকে দেশের আমদানি। একই সঙ্গে ধস নামে রফতানি রেমিট্যান্সের আয়েও। তার পরও বাজার স্বাভাবিক রাখতে মার্চ থেকে ডলার কিনতে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত অর্থবছরে ৮৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিক্রির বিপরীতে বাজার থেকে ৮৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার কিনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অথচ চলতি জুলাই মাসের প্রথম নয় দিনেই কিনেছে ৩৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার। রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যাংকগুলো থেকে কেনা ডলার যুক্ত হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। ফলে গত এক মাসেই রিজার্ভে যুক্ত হয়েছে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার।

ক্রেতা কম বিক্রেতা বেশি হওয়ার কারণে দেশে ডলারের মূল্য নিম্নমুখী বলে মনে করেন রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী মো. আতাউর রহমান প্রধান, যিনি বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) চেয়ারম্যানের দায়িত্বেও রয়েছেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বাজারে ডলারের সরবরাহ আগের মতোই আছে। কিন্তু চাহিদায় বড় পতন হয়েছে। খুচরা বাজার থেকে কেনা ডলার দিয়ে মানুষ সাধারণত বিদেশ ভ্রমণ কেনাকাটায় ব্যয় করত। বর্তমানে বাংলাদেশীদের বিদেশ যাওয়াই প্রায় বন্ধ। কারণেই খুচরা বাজারে ডলারের কোনো ক্রেতা নেই। ব্যাংকের তুলনায় খুচরা বাজারে ডলারের দাম কমে যাওয়া একেবারেই নজিরবিহীন নয়। তবে ধরনের পরিস্থিতি সচরাচর দেখা যায় না।

কার্ব মার্কেটে ডলার লেনদেনের বড় মাধ্যম হলো মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্স নিয়ে দেশে বর্তমানে ২৩৫টি মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম পরিচালনা করছে। করোনাভাইরাসের আগ্রাসন শুরুর পর থেকেই এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায় ধস নেমেছে। দৈনন্দিন খরচ না ওঠায় অনেক মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠান বন্ধও রয়েছে।

রাজধানীর বসুন্ধরা শপিং মল থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করে মিয়া মানি এক্সচেঞ্জ। গতকাল মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানটির কর্তব্যরত কর্মী জানান, ব্যবসা নেই বললেই চলে। দৈনিক যে ব্যবসা হচ্ছে তা দিয়ে কর্মীদের দুপুরের খাবারের দামও মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিষ্ঠানটি গতকাল গ্রাহকদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ ৮৪ টাকা ৬০ পয়সায় ডলার কিনেছে বলে জানান তিনি।

রাজধানীর মতিঝিলে বৈদেশিক মুদ্রার বেচাকেনা করেন আব্দুল কাদের। ভ্রাম্যমাণ হয়ে বৈদেশিক মুদ্রা বেচাকেনা করা ব্যক্তি জানান, মাস খানেক আগেও খুচরা বাজারে ডলারের দাম ৯০ টাকা ছিল। কিন্তু ইতালিসহ ইউরোপের দেশগুলোর শেনজেন ভিসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই খুচরা বাজারে ডলারের দামে পতন হয়েছে। শুধু ডলারই নয়, বিদেশী কোনো মুদ্রাই গ্রাহকরা কিনছেন না। কিছু গ্রাহক ডলার বা অন্য কোনো বিদেশী মুদ্রা বিক্রি করার জন্য আসছেন কিংবা ফোন করছেন। কিন্তু দামের কথা শুনে কেউ ফিরে যাচ্ছেন। আবার কেউ কম দামে বিক্রি করে দিচ্ছেন। ক্রেতা না থাকায় তিনিসহ ভ্রাম্যমাণ অন্যরাও মানি চেঞ্জারগুলোর জন্য ডলার কিনছেন বলে জানান।

শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশীরা হজ পালন করতে যেতে পারছেন না। আর ওমরায় যাওয়ার পথও বন্ধ। একই সঙ্গে ভ্রমণ, চিকিৎসা, অভিবাসনসহ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের প্রায় সব খাতই স্থবির। ঈদ উপলক্ষে বিদেশে গিয়ে শপিং করার পথও বন্ধ। এসব কারণেই খুচরা বাজারে ডলারের চাহিদা ৯০ শতাংশ কমে গেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন