মাস্কে প্রযুক্তি আর ফ্যাশনের মিশেল

ইরিন ব্ল্যাকমোর

যদি মহামারীর কোনো মাস্কট থাকে তবে সেটি সাধারণভাবেই হবে ফেস মাস্ক। মাস্কের ব্যবহারকে ঘিরে পক্ষে-বিপক্ষে যে আন্দোলনগুলো হয়েছে কভিড-১৯-এর যুগকে আর কিছু এর চেয়ে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না।

প্রথমত কর্তাব্যক্তিরা বলেছিলেন মুখ না ঢাকতে। উদ্বেগ ছিল যে অতিরিক্ত মাস্ক ব্যবহার হাসপাতালের ব্যবহূত মাস্কের স্বল্পতা তৈরি করতে পারে। কিন্তু কয়েক মাস পরই সিডিসি এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, উভয় পক্ষই সুর বদলে ফেলে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব না হলে তারা মাস্ক পরতে বলে। সিডিসি এখন বলছে, যখনই সুযোগ হয় মাস্ক পরে থাকতে। এমনকি জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত ২১টি রাজ্যে আইন করে মাস্ক পরার কথা বলা হয়েছে।

যদিও মাস্ক এখনো কোনো কোনো সামাজিক পরিসরে ট্যাবু হিসেবে বিবেচিত। কেবল ৬০ শতাংশ বয়স্ক মানুষ বলেছেন তারা সবসময় মাস্ক পরেন ঘরের বাইরে গেলে। মাস্ক পরার সম্মতি পরিবর্তিত হয় বয়স, ভৌগোলিক অঞ্চল, আয় এবং সম্ভবত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারাও।

পক্ষপাতমূলক রাজনীতিকে এজন্য দোষ দেয়া সহজ। কিন্তু এর বাইরে মাস্কের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শনের অন্যতম কারণ হতে পারে এটি দেখতে মোটেই স্টাইলিশ না এবং মানুষের মুখের আকারের ওপর নির্ভর করে এটি অস্বস্তিকরও হতে পারে। কিছু মাত্রায় এটি সামাজিকীকরণের চিহ্ন হিসেবে পরিচিত হাসি, চাহনি মুখের অন্যান্য ইঙ্গিতকেও হরণ করে। এছাড়া শুরুতে মাস্ক সম্পর্কে নেতিবাচক কথা শোনার পর অনেকে এখন বিভ্রান্ত কখন কীভাবে মাস্ক পরতে হবে তা নিয়ে। প্রশ্ন হচ্ছে কার্যকর মাস্ক হিসেবে এমন কিছু কি রয়েছে যা সবাই পরতে চাইবে। প্রকৌশলী, পদার্থবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী ফ্যাশন ডিজাইনারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে সেটি কেমন হতে পারে।

পদার্থবিজ্ঞানের আলাপ

সার্স-কোভ- ভাইরাস কভিড-১৯-এর জন্য দায়ী। মনে হচ্ছে একে হারানো যেন অসম্ভব। কিন্তু এখনো এটি পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মে বিবেচনার বিষয়। ফ্লুইড ডায়নামিকস নিয়ে যারা গবেষণা করেন তারা একটি মডেল কম্পিউটার সিম্যুলেশন তৈরি করেছেন ভাইরাল কণাগুলো বাতাসে ছড়িয়ে দিলে কী ঘটে তা দেখার জন্য। তারা দেখেন কীভাবে হাঁচি জীবাণুকে ছয় ফুটের বেশি দূরে নিয়ে যেতে পারে। যখন একজন ব্যক্তি হাঁচি কাশি দেন তখন তা ড্রপলেটের ক্লাউড তৈরি করে। বড় ড্রপলেট তুলনামূলকভাবে দ্রুত পড়ে যায় এবং অ্যারোসল তথা অতি ক্ষুদ্র কণা বাতাসে চালিত হতে পারে। তার জমা হতে হতে একপর্যায়ে কোনো শক্তি দ্বারা বিস্ফোরিত হতে পারে। এরপর সেটি বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। আর সেখানেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে মাস্ক। বলা হচ্ছে, মাস্ক পরলে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে শতাংশ। যেখানে মাস্ক না পরলে সেটি হতে পারে ১৭ শতাংশ।

ডিজাইনের বিষয়

মহামারীর আগে মেডিকেল কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সাধারণত সার্জিক্যাল মাস্ক কিংবা এন৯৫ ব্যবহার করতেন। যা এমনভাবে ডিজাইন করা হয় যে বড় ছোট সংক্রামক কণাগুলো মানুষের দেহে প্রবেশের আগে তাকে ফিল্টার করে ফেলতে পারে। কিন্তু মহামারীর সময়ে এই মাস্কের সংকট দেখা দিয়েছে, কারণ চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। তখন সাধারণ মানুষকে কাপড়ের তৈরি মাস্ক পরার কথা বলা হয়। যা কিছুটা হলেও সুরক্ষা দিতে পারে। কিন্তু এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো ড্রপলেটকে নিজের মাঝে রেখে অন্যকে রক্ষা করা।

ঘরে বানানো মাস্ক ড্রপলেটের বিস্তারকে কতটা প্রভাবিত করতে পারে, সে সম্পর্কে গবেষকরা অল্পই জানতে পেরেছেন। কিন্তু এটা বদলাতে চান মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার সিদ্ধার্থ ভার্মা। তিনি বলেন, আমরা দেখি না, বাতাস কী করতে পারে। ভার্মা ম্যানিকুইন (পোশাক প্রদর্শনের জন্য বানানো মানবমূর্তি), স্মোক মেশিন এবং লেজারের সাহায্য নেন। পরে তিনি তার দল ম্যানিকুইনকে গড় মানুষের সমান করে স্থাপন করেন। এরপর তিনি বিভিন্ন ধরনের কাপড়ের মাস্ক দিয়ে এটিকে ঢেকে দেন এবং স্মোক মেশিনের সাহায্যে নকল কাশি তৈরি করেন। এরপর কৃত্রিম কাশিকে লেজারের সাহায্যে ফুটিয়ে তোলা হয় এবং গবেষকদের সুযোগ করে দেয়া হয় কফের আউটপুটের চলাচলের চিত্র খুঁজে পেতে।  পরীক্ষায় কয়েকটি পরিষ্কার বিষয় ছিল। যেখানে খোলা মুখ থেকে কাশির ড্রপলেট আট ফুট পর্যন্ত ভ্রমণ করতে পারে। সেখানে সাধারণ দুই স্তরের সুতির ফ্রেবিক দ্বারা তৈরি মাস্ক ভেদ করে ড্রপলেট যেতে পারে মাত্র . ইঞ্চি পর্যন্ত। একইভাবে আরো কয়েকটি পরীক্ষায় দেখা গেল, বিভিন্ন ধরনের মাস্ক আলাদাভাবে সুবিধা দিতে পারে। ভার্মা বলেন, যখনই সুযোগ থাকবে আপনি শক্তভাবে বোনা ফেব্রিক মাস্ক পরবেন, যাতে সবচেয়ে কম ফুটো রয়েছে।

ফাংশন ফ্যাশনের বিষয়

মাস্ক পরলে সংক্রমণ কমে এমন অনেক প্রমাণ সামনে আসার পরও অনেকেই মাস্ক পরতে চায় না। তারা এটাকে অস্বস্তিকর, সীমাবদ্ধ অবাধে শ্বাস নিতে বাধা প্রদান করে বলে মনে করে। তবে এটিকে সমস্যা মানছেন না ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মদ মুস্তফা হুসাইন। তিনি এবং কিং আবদুল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির তার সহকর্মীরা মিলে এরই মধ্যে ভিন্ন ধরনের উপাদান তৈরি করেছেন, যা কিনা সবাইকে শ্বাস-প্রশ্বাসে আরো বেশি সুবিধা দিতে পারবে।

বর্তমানে তিনি তিনটি কোম্পানিকে প্রযুক্তিটির লাইসেন্স দিয়েছেন, যারা মেডিকেল এবং বাণিজ্যিক দুই ধরনের মাস্কই তৈরির কাজ করে। এখন মাস্ক তৈরির কাজে যুক্ত হচ্ছেন ডিজাইনাররাও। টেকনোলজি ফ্যাশন একসঙ্গে কাজ করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরাও।

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন