সাহেদদের এখনই থামানোর আহ্বান আ.লীগ তৃণমূলের

তানিম আহমেদ

বাংলাদেশের ইতিহাসের আওয়ামী লীগ একমাত্র টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায়। আর এতে রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মোহাম্মদ সাহেদ করিমদের মতো সুবিধাবাদীদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে। দলটির তৃণমূলের নেতারা বলছেন, সাহেদের মতো সুবিধাবাদীদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড প্রায়ই আলোচনাই আসে। এতে করে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে, জনগণের বিব্রতকর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে তৃণমূলের। আর তাই এখনই তাদের লাগাম ধরার আহ্বান জানিয়েছেন কেন্দ্রের প্রতি। 

আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতারা বলেন, টানা ক্ষমতায় থাকার কারণে দলের মধ্যে এক ধরণের সুবিধাবাদী শ্রেণী গড়ে উঠেছে। তারা নিজের আখের গোছাতে বিভিন্ন অপকর্ম করছে। এর আগে ক্যাসিনো কর্মকাণ্ডে জিকে শামীম, পাপিয়াদের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছিল। এখন আবার করোনা  মহামারীর সময়ে সাহেদরা আলোচনায় এসেছেন। এসব সুযোগ সন্ধানীদের বিষয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের আরও সজাগ দৃষ্টি রাখার আহ্বান জানান তারা।   

তারা বলেন, জেলাতেও অনেক সুযোগসন্ধানী নেতা তৈরি হয়েছে। যারা এরই মধ্যে কোটিপতি হয়ে গেছেন। এতে অনেক বড় বড় নেতার আনুকূল্য পাচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেন তারা। তৃণমূলের নিগৃহীত নেতাদের এ বিষয়ে ক্ষোভও আছে।  দীর্ঘদিনের পরিচিত নেতাকর্মীরা অনেকেই না খেয়েই আছেন। অনেকেই বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। হঠাৎ করে দলে আসারা কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছেন। সাহেদদের মতো লোক দলে আছে বলে কিছুদিন বাদে একটি কাণ্ড ঘটে আর আওয়ামী লীগ সরকারের অর্জন ম্লান হয়ে যায়।

সম্প্রতি আলোচনায় আসা রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. শাহেদ ২০১৬ সালের সম্মেলনের পরে গঠিত কমিটির আন্তর্জাতিক উপ-কমিটির সদস্য ছিলেন। সেই পদের অপব্যবহার করে নানান অনিয়ম করেন তিনি। ২০১৬ সালের উপ-কমিটির সহ-সম্পাদকের পদ নিয়ে নানান বির্তক উঠেছিল সেই সময়। কমিটিগুলো বাতিল করার জন্য সাবেক ছাত্রনেতারা আন্দোলনও করে। তাদের আন্দোলনের মুখে ওই কমিটিগুলো বাতিল করার ঘোষণাও দিয়েছিলেন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। কিন্তু প্রস্তাবিত ওই কমিটির নেতারা নিজেদের পুরো মেয়াদেই উপ-কমিটির সদস্যের পরিচয় দিয়েছিলেন।সেই পরিচয় ব্যবহার করে করেছেন নানান অপকর্ম। 

জানা গেছে, ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটিতে স্থান পাওয়া ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের রাজনীতিতে সক্রিয় রাখতে ৬৬ জনের তালিকা প্রকাশ করে আওয়ামী লীগ। কিন্তু পরে সেই পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগেই কয়েক ধাপে বেড়ে সাত শতাধিক হয়েছিল বলে জানা গেছে।  ২০১৬ সালের সম্মেলনের আগে তৎকালীন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ওবায়দুল কাদের সহ-সম্পাদক নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের বিশেষ পরিস্থিতিতে এ তালিকা দীর্ঘ হয়ে গেছে। এখন আওয়ামী লীগ অফিসের পাশে হাঁটতে গিয়ে কোনো তরুণের সঙ্গে ধাক্কা লাগলে বলে ‘আমি সহ-সম্পাদক’। কীসের সম্পাদক? আওয়ামী লীগের সহ-সম্পাদক!

পরে ২০তম সম্মেলনে উপ-কমিটির সহ-সম্পাদকের পদ নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল। সর্বশেষ ২১তম সম্মেলনে সহ-সম্পাদক পদ বাদ দেয়া হয়। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের ২৫(৬) ধারায় উল্লেখ আছে, সংগঠনের প্রত্যেক বিভাগের কার্যক্রম অধিকতর গতিশীল ও সমন্বিত করার লক্ষ্যে প্রতিটি সম্পাদকীয় বিভাগের একটি করে উপ-কমিটি গঠন করবে। এ উপ-কমিটি একজন চেয়ারম্যান, একজন সম্পাদক, প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিশেষজ্ঞ সদস্য, সংশ্লিষ্ট সহযোগী সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং নির্দিষ্ট সংখ্যক সদস্য সমন্বয়ে গঠিত হবে। এর আগে আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে এই সব উপ-কমিটিতে অনুর্ধ্ব পাঁচজন সহ-সম্পাদক ছিলো।

সাবেক ছাত্রনেতারা বলেন, সাহেদ, খালেদ ও পাপিয়ারাই শুধু নয়, এমন সংখ্যা কত? গোনায় শেষ হবে না। দল টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় বিভিন্ন দল থেকে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কাঠামোয় অনুপ্রবেশ ঘটেছে। কিছু কেন্দ্রীয় নেতা নিজেদের প্রটোকল বাহিনী বড় করতে বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের নেতাকে দলে ভেড়ান। কখনই তাদের রাজনৈতিক খতিয়ান দেখেননি। কেউ কেউ বিশেষ সুবিধা নিয়েও পদ-পদবি দিয়েছেন। কিংবা সহযোগী সংগঠনের পদ দিতে বাধ্য করেছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের।

টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুর রহমান ফারুক বলেন, আদর্শিক রাজনীতির অভাব দেখা দিয়েছে। ফলে রাজনীতিতে ঘুনে ধরেছে। আওয়ামী লীগ যে একটি আদর্শের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেটা অনেকেই ভুলে গেছেন। এমপি-মন্ত্রী এবং নেতা সবাই এখন নিজর সুরক্ষা চান। নিজেকে দলের চেয়ে শক্তিশালী হিসেবে গড়ে তুলতে চান বলেই ভুঁইফোড় নেতারা আজ আওয়ামী লীগে শিকড় গজিয়ে বসেছে। নেতৃবৃন্দ সজাগ না হলে এর পরিণাম ভয়াবহ হয়ে উঠবে। ফারুক বলেন, সারাদেশেই ভুঁইফোড়রা জায়গা করে নিয়েছেন এবং এদের সংখ্যা অগণিত।

ভোলা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুল কাদের মজনু মোল্লা বণিক বার্তাকে বলেন, এই মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে সব কাজ হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়া এবং সে দলের যত বড় নেতাই হোক কেন তাকে ছাড় দেয়া যাবে না। নেত্রীও বলেছেন এ বিষয়ে তিনি জিরো টলারেন্সে যাবেন। কিন্তু অনেকক্ষেত্রে অনেক সীমাবদ্ধতার জন্য সেটা সম্ভব হয়ে উঠছে না। এ বিষয়ে শক্ত অবস্থান না নিলে দল বিপর্যয়ে পড়বে। 

তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ক্ষমতা থাকলে দলের মধ্যে একটা শৈথিল্য আসে এবং পরিচিত নেতাকর্মীরা পিছিয়ে যায়। পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের মতো কমিউনিস্ট পার্টি দীর্ঘদিন তারাও ক্ষমতার মধ্যে থাকায় বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। তাদের মধ্যে একটি সুযোগসন্ধানী গ্রুপ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল। কিছু সংখ্যক লোক শহুরে বাবুতে পরিণত হয়েছিল। আমাদের মধ্যেও তাই। দলকে বাঁচাতে ও গতিশীল করতে হলে তৃণমূলের পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের বাছাই করে তাদের নিয়ে আসতে হবে। এখনও তৃণমূলের অসংখ্য নিবেদিত প্রাণ নেতাকর্মী আছেন। তাদেরকে সুযোগ করে দেয়া গেলে দল অনেক এগিয়ে যাবে। 

মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজল কৃষ্ণ দে বণিক বার্তাকে বলেন, একটা হলো আদর্শবাদী আরেকটা হলো সুবিধাবাদী। যেই দলই ক্ষমতায় থাকুক আদর্শবাদীরা সবসময় কোণঠাসা থাকে। তারা কখনোই সুযোগসন্ধানী কর্মকাণ্ড করে না। আর সুবিধাবাদীরা যখন যেই দল ক্ষমতায় থাকে সেই দলে প্রবেশ করে এবং তারা নিজেদের ব্যক্তিগত সুবিধা হাসিল করার জন্য যে নেতাকে যেভাবে তুষ্ট করার দরকার সেভাবে তুষ্ট করে নিজেদের ফায়দা হাসিল করে। কিন্তু তাদের এমন কর্মকাণ্ডের জন্য আমাদের দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। তাই আমি মনে করি, অনুপ্রবেশকারী সবদলের জন্যই ক্ষতিকারক। তাই অনুপ্রবেশকারীদের বিষয়ে সর্তক ও সজাগ থাকা উচিত। 

তিনি বলেন, প্রতিটি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাদের দায়িত্ব হলো এই সকল অনুপ্রবেশকারী ও সুবিধবাদীরা যাতে দলের মধ্যে প্রবেশ করতে না পারে সেই বিষয়ে খোঁজ রাখার।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান বণিক বার্তাকে বলেন, সুবিধাবাদীদের সুবিধা নেয়ার প্রচেষ্টা সব দেশের সব সংগঠনেই আছে। এটা নতুন কিছু না। সকল পেশায় এমন চরিত্র আছে। এটা আওয়ামী লীগেও আছে। যা আমাদের জন্য লজ্জাজনক ও দুঃখজনক। তবে আওয়ামী লীগ এক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেয় নাই। দেশের আইনানুযায়ী অতীতেও সাজা হয়েছে। ভবিষ্যতেও হবে। 

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ কোনো অনিয়মকে অতীতেও প্রশ্রয় দেয়নি, আগামীতেও দেবে না। সংগঠনের কেউ অনিয়ম করলেও ছাড় দেয়া হয় নাই।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন