শ্রমিক আন্দোলন থামাতে বিজেএমসির এক বছরে ব্যয় ৬৬ কোটি টাকা!

সাইদ শাহীন

দেশের বেসরকারি পাটকলগুলো মুনাফায় থাকলেও ক্রমাগত লোকসানেই চলেছে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) অধীন সরকারি পাটকলগুলো। সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরেও বিজেএমসির অধীন পাটকলগুলো লোকসান দিয়েছে প্রায় ৫৭৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে শুধু শ্রমিক আন্দোলন থামাতেই ব্যয় হয়েছে প্রায় ৬৬ কোটি টাকা।

পরিসংখ্যান বলছে, স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র তিনবার মুনাফার দেখা পেয়েছে বিজেএমসি। এর মধ্যে সর্বশেষ ২০১০-১১ অর্থবছরে প্রায় সাড়ে ১৭ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল সংস্থাটি। এর পর থেকে প্রতি বছর ক্রমাগত লোকসানেই রয়েছে সংস্থাটি। বিপুল পরিমাণ ক্ষতির জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর অব্যবস্থাপনা পরিচালনাগত অদক্ষতাকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে আয়, ব্যয় লোকসানের পরিসংখ্যান (প্রভিশনাল) এবং লোকসানের কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বিজেএমসি দেখিয়েছে, সময় বিভিন্ন কারখানায় শ্রমিক আন্দোলন থামানো গেট মিটিং পরিচালনায় সংস্থাটির ব্যয় হয়েছে ৬৫ কোটি ৮৭ লাখ টাকা, যা মোট লোকসানের প্রায় সাড়ে ১১ শতাংশ। এছাড়া সিবিএ কার্যক্রম পরিচালনায় ব্যয় হয়েছে কোটি ১৩ লাখ টাকা, যা মোট লোকসানের দশমিক ৫৫ শতাংশ।

গত দুই বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়ন বা কারখানাগুলোর আধুনিকায়নে বড় ধরনের বিনিয়োগ হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া শ্রমিকদের জন্য কোনো বরাদ্দ বা সহযোগিতার কোনো অর্থও দেয়া হয়নি বলে দাবি তাদের। একই সঙ্গে আন্দোলন থামাতে শ্রমিকদের কোনো অর্থ দেয়া হয়নি বলেও জানিয়েছেন তারা। বিষয়ে খুলনার ক্রিসেন্ট জুট মিলের প্রকল্প প্রধান কামরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, শ্রমিক আন্দোলন থামাতে শ্রমিকদের অর্থ প্রদানের প্রশ্নই ওঠে না। আমরা গত কয়েক বছরে শুধু কারখানার নিয়মিত পরিচালনা ঠিক রাখার জন্য কিছু যন্ত্রাংশ মেরামত করেছি। কিন্তু নতুন কোনো যন্ত্র বসানো হয়নি। আধুনিকায়ন কিংবা ধরনের কোনো বিনিয়োগ কারখানায় হয়নি।

বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক . খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বণিক বার্তাকে বলেন, ধরনের ব্যয় করার আইনি বৈধতা আছে কিনা, বা থাকলেও কী ধরনের ব্যয়ের স্বাধীনতা আছে, সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের ব্যয়কে বিভিন্ন নামে চালিয়ে দেয়ার যে প্রবণতা, সেটি ধরনের তথ্যের মাধ্যমে উঠে এসেছে। শ্রমিকদের ঠিকভাবে বেতন দিতে পারে না, অথচ কিছু শ্রমিক প্রশাসনিক কর্মকর্তা ধরনের নামে কিংবা সুবিধাজনক খাত দেখিয়ে অর্থ সরিয়ে নিচ্ছে। ফলে শ্রমিকদের উন্নয়নে যে অর্থ সরকার দিচ্ছে, সেটি আসলে তাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। দীর্ঘদিন ধরেই ধরনের অনৈতিক ব্যয় খরচ দেখিয়ে আসছে কিছু সুবিধাবাদী গোষ্ঠী। তাই বিজেএমসি থেকে কতটুকু কারা কীভাবে সুবিধা নিয়েছে, সেটি দেখার জন্য আন্তর্জাতিক মানের অডিটের মাধ্যমে এগুলো বের করা দরকার। সেটি কারখানা পর্যায় থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হতে হবে।

বিষয়টি নিয়ে বিজেএমসি কর্তৃপক্ষ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

বিজেএমসি সূত্রে জানা গেছে, এর আগে ২০১৭-১৮ অর্থবছরেও মোট ৪৯৭ কোটি ১৮ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছিল বিজেএমসি। অন্যদিকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে লোকসান ৫৭৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকায় উন্নীত হয়। লোকসানের কারণ বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সময় কারখানাগুলোয় অতিরিক্ত হাজার ১৭৭ জন অস্থায়ী শ্রমিক নিয়োজিত করতে হয়েছে। এজন্য ৪৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে, যা মোট লোকসানের দশমিক ৮৭ শতাংশ। ব্যাংকঋণের সুদ বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে ৭৫ দশমিক ১১ কোটি টাকা, যা ক্ষতির ১৩ দশমিক ১০ শতাংশ। সক্ষমতা অনুসারে উৎপাদন না হওয়ার কারণেই ২০১৮-১৯ অর্থবছর সবচেয়ে বেশি লোকসানে পড়তে হয়েছে সংস্থাটিকে, যার পরিমাণ ৩৩৪ কোটি ৪১ লাখ টাকা বা মোট লোকসানের ৫৮ দশমিক ৩০ শতাংশ। বিশ্লেষণে বিদ্যুৎ বিভ্রাট বাবদ ২৭ কোটি ২৫ লাখ টাকা ক্ষতির কথাও তুলে ধরা হয়েছে।

এছাড়া ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সামাজিক দায়বদ্ধতা বাবদ ২২ কোটি ৬৭ লাখ টাকা ব্যয়ের কথা জানানো হয়েছে বিশ্লেষণে। যদিও বিষয়টিতে আপত্তি তুলছেন দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানার বেশ কয়েকটি শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা। বিষয়ে যশোরের কার্পেটিং জুট মিল শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক বাদশা মিয়া এবং খুলনার প্লাটিনাম জুট মিলের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ন কবির খান বণিক বার্তাকে জানান, সিবিএ অফিস চালানোর জন্য কোনো ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক বরাদ্দ তারা পান না। কোনো ধরনের আন্দোলন হলে মিল বাঁচানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা থেকে তারা নিজ উদ্যোগে শ্রমিকদের বুঝিয়েছেন। টাকার বিনিময়ে কোনো কাজ করেননি। ফলে এখানে অর্থ আসার কোনো প্রয়োজনও নেই।

জানা গেছে, বর্তমানে দেশে পাটপণ্য উৎপাদনে বিজেএমসির অবদান মাত্র দশমিক ২১ শতাংশ। রফতানিতে হার আরো কম, দশমিক শতাংশ। নামমাত্র উৎপাদন অনুল্লেখ্য রফতানির জন্য সরকারি বাজেট থেকে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকির মাধ্যমে সংস্থাটির মিলগুলোর কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। পাশাপাশি প্রয়োজনের অধিক শ্রমিক দিয়ে এসব মিল পরিচালনা করা হলেও সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন করতে না পারারও অভিযোগ রয়েছে। ফলে প্রতি বছরই বাড়তে থাকে লোকসানের পরিমাণ। স্বাধীনতার পর অল্প কয়েকবার মুনাফার দেখা পেয়েছে সংস্থাটি।

এদিকে অপ্রয়োজন হলেও সংস্থাটির কারখানাগুলোয় প্রতি বছর নিয়োগ দেয়া হয়েছে প্রচুর শ্রমিক। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরেও বিজেএমসির কারখানাগুলোয় শ্রমিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে ৬২ হাজার ১১৩ জন। প্রয়োজনের অধিক শ্রমিক নিয়োগ দেয়া হলেও উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হয়নি। উল্টো তা ছিল বরাবরের মতোই নিম্নমুখী।

২০১৮-১৯ অর্থবছরেও সংস্থাটির উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল লাখ ১০ হাজার ৬৪১ টন, এর বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে মাত্র ৬৯ হাজার ১১১ টন। সময় দৈনিক গড় উৎপাদন ছিল ২৪৯ দশমিক ৬২ টন, যা আগের অর্থবছরেও (২০১৭-১৮) ছিল ৪৭০ দশমিক ৫৭ টন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন