নভেল করোনাভাইরাসের প্রকোপ সামাল দিতে প্রাথমিকভাবে প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপের আশ্রয় নিয়েছে সারা বিশ্ব। কিন্তু মহামারীটির কারণে যে হারে প্রাণহানি ঘটছে, তাতে এর প্রতিষেধক আবিষ্কারের কোনো বিকল্প নেই। কভিড-১৯ রোগের সংহারী রূপ থেকে বাঁচতে এখন সেদিকেই তাকিয়ে রয়েছে বিশ্ব। কিন্তু আশঙ্কার কথা হলো প্রতিষেধক নিয়ে যে জাতীয়তাবাদের লড়াই শুরু হয়েছে, তা ধীরে ধীরে ‘আর্মস রেস’-এর রূপ ধারণ করছে। ইউরেশিয়া গ্রুপের বিশ্লেষকরা এমনটাই মনে করছেন। খবর সিএনবিসি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী গ্রীষ্মের পুরোটা সময়ই দেশগুলো নভেল করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক দখলের লড়াইয়ে মত্ত থাকবে। এমনকি এ লড়াই ২০২১ ও ২০২২ সাল পর্যন্ত চলতে পারে বলে ধারণা করছেন তারা। এক নোটে তারা বলেছেন, ‘ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সব দেশই প্রতিষেধক সংগ্রহের জন্য আগ্রাসী হয়ে উঠবে, যা রাজনীতি, অর্থনীতি ও জনস্বাস্থ্যের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে। বিদ্যমান আন্তর্জাতিক সংস্থা ও চুক্তিগুলোকে ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদের এ লড়াই থামাতে বেশ বেগ পেতে হবে।
ইউরেশিয়া গ্রুপ বলছে, কয়েকটি দেশের সরকার এরই মধ্যে প্রতিষেধকের অগ্রাধিকারভিত্তিক দখল নিতে চাইছে। এ লক্ষ্যে মোটা অংকের বিনিয়োগও করেছে তারা।
নোটে বলা হয়েছে, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বায়োমেডিকেল অ্যাডভান্সড রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিএআরডিএ) এরই মধ্যে বিভিন্ন ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছে, যেন কোম্পানিগুলোর আর্থিক ঝুঁকি কিছুটা কমে যায় এবং কোনো কার্যকর প্রতিষেধক আবিষ্কার হলে প্রথম চালানটা যেন তারা পায়।’
মার্কিন বায়োটেক কোম্পানি মডার্না, ফরাসি ওষুধ কোম্পানি সানোফি ও ব্রিটিশ কোম্পানি গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইনে বিনিয়োগ রয়েছে বিএআরডিএর। গত মে মাসে তারা অ্যাস্ট্রাজেনেকার সম্ভাব্য প্রতিষেধকের জন্য ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা এ প্রতিষেধক আবিষ্কারের কাজ করছেন। ব্রিটিশ-সুইডিশ ওষুধ কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকা ২০০ কোটি ডোজ প্রতিষেধক উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছে। এর মধ্যে ৪০ কোটি ডোজ আগামী অক্টোবর নাগাদ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের কাছে সরবরাহের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
অ্যাস্ট্রাজেনেকার এ সম্ভাব্য প্রতিষেধকের জন্য ব্রিটিশ সরকারও কয়েক কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের কয়েকটি দেশ থেকেও ৮৪ কোটি ৩০ লাখ ডলারের পেমেন্ট পকেটে পুরেছে কোম্পানিটি।
এদিকে কানাডা সরকারের ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিল চীনের ক্যানসাইনো বায়োলজিকসের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছে। চুক্তি অনুযায়ী, কানাডায় ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য প্রতিষেধক তৈরি করবে ক্যানসাইনো।
প্রতিষেধকের দখল নিয়ে এ হানাহানির ভয়ানক পরিণতির বিষয়ে সতর্ক করেছেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির বিশ্বায়ন ও উন্নয়নবিষয়ক অধ্যাপক ও বিশ্বব্যাংকের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ইয়ান গোল্ডিনও। তিনি বলেন, ‘দেশগুলো যদি করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক সরবরাহের বিষয়টিকে জাতীয়তাবাদের ইস্যুতে পরিণত করে, তবে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ।’
গোল্ডিন আরো বলেন, ‘কিছু প্রতিযোগিতা রয়েছে, যেগুলো মঙ্গলজনক। আপনি নিশ্চয়ই সম্ভাব্য প্রতিষেধকের কার্যকারিতার সব পরীক্ষা একটি দেশে চালাতে চাইবেন না। কারণ সেক্ষেত্রে সেটি কার্যকর প্রমাণ নাও হতে পারে। কিন্তু আবিষ্কৃত প্রতিষেধক অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এমন কোনো দেশের হাতে তুলে দেয়া উচিত নয়, যাদের অনেক অর্থ রয়েছে। কেবল তাদের জনগণই বাঁচবে আর গরিব দেশের মানুষ মরবে, তা তো হতে পারে না।’
তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘গোটা বিশ্বকে করোনা মহামারী থেকে সুরক্ষা দিতে না পারলে অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। যতদিন বিশ্বের কিছু অঞ্চলে করোনার প্রকোপ থেকে যাবে, ততদিন বিশ্ব অর্থনীতিও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। এই ভাইরাস কোনো এক জায়গায় থেকে গেলে সেখান থেকে পুনরায় ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগবে না। ফলে বিশ্ব অর্থনীতির একটি অংশ ধ্বংস হয়ে যাবে। ’