চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে কাঁচামাল আমদানিতে উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আমদানি পর্যায়ে অগ্রিম আয়কর (এআইটি) হিসেবে সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরে ৬ হাজার ১৫০ কোটি টাকা কেটে রেখেছে চট্টগ্রাম কাস্টমস। এনবিআরের হিসাবে এ সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৮ কোটি ২৭ লাখ ৫৫ হাজার টন পণ্য আমদানি হয়েছে, যার আর্থিক মূল্য মোট ২ লাখ ৯২ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। দেশে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের ৯২ শতাংশই চট্টগ্রাম বন্দরকে ঘিরে সমুদ্রপথে পরিচালিত হয়।
এদিকে কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে ব্যবসায়িক সক্ষমতা কমে যাওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে অগ্রিম আয়কর (এআইটি) তুলে নেয়ার দাবি জানিয়েছিলেন শিল্প মালিকরা। যদিও সদ্য পাস হওয়া নতুন অর্থবছরের বাজেটে তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। এতে বিশেষ করে বড় কারখানা শিল্প মালিকদের পরিচালন মূলধনের সংকট তৈরি করতে শুরু করেছে। ব্যবসায়িক কার্যক্রম স্থবিরতার মধ্য দিয়ে চললেও ব্যাংক থেকে উদ্যোক্তাদের নেয়া চলতি মূলধন ও প্রজেক্ট মূলধনি যন্ত্রপাতির জন্য নেয়া ঋণের সুদ ও আসলও বাড়ছে চক্রবৃদ্ধি হারে।
ইস্পাত খাতের শিল্প-কারখানার মালিকরা বলছেন, ইস্পাত খাতে কাঁচামাল আমদানিতে টনপ্রতি অগ্রিম আয়কর (এআইটি) হিসেবে ৫০০ টাকা করে কেটে রাখা হচ্ছে। কোম্পানি মুনাফা বা লোকসান যা-ই করুক, এআইটি আগেই পরিশোধ করতে হবে। এছাড়া এ খাতটির জন্য বিক্রির পর্যায়ে টিডিএস (ইনকাম ট্যাক্স ডিডাকটেড আর সোর্স) নির্ধারিত রয়েছে ৩ শতাংশ। ইস্পাত খাতের উদ্যোক্তাদের দাবি, এ খাতে এতদিন গড়ে ২ থেকে ৩ শতাংশ পর্যন্ত প্রফিট করে আসছিলেন। কিন্তু এ আয়কর পরিশোধ করে ব্যবসা পরিচালনা করতে হলে তাদের এখন কয়েক গুণ বেশি প্রফিট করতে হবে। এদিকে কভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে দুই বছর কোনো ধরনের লাভ করারই সুযোগ নেই।
আনোয়ার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মনোয়ার হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এআইটি সমন্বয়যোগ্য নয় অর্থাৎ এখান থেকে আমরা রিফান্ড পাচ্ছি না। সরকার এটাকে মিনিমাম ট্যাক্স বলে দিয়েছে। বছর শেষে আয়ের ওপর কর ধার্য করা হলে সেটাই সঠিক হতো। পৃথিবীজুড়ে স্বীকৃত পদ্ধতি হলো, আমার আয় হবে সে অনুযায়ী আয়কর দেব। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে ঘটছে উল্টো। আমার ব্যবসা লাভ হবে না লোকসান হবে, কিংবা লাভ হলেও তা কতটুকু এটা আগে থেকে জানি না। কিন্তু মিনিমাম ট্যাক্স ধরে আমার কাছ থেকে তা কেটে নেয়া হচ্ছে। তার মানে আমার ক্যাপিটাল থেকে এটা পরিশোধ হবে। এমনিতে ইস্পাত খাত গড়ে ২ থেকে ৩ শতাংশ লাভ করে আসছিল। আমরা এতেই খুশি ছিলাম। ব্যবসা পরিচালনা করতে হলে এখন ১৪ শতাংশ লাভ করতে হবে। এটা কি সম্ভব? কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে এ বছর তো লস করেছেই, আগামী বছরও আমাদের প্রফিটে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’
কাঁচামাল আমদানিতে অগ্রিম কর কেটে রেখে ইস্পাত খাতকে বিপদে রাখা হয়েছে বলে মনে করছেন দেশে ইস্পাত খাতের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি বিএসআরএমের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, এ প্রক্রিয়ায় ইনভেস্টমেন্টের আগেই আমাদের বড় অংকের টাকা চলে যাচ্ছে। ইস্পাত খাতে আমদানি পর্যায়ে প্রতি টন কাঁচামালের ক্ষেত্রে ৫০০ টাকা ফিক্সড করে রাখা হয়েছে এআইটি। এছাড়াও দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে ফিনিশড গুড বিক্রয় পর্যায়ে (টিডিএস) ৩ শতাংশ দিতে হচ্ছে। দুটোই মিনিমাম ট্যাক্স করে দেয়া হয়েছে। এখন অবস্থা এমন যে মুনাফা তো নেই, ফলে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল থেকে সরকারকে ট্যাক্স দিতে হচ্ছে। এভাবে ব্যবসা কতটুকু এগোবে। ব্যবসা করার আগেই প্রতি টনে ৫০০ টাকা নির্ধারিত অগ্রিম আয়কর নেয়ার ফলে আমি লাভ না করলেও দিতে হচ্ছে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল থেকে। এ খাত স্বাভাবিক সময়েই ২ শতাংশ প্রফিট করাটা অনেক কঠিন। তাহলে এখন কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে কী করব আমরা।
সিমেন্টের কাঁচামাল আমদানিতে ৩ শতাংশ এআইটি কেটে রাখছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এ খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, নভেল করোনাভাইরাসের কারণে ব্যাপক ক্ষতিতে দেশের সিমেন্ট শিল্প খাত। সরকার ঘোষিত লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকেই কঠিন একটি সময় পার করছে খাতটি।
সিমেন্ট খাত এমনিতেই লোকসানের মধ্যে রয়েছে উল্লেখ করে প্রিমিয়ার সিমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমদানি মূল্যের ওপরে ৩ শতাংশ এআইটি কেটে রাখা হচ্ছে আমাদের কাছ থেকে। পাবলিক লিস্টেড কোম্পানির জন্য কোম্পানি অ্যাক্টে ২৫ শতাংশ ট্যাক্স নিয়ম করা হয়েছে। দেশের বিদ্যমান আইনটিতে কিন্তু কোনো সংশোধনী আনা হয়নি। এদিকে ৩ শতাংশও ফাইনাল করে রেখেছে। এটা কোনোভাবেই ন্যায়সংগত নয়। কোম্পানি লস করলেও আমাকে বাধ্যবাধকতায় এআইটি দিতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, কোনো শিল্প কাঁচামালের ক্ষেত্রে কখনো ১৫ শতাংশ ডিউটি হতে পারে না। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন ক্লিংকার ৪০ ডলার চলছে কাস্টমস, তখনো ৫০ ডলার হিসাব করে এআইটি নিয়ে নিচ্ছে। এতে শুধু উদ্যোক্তা হিসেবে আমি একা ভুগছি, তা নয়। তালিকাভুক্ত কোম্পানি হওয়ায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও এতে ভুক্তভোগী হচ্ছেন।
বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমএ) সভাপতি মো. আলমগীর কবির এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কভিড-১৯ পরিস্থিতি দেশের উদ্যোক্তাদের যে পর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়েছে, সেখানে মুনাফা করার সময় নয় এখন। এটা আমাদের টিকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টার সময়। বড় ধরনের সংকটের মধ্যে উৎপাদন বন্ধ হলেও শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা যেমন প্রদান করতে হয়েছে, তেমনি বন্ধ হয়নি অবচয় হিসাবও। এর মধ্যে এ অযৌক্তিক আয়করের চাপ নিয়েই ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে ।’
