গুরুত্বারোপ

পাটকল বন্ধ না করে দুর্নীতি বন্ধ করুন

আশেক মাহমুদ

সরকার পরিচালিত পাটকলগুলো বন্ধ করার ঘোষণা নিতান্তই জাতীয় স্বার্থ শ্রমজীবী মানুষের অধিকারবিরোধী। এই করোনাকালে অভাবী আর শ্রমজীবী এমনকি নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর দুর্দিন চলছে। বৈশ্বিক জাতীয় দুর্যোগে জনগণের সমস্যা অধিকার বিষয়ে সরকারকে অত্যন্ত দূরদর্শিতার সঙ্গে কাজ করতে হয়। গার্মেন্ট শিল্পে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের খবর শুনে আমরা তখন মর্মাহত হয়েছি, অথচ সরকার নিয়ন্ত্রিত পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্ত মর্মবেদনাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। এটা তো শ্রমিকদের বেতন বকেয়ার প্রশ্ন নয়, এটা ২৫টি পাটকলের ২৫ হাজার শ্রমিকের জীবন-জীবিকার প্রশ্ন, ওদের বেঁচে থাকার প্রশ্ন, ওদের পরিবারের অস্তিত্বের প্রশ্ন। 

দেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত পরে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজেএমসি) সে সময় বিজেএমসির অধীনে ছিল ৭৭টি পাটকল, পাটকল বন্ধ হতে হতে সংখ্যা ২৫- দাঁড়ায়। এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল আদমজী জুট মিল বন্ধ হয় প্রতিষ্ঠার ৫২ বছর পর ২০০২ সালের ৩০ জুন। বিশ্বব্যাংকের কারসাজিতে পড়ে তত্কালীন সরকার বাংলার এই ঐতিহ্য বন্ধ করে এটিকে ইপিজেডে পরিণত করে। বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ শুনে তখনকার সরকার এটাই বুঝিয়ে দিল যে জনগণের অধিকার বিষয়ে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা সেই সরকারের ছিল না। বেসরকারীকরণের জন্য তখন যে যুক্তি দেয়া হতো, এখনো সেই একই যুক্তি দাঁড় করানো হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংক আইএমএফের পরিকল্পনার মোদ্দাকথা হলো, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা মেনে নিলে তারা বড় অংকের ঋণ দেবে। আর সেই ঋণের দিকে তাকিয়ে থাকে পুরো আমলাতান্ত্রিক কাঠামো। সেই ঋণের নয়ছয় যতই হোক না কেন, বিশ্বব্যাংকের নিয়ে মাথাব্যথা নেই। আমাদের দেয়া হচ্ছে একটাই যুক্তিগত ১০ বছরে এসব পাটকল থেকে লোকসান দাঁড়িয়েছে হাজার ৮৪ কোটি টাকা, অথচ বেসরকারি কলগুলো প্রতি বছর লাভের মোটা অংক গুনছে। আরেকটা যুক্তি দেয়া হয়, বিজিএমইএ পরিচালিত কারখানাগুলোর তুলনায় বিজেএমসির পাটকলগুলোর মোট উৎপাদনে অবদান শতাংশ। সুতরাং পাটকলগুলো প্রতি বছর বড় অংকের লোকসান গুনলে প্রকারান্তরে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব আসবে; জনগণের করের টাকা দিয়ে সেই লোকসান পোষানোর চেয়ে সব বেসরকারীকরণ করে দিলেই ভালো। রকম যুক্তি খুবই সাদামাটাভাবে যে কেউ লুফে নিতে পারে। আমাদের নাগরিকশ্রেণীও একই সঙ্গে বলতে শুরু করে, সরকারি মালিকানায় থাকলে লোকসান বেশি, ফলে শ্রমিকদের রক্ষা করতে হলেও এর বেসরকারীকরণ দরকার। 

এর মানে আমরা এটাই মেনে নিচ্ছি যে সরকারি মালিকানা মানেই অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি আর লোকসান। কথাটা সরকারের সত্তাকে দুর্বল করে, শক্তিশালী করে না। বিশ্বব্যাংক আইএমএফের পরামর্শে যেমন জনগণের কল্যাণ নেই, সরকারি মালিকানায় লোকসানেও জনগণের অধিকার রক্ষিত হয় না। এর কারণ উৎপাদন, বিপণন এমনকি বহুমুখী বাজারজাতে জনগণের সামগ্রিক অধিকার হেরে যায় মুনাফার প্রতিযোগিতার কাছে। সরকার হারায় নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা, শ্রমিক হারায় অধিকার দাবির অধিকার আর রাষ্ট্র হারায় জাতীয়তার মৌলিকতা। এর উদাহরণ হিসেবে বলতে হয়, আদমজী জুট মিল বন্ধ হলে সেখানে ইপিজেড করা হয়েছে। আর  কর্মসংস্থান বেড়েছে ঠিকই, অথচ সেই ইপিজেডে ২৭টি বিদেশী, ১৩টি যৌথ মালিকানাধীন ১০টি বাংলাদেশী মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত হয়। ৫০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে শুধু ১০টির মালিকানা পায় বাংলাদেশীরা।

আমরা শুধু কর্মসংস্থানের সংখ্যাটা হিসাব করি, কিন্তু আমরা কি দেখেছি সেখানে বাংলাদেশ তার অস্তিত্ব হারিয়েছে। বিদেশীদের হাতে দেশের মিলগুলো ছেড়ে দেয়ার মধ্যে আমরা কেন যে আনন্দ পাই, তা আমার মাথায় আসে না। সরকারি মালিকানায় থাকা যে ২৫টি পাটকল, তা বন্ধ করে বেসরকারীকরণ করা হবে কথায় আমরা এক অদ্ভুত স্বস্তি পাই। কিন্তু আমরা কি জানি, এই করোনাকালে বেসরকারি মালিকশ্রেণীর আর্থিক সামর্থ্য কতটুকু? অন্যদিকে আমাদের দেশের ব্যাংক খাত এতটাই অপরিকল্পিত যে যেসব মালিক ব্যাংক থেকে লোন নেবেন, তাদেরকেই গুনতে হবে বড় অংকের সুদ। বেপরোয়া সুদের শিকলে পড়ার সুযোগটা নেবে বিদেশী কোম্পানিগুলো। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ তো চায় এমনটিই হোক।

এমনটি যদি হয় তাহলে আমাদের শ্রমিক, আমাদের পাট, আমাদের জমি থেকে অর্জিত মুনাফা যাবে বিদেশী কোম্পানিগুলোর ঘরে। আমরা হারাব রাজস্ব, মুনাফার দেশীয় ফল আর বিপণনের স্বাধীন অধিকার। অথচ যদি সরকারি মালিকানায় থাকে, তার ফল ভোগ করবেন প্রথমে পাটচাষীরা, কেননা পাটের ন্যায্যমূল্য দেয়ার দায়িত্ব সরকারের ওপর পড়ে। কিন্তু বেসরকারীকরণের ফলে পাটচাষীরা পুঁজিবাদী মুনাফা চক্রের ফাঁদে পড়তে বাধ্য হয়। এর পরে আসে বিপণন। বেসরকারীকরণের ফলে পাট খাতকে অধিক মুনাফা নীতি মেনে চলতে হয়। ফলে পাটজাত পণ্য কিনতে ক্রেতাদের গুনতে হয় অনেক টাকা। পাটজাত পণ্য ব্যবহারিক গুরুত্ব হারিয়ে শৌখিন পণ্যে পরিণত হয়। ফলে ভোক্তাশ্রেণীকে লুক্কায়িত শোষণ মেনে নিতে হয়। আর তাই জনসাধারণের অধিকার চিন্তা করেই শিল্পকে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে সরানো উচিত হবে না। বরং দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনার শিকল থেকে খাতকে বাঁচাতে উপযুক্ত করণীয় ঠিক করতে হবে। আমাদের দেখতে হবে কেন দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনার লাগাম টানা হচ্ছে না।

সমাজবিজ্ঞানী রাফ ডাহরেনডরফ (১৯৫৮) শিল্প-কারখানার ব্যবস্থাপনা নিয়ে যে তত্ত্ব হাজির করেন, তাতে তিনি উল্লেখ করেন যে কারখানায় মালিকানা আর নিয়ন্ত্রণ একীভূত হয়ে কাজ করছে না, মূলত ম্যানেজমেন্ট বডির নিয়ন্ত্রণে কারখানার কাজ চলে। তার মতে, ম্যানেজমেন্ট বডির কর্মকর্তাদের মধ্যে সবাই কোনো না কোনোভাবে অস্পষ্ট গ্রুপে অবস্থান করে, কিন্তু স্বার্থের চেতনায় এক অংশ স্বার্থ দল (ইন্টারেস্ট গ্রুপ) গঠন করে। ডাহরেনডরফের ভাষায়, সেই স্বার্থ দল স্বার্থগত কারণেই স্বার্থদ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। আমাদের দেশের কারখানা ব্যবস্থাপনার দিকে তাকালে দেখা যায়, ম্যানেজমেন্ট বডিতে আলাদা করে ইন্টারেস্ট গ্রুপ বানাতে হয় না, এখানে কোনো অস্পষ্ট গ্রুপ নেই, বরং সবাই স্বার্থের জায়গায় এক হয়ে গেছে, শুধু শ্রমিকরাই ভিকটিম গ্রুপে পড়ে থাকেন। সে কারণে স্পষ্ট (ম্যানিফেস্ট) আর লুক্কায়িত (ল্যাটেন্ট) স্বার্থের ভেদরেখা এখানে টানা যায় না। সবাই মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ-এর মতো সব কর্মকর্তা মিলেমিশে যদি দুর্নীতি করেন তাহলে শ্রমিকরা কী করে পাবেন পর্যাপ্ত মজুরি আর কারখানা কী করে দেখবে লাভের মুখ! দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের দল এতই ভারি যে এখানে সৎ ব্যক্তির অস্তিত্ব পাওয়া কঠিন, যদি কিছু থেকে থাকে, তাদেরকেও নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়।

অবস্থায় প্রশাসনিক আইনি পদক্ষেপ জরুরি। কিন্তু প্রশাসনিক কাঠামোকে নৈতিক মানদণ্ডে দাঁড় করানো জটিল হচ্ছে, কেননা এরা নিজেরাই আখের গোছাতে ব্যস্ত। দুর্নীতির দুষ্ট চক্র এখন আর কাজ করে না, এখন কাজ করে দুর্নীতির গুচ্ছচক্র। পাট বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের আমলাতান্ত্রিক কাঠামোয় যদি সুনীতি কার্যকর না হয় তাহলে পাট শিল্পে ভালো ব্যবস্থাপনা কী করে আসবে? পাট শিল্পের গুচ্ছ দুর্নীতি, আমলাতন্ত্রের গুচ্ছ দুর্নীতি আর বিশ্বব্যাংকের হস্তক্ষেপ যদি চলতেই থাকে তাহলে আমরা লোকসান দেখতেই থাকব। সেই লোকসান ঠেকাতে বেসরকারীকরণ করতে গেলে জাতি নিজেই লোকসানে পড়বে। সেদিক চিন্তা করে দ্রুত পরিস্থিতি পাল্টাতে সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে।

প্রতিটি ক্ষেত্রে গুচ্ছ দুর্নীতির মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে আনতে হলে প্রথমেই আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সাজাতে হবে সৎ দায়িত্বশীল অফিসারদের পদায়ন করে, পাটকলের ব্যবস্থাপনাকে শক্ত নিয়মনীতি জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে আর বিশ্বব্যাংকের সাজানো ছক থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কেননা জনগণের অধিকার সমুন্নত করাই আমাদের স্বাধীনতার মৌলিক দাবি।   

 

আশেক মাহমুদ: সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

পিএইচডি গবেষণাধীন, ইউনিভার্সিটি অব মালয়া

[email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন