করোনার হটস্পটে পশুর হাট না বসানোর সুপারিশ কারিগরি পরামর্শক কমিটির

বড় স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে আমলে নেয়া হোক

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে। প্রতিদিনই মারা যাচ্ছে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ। করোনা সংক্রমণ থেকে সুরক্ষিত থাকার একটি পরীক্ষিত উপায় হলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, সঙ্গনিরোধ তথা জনসমাগম এড়িয়ে চলা। সেই প্রেক্ষাপটে আসন্ন ঈদুল আজহা ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্থানে কোরবানির পশুর হাটের আয়োজন জনমনে উত্কণ্ঠা বাড়িয়ে দিয়েছে। যেখানে কাঁচাবাজার কিংবা শপিংমলগুলোতেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, ভিড় এড়ানো যাচ্ছে না, সেখানে পশুর হাটে তা পরিপালন কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। তাই সংগত কারণেই নভেল করোনাভাইরাস (কভিড-১৯) নিয়ন্ত্রণে হটস্পট হিসেবে পরিচিত ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর চট্টগ্রামে পশুর হাট না বসানোর সুপারিশ করেছে কভিড-১৯-বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কারিগরি কমিটি। এছাড়া সংক্রমণের বিস্তার রোধে ঈদের ছুটিতে চার এলাকা থেকে দেশের অন্যান্য স্থানে যাতায়াত বন্ধ রাখারও পরামর্শ দিয়েছে কমিটি। বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে আলোচ্য পরামর্শ আমলে নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।

করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন সময়ে নানা স্বাস্থ্য নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সেগুলো খুব একটা কার্যকর ভূমিকা রাখেনি। সবখানেই স্বাস্থ্য নির্দেশনাগুলো ঢিলেঢালাভাবে পরিপালন হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে মানুষ একদমই সেগুলো মেনে চলেনি, এখনো চলছে না। এখানে একটা তদারকিরও বিষয় আছে। শুধু নির্দেশনা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করলে হয় না, যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা, তাও তত্ত্বাবধান করতে হয়। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অবস্থা লেজেগোবরে। সংস্থাটি মানুষকে স্বাস্থ্যনির্দেশনা পরিপালন বা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় যেমন উদ্বুদ্ধ করাতে পারেনি, তেমনি সঠিক সময়ে দৃঢ়তার সময়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতেও ব্যর্থ হয়েছে। ফলে দেশে করোনার বিস্তার প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। অবস্থায় পশুর হাট আয়োজনের বিষয়টি বাড়তি উদ্বেগের জন্ম দিচ্ছে। বিশেষত এক্ষেত্রে ঝুঁকি বেশি থাকছে করোনার স্পটগুলোয়। এসব জায়গায় অভিনবমূলক পদক্ষেপ দরকার। সংশ্লিষ্টদের তরফে বলা হচ্ছে, বেশি ঝুঁকিপূর্ণ জেলাগুলোয় আবাসিক বা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা বা শহরের কেন্দ্রস্থলে পশুর হাট বসানো হবে না। নিঃসন্দেহে এটা ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। কিন্তু তার পরও প্রশ্ন থেকে যায়। আবাসিক এলাকার বাইরে খেলার মাঠ বা যেখানেই পশুর হাট বসবে, সাময়িক হলেও সেখানে লোকসমাগম বাড়বে। প্রতিটি হাটে যে প্রচুরসংখ্যক ক্রেতা বিক্রেতা ভিড় জমাবেন, তাদের স্বাস্থ্যবিধি মানানো বিরাট কর্মযজ্ঞ। প্রয়োজনীয় মাস্ক, গ্লাভস, স্যানিটাইজার সরবরাহের পাশাপাশি বর্ধিত লোকবলেরও প্রয়োজন হবে। সবচেয়ে বড় কথা, এত কিছুর পরেও ঝুঁকি এড়ানো যাবে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। কাজেই উল্লিখিত জেলাগুলোর ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ বিবেচনা নেয়াই সমীচীন হবে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, কোরবানির সঙ্গে মুসলমানদের ধর্মীয় বিধান পালনের বিষয়টি যেমন রয়েছে, তেমনি কোরবানির বাজারের কথা ভেবে যে লাখ লাখ খামারি পশু পালন করে থাকেন, তাদের জীবিকার প্রশ্নও আছে। প্রেক্ষাপটে ভার্চুয়াল পশুর হাটই উত্তম বিকল্প ব্যবস্থা হতে পারে। এটি একটি ডিজিটাল প্লাটফর্ম, যেখানে অনলাইনে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে কোরবানির পশুর ক্রেতা বিক্রেতারা একসঙ্গে মিলিত হবেন। বিক্রেতা গরু, ছাগল বা কোরবানির উপযুক্ত পশুর স্থিরচিত্র বা ভিডিও দেখাবেন। গরুর দাম, বয়স, ওজন, কোথা থেকে আনা হয়েছে, এমন সব তথ্য থাকবে। কোরবানির হাটে গিয়ে ক্রেতা যেভাবে গরু যাচাই-বাছাই করেন, ঠিক সেভাবেই দেখা যাবে। পছন্দ হলে ক্রেতা গরু কিনবেন। ডিজিটাল উপায়ে, ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডে দাম পরিশোধ করা যাবে। ক্রেতা যেখানে চাইবেন, সেখানেই গরু পাঠিয়ে দেয়া হবে। সব দিক থেকেই এটি বাস্তবতাপ্রসূত। সুতরাং ডিজিটাল পদ্ধতিতে পশু কেনাবেচার ব্যবস্থা করা এখন সময়ের দাবি।

লক্ষণীয়, গত দু-এক বছর থেকেই বেশকিছু সংগঠন অনলাইনে কোরবানির পশু ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নিয়েছে। এবার আরো বেশি সংগঠন বা প্লাটফর্ম এতে যুক্ত হচ্ছে। ক্রেতাদের মধ্যেও এটা নিয়ে বিপুল আগ্রহ দেখা দিয়েছে। কোরবানির পশু কেনার জন্য তারা এখন এসব প্লাটফর্মে ঝুঁকছেন, করোনা সংকটের বিশেষ পরিস্থিতিতে এসব মাধ্যমের জনপ্রিয়তা আরো বাড়ছে। আমরা মনে করি, যত বেশি অনলাইনে কোরবানির পশু ক্রয়-বিক্রয় হবে, মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি তত কমবে, করোনার বিস্তার ঠেকানোও সহজ হবে। কাজেই সরাসরি পশুর হাট আয়োজনের বিপরীতে উল্লিখিত ডিজিটাল মাধ্যমে পশু কেনাবেচা সহজতর করতে স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর সর্বতো সহযোগিতা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। আরেকটি বিষয়, করোনা সংকটের মধ্যে কোরবানি ঈদ এসেছে শুধু বাংলাদেশে নয়; অন্যান্য মুসলিম দেশেও। তারাও নিশ্চয় পশু কেনাবেচা কোরবানির বিষয়টি সামলাচ্ছে। তারা কীভাবে করছে, তার খোঁজ রাখতে হবে। সংক্রমণ এড়াতে তারা কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে, সেগুলোও অনুসরণ করা যেতে পারে। ঈদুল আজহা ঘিরে নেয়া সরকারি পদক্ষেপগুলোয় উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা নয়, জনস্বাস্থ্য সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাক, সেটিই প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন