নভেল করোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) ফলে চাকরি হারিয়ে শহর থেকে গ্রামে ফিরছে একটা শ্রেণী। ফলে এক ধরনের রিভার্স মাইগ্রেশন বা উল্টো অভিবাসন তৈরি হচ্ছে, যা গ্রামীণ আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের ওপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করবে। এ অভিবাসনের ফলে মানবসম্পদের ওপর যে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে, সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ ও গ্রামাঞ্চলে সুযোগ-সুবিধা বিস্তৃত করা দরকার বলে মনে করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)। প্রতিষ্ঠানটি আয়োজিত নেটিজেন ফোরামের এক আলোচনা থেকে এমন বক্তব্য উঠে এসেছে।
বর্তমান মহামারীর ফলে বিরাজমান সংকট এবং আসন্ন সংকটের বিভিন্ন আঙ্গিক ও উত্তরণের উপায় নিয়ে দেশ ও দেশের বাইরের অর্থনীতিবিদ, গবেষক, উন্নয়নকর্মী, নীতিনির্ধারক এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলোচনার জন্য একটি ইন্টারনেটভিত্তিক প্লাটফর্ম ‘সানেম নেটিজেন ফোরাম’। এখন পর্যন্ত এ ফোরামের আটটি পর্ব অনুষ্ঠিত হয়েছে। সর্বশেষ পর্বটি গতকাল বেলা ১১টায় অনুষ্ঠিত হয়।
সানেমের নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হানের পরিচালনায় আলোচনায় জুম অ্যাপের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, শিক্ষার্থীসহ প্রায় ৪৫ জন এ পর্বে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া সানেমের গবেষণা পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সায়েমা হক বিদিশা, সানেমের রিসার্চ ইকোনমিস্ট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক মাহতাব উদ্দিন, সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট ইশরাত শারমীন এবং রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট ফাবিহা বুশরা এ আলোচনায় অংশ নেন।
নেটিজেন ফোরামের আলোচনায় বলা হয়, রিভার্স মাইগ্রেশন বা উল্টো অভিবাসনের ফলে গ্রামাঞ্চলে নতুন কিছু অর্থনৈতিক ও সামাজিক চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে। যেমন গ্রামীণ মজুরি কমে যেতে পারে। স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধি পেতে পারে, বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি পেতে পারে, লিঙ্গবৈষম্য আরো বিস্তৃত হতে পারে।
তবে আলোচকরা বলেন, এটি কৃষি উদ্যোক্তাদের জন্য একটি ভালো সুযোগও হতে পারে। কিন্তু এটি মনে রাখা জরুরি, যেহেতু ব্যাংকিং খাতের নাজুক অবস্থা ও নিম্নমুখী রফতানির জন্য বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কমে গেছে, ফলে গ্রামাঞ্চলে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করা বেশ কঠিন। এক্ষেত্রে আইসিটি ডিভিশন, স্থানীয় সরকারের সঙ্গে মিলে গ্রামাঞ্চলে তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির চেষ্টা করতে পারে।
নেটিজেন ফোরামের এ পর্বের শুরুতে ড. সেলিম রায়হান বাংলাদেশে চলমান মহামারী পরিস্থিতির সার্বিক অবস্থা ও সংশ্লিষ্ট আর্থসামাজিক চ্যালেঞ্জগুলোর ওপরে একটি প্রেজেনটেশন উত্থাপন করেন। যেখানে তিনি দেখান, বাংলাদেশের কভিড-১৯ রোগ পরীক্ষার সক্ষমতা বৃদ্ধি পেলেও পরীক্ষার সংখ্যা সেই অনুপাতে বৃদ্ধি পায়নি। যদিও বিশেষজ্ঞদের মতে দৈনিক কমপক্ষে ২০ হাজার পরীক্ষা করা উচিত, সমন্বয়হীনতা ও তথ্য-উপাত্তের অভাবে তেমনটি হচ্ছে না। অন্যদিকে ঠিকমতো লকডাউন বাস্তবায়ন না করায় মহামারী পরিস্থিতির ক্রমাবনতি ঘটছে। একই সঙ্গে শনাক্ত পরীক্ষায় দুর্নীতি পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলছে।
নিম্নমুখী আমদানি বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন ড. রায়হান। এছাড়া রেমিট্যান্সের রেকর্ড প্রবাহ নিয়ে অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের মতামত তুলে ধরে তিনি বলেন, আশঙ্কা করা হচ্ছে বর্তমানে যে রেমিট্যান্স আসছে, সেটি প্রবাসী শ্রমিকদের শেষ সঞ্চয়। প্রবাসী শ্রমিকদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের দেশে ফেরত আসার আশঙ্কা আরো বাড়ছে। বিশ্ব অর্থনীতির অবস্থারও উন্নতির কোনো সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে না।
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় বা রিজার্ভ কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে বছর কয়েক আগে প্রস্তাবিত সার্বভৌম বন্ডের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এটি একটি সম্ভাবনা হলেও এক্ষেত্রে অবশ্যই সতর্ক হতে হবে। তিনি মূল্যস্ফীতি নিয়েও আলোচনা করেন এবং বলেন, মূল্যস্ফীতির ফলে প্রকৃত আয় কমে গেছে। আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিতদের পুঁজি শেষ হয়ে যাচ্ছে। উদ্যোক্তাদের বাজারে টিকে থাকাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য ক্রমে সুযোগও সংকুচিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ বৃহৎ প্রণোদনা প্যাকেজের ঘোষণা দিলেও সেটি বিতরণের গতি শ্লথ। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের অর্থায়নের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর অবলম্বী না হয়ে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে এক্ষেত্রে সক্রিয় করা যায় বলে প্রস্তাব করেন তিনি।
ব্যাংকিং খাতের নানা প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কথা তুলে ধরে ড. রায়হান বলেন, ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতার জন্য প্রণোদনা প্যাকেজের বিতরণ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এজন্য প্রণোদনা প্যাকেজ বিতরণ ও বাস্তবায়নে একটি মনিটরিং ব্যবস্থা দাঁড় করানোর ওপরও জোর দেন তিনি।
স্বাস্থ্য খাত, ব্যাংক খাত ও কর আদায়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের কোনো বিকল্প নেই বলে মত দেন ড. রায়হান। তিনি বলেন, এবারের বাজেটে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, সেটি অবাস্তব। অন্যদিকে কর আদায়ে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের উদ্যোগ নেই। রাতারাতি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে ওঠা হয়তো সম্ভব নয়, কিন্তু অন্তত সঠিক দিকে পদক্ষেপ নেয়া দরকার।
অনুষ্ঠানে সানেমের পক্ষ থেকে উত্থাপন করা প্রস্তাবগুলোর ওপর ফোরামের সদস্যরা বিস্তারিত আলোচনা করেন। এ আলোচনায় বলা হয়, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ কার্যকরী হতে হলে ঋণের শর্ত শিথিল করতে হবে। এই ঋণগুলোর শ্রেণীকরণও লাভজনক নয়। সুদহারের ব্যাপারেও ছাড় দিতে হবে।
সানেম মনে করে, মহামারীর ফলে বাংলাদেশের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতি সুবিধার কথা ভুলে গেলে চলবে না। মনে রাখতে হবে এ সুবিধা আর ১০-১৫ বছরের জন্য থাকবে। যেহেতু বেসরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান তৈরি কঠিন হচ্ছে, সে কারণে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতে মনোযোগী হতে হবে। তবে এক্ষেত্রে ঋণ পাওয়া একটি সমস্যা।
বিষয়টি উদাহরণ দিয়ে আলোচনায় বলা হয়, গত বাজেটে তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদা করে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও এবারের বাজেটে এমন কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে স্বল্প পুঁজিতে সম্ভব এমন উদ্যোগ যেমন খাবারের ব্যবসা, অনলাইনে ট্রেনিং বা কোচিং ইত্যাদির ব্যপারে তরুণদের ভাবতে হবে।
চীন থেকে চলে যাওয়া বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার ব্যাপারে বাংলাদেশের মনোযোগী হওয়া উচিত বলে মনে করে সানেম। তবে এ বিষয়ে তারা বলছে, এক্ষেত্রে শুধু বিশেষ ইকোনমিক জোনের সুযোগ-সুবিধা যথেষ্ট নয়। লজিসটিকস পারফরম্যান্স ইন্ডিকেটরস, পোর্টের প্রক্রিয়া ও মানবসম্পদ উন্নয়নে এজন্য কাজ করতে হবে।
সানেমের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, নভেল করোনাভাইরাসের পরীক্ষার সংখ্যা বাড়াতে হবে। তবে এক্ষেত্রে পরীক্ষার মানে কোনো ছাড় দেয়া যাবে না। জনস্বাস্থ্য বিধি প্রয়োগে প্রকট সমন্বয়হীনতা দৃশ্যমান। এটি নিয়ে দ্রুত কাজ করতে হবে।
এছাড়া দারিদ্র্য মোকাবেলায় সরকারের উদ্যোগগুলো নিয়ে ডাটাবেজ তৈরি, সরকারি ও বেসরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বেতন কাটছাঁটের মাধ্যমে কৃচ্ছ্রসাধন করারও প্রস্তাব দিয়েছে বেসরকারি এ গবেষণা প্রতিষ্ঠান।