যখন পরিবারের কোনো সদস্য মারা যায়, তখন নাভাহোরা স্থানীয় রেডিও স্টেশনে একটি নোটিস পাঠায় যেন সম্প্রদায়ের সবাই জানতে পারে। মৃত ব্যক্তির নাম, বয়স, বসবাসের স্থান, মাতৃবংশ ও পিতৃবংশ-সংবলিত এ ডেথ নোটিসগুলো রেডিওতে পড়তে সাধারণত পাঁচ মিনিটের বেশি সময় নেয়া হয় না। সেখানকার রেডিওতে তরুণদের মৃত সংবাদ প্রচারের ঘটনা বিরল ছিল। তবে গত সপ্তাহে কেজিএকে রেডিওতে আমি ৪৫ মিনিট ধরে মৃত্যুর নোটিস শুনেছি। ২৬ থেকে ৮৯ বছর বয়সী মানুষদের এ মৃত্যুর নোটিসগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই ছিল ৩০, ৪০ ও ৫০ বছর বয়সীরা।
বলছিলেন সানি ডুলে। তিনি নাভাহোদের ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণে কাজ করেন। বাস করেন নিউ মেক্সিকোর চি চিল তাহ অঞ্চলে। নাভাহোরা যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফেডারেল স্বীকৃত আদিবাসী ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়। অ্যারিজোনা, উটাহ ও নিউ মেক্সিকোর ৭০ হাজার বর্গকিলোমিটার জায়গাজুড়ে এ সম্প্রদায়ের বসবাস।
তিনি বলেন, এত মৃত্যুর বিষয়টি শুনে আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। গত মার্চে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনার খ্রিস্টানদের বিভিন্ন কর্মসূচি থেকে কভিড-১৯ ভাইরাস আমাদের সম্প্রদায়ে প্রবেশ করেছিল। এটার জন্য চিকিৎসাসেবা প্রস্তুত না হওয়ায় তাত্ক্ষণিকভাবে আক্রান্তদের মৃত্যু হয়েছিল। এরই মধ্যে কভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে ৩০০ জনেরও বেশি নাভাহো মৃত্যুবরণ করেছে এবং ভাইরাসটি এখনো ছড়িয়ে পড়ছে।
নাভাহোদের অঞ্চলে এপ্রিলের শেষের দিকে কভিড-১৯-এর উপস্থিতি শনাক্ত হয়। ১ মে থেকে নিউ মেক্সিকোর মেয়র ওই অঞ্চলকে লকডাউন করে দেন। প্রথম সপ্তাহে লকডাউনের প্রভাব বোঝা না গেলেও কয়েকদিনের মধ্যেই সেখানে খাবার ও পানি শেষ হয়ে যায়। সেখানে ভূগর্ভস্থ পানি প্রাকৃতিকভাবে আর্সেনিক ও ইউরেনিয়াম দ্বারা দূষিত।
বাড়িতে একা বসবাস করা সানি ডলি বলেন, আমার বাড়িতে বিদ্যুৎ থাকলেও পানির উৎস নেই। আমার ভাই আমার জন্য পানি নিয়ে আসে। সেই পানি দিয়েই আমাকে সব কাজ করতে হয়। তবে পানি ফুরিয়ে গেলে আমি ৫ ডলার দিয়ে পাঁচ গ্যালন পানি কিনে রাখি। সবকিছুর জন্য প্রতিদিন আমাকে এক গ্যালন পানি ব্যবহার করতে হয়। আমার প্রমাতামহ বলতেন, ‘পানি খাওয়ার অভ্যাস করো না। কারণ এমন দিন আসবে, যখন পানির জন্য লড়াই করতে হবে।’
এজন্য আমি খুব অল্পতেই বাঁচতে শিখেছি।
আমাদের সম্প্রদায়ে প্রচুর ক্যানসার রোগী আছে, সম্ভবত ইউরেনিয়ামের কারণে। আগে থেকে বিদ্যমান থাকা স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্যে কভিড-১৯ ভাইরাসটি অনেক বেশি মারাত্মক হয়ে উঠেছে। আমাদের এখানে প্রচুর ডায়াবেটিস রোগী আছে, কারণ আমরা পুষ্টিকর খাবার খেতে পারি না এবং প্রচুর হূদরোগের রোগী আছে। মদ্যপান ও আত্মহত্যার হার এখানে খুব বেশি। কভিড-১৯ আমাদের দুর্বলতাকে স্পষ্ট করে তুলেছে। আমি ভাইরাসটিকে দানব হিসেবে দেখছি, যেটা আমাদের খেয়ে ফেলছে, কারণ আমরা নিজেদের নিখুঁতভাবে ভাইরাসের আক্রমণযোগ্য হিসেবে তৈরি করেছি।
এখন যেভাবে আমরা আমেরিকান জাতিগত বিষয়গুলো নিয়ে সরব হয়েছি, তেমনিভাবে বাস্তুচ্যুত দেশীয় আমেরিকান আদিবাসীদের নিয়ে কথা বলা উচিত। নিউইয়র্কের একটি রিজারভেশনে ২১ বর্গমাইলে ইরোকুইয়াস সম্প্রদায়কে রাখা হয়েছে। তারা মূলত কতটা জমিতে বাস করত? বর্তমান ম্যাসাচুসেটসে কারা বাস করত? আব্রাহাম লিংকন ক্রিসমাসের পরের দিন ৩৮ জন ডাকোটা পুরুষ হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন, অথচ মানুষজন তাকে কত সম্মান করে। তারা বিষয়গুলোর অন্ধকার দিক সম্পর্কে কথা বলে না। আমি মনে করি কভিড-১৯ এটাই আমাদের সামনে স্পষ্ট করে দিয়েছে।
কভিড-১৯ বিশ্বের সব জায়গাতেই অনেক সত্য প্রকাশ করেছে। আমরা অনেক সত্য সম্পর্কে অজ্ঞ থাকলেও এখন তা দেখতে পাচ্ছি। মূল সত্যটি হলো বৈষম্য—স্বাস্থ্য, উন্নয়ন ও মানবিক মূল্য সবখানে। কিন্তু সত্য প্রকাশের পরও কি এগুলো পরিবর্তন হবে?
এ বৈষম্য নিয়ে আমরা কী করতে যাচ্ছি?
সায়েন্টিফিক আমেরিকান