ভারত কি চীনে সরবরাহ বন্ধ করতে পারবে?

বণিক বার্তা ডেস্ক

অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ রুটগুলো নিয়ে চ্যালেঞ্জ বৈশ্বিক জ্বালানি বাণিজ্যে নতুন কিছু নয়। হরমুজ প্রণালি নিয়ে ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি পাল্টা-হুমকি নিত্যদিনের ব্যাপার। কিন্তু বিশ্বের দুই শীর্ষ জ্বালানি তেল ভোক্তা দেশের মধ্যকার একই ধরনের বিবাদে খুব সম্ভবত এখন পর্যন্ত প্রস্তুত নয় পণ্যটির বাজার। ভারত চীনের ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধিতে নতুন করে আলোচনায় উঠে এসছে মালাক্কা প্রণালি, যা বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি তেল পরিবহন রুট। খাতসংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন, দুই দেশের উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্কের জেরে মালাক্কা প্রণালির নিরাপত্তাজনিত অনিশ্চয়তা বাড়তে পারে।

মালাক্কা প্রণালি দক্ষিণ চীন সাগরের মধ্য দিয়ে পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগর পশ্চিমে ভারত মহাসাগরকে সংযুক্ত করেছে। ৮৯০ কিলোমিটার বিস্তৃত প্রণালিটি দুই মহাসাগরের মধ্যকার প্রধান শিপিং চ্যানেল হিসেবে পরিচিত এবং এটি বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিপিং লেন। মধ্যপ্রাচ্য থেকে এশিয়ার বাজারে বিশেষ করে চীন, জাপান উত্তর কোরিয়ায় জ্বালানি তেল আদান-প্রদানের সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত সুবিধাজনক সামুদ্রিক রুট এটি। এশিয়ার সামুদ্রিক বাণিজ্যের প্রধান চোখপয়েন্ট ধরা হয় প্রণালিটিকে। ইউএস এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (ইআইএ) তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মালাক্কা প্রণালি হয়ে দৈনিক গড়ে কোটি ৬০ লাখ ব্যারেল পেট্রোলিয়াম পরিবহন করা হয়েছে, এর মধ্যে ৮৫-৯০ শতাংশই অপরিশোধিত জ্বালানি তেল।

ভারত চীনের সম্পর্ক বরাবরই নড়বড়ে। তবে সম্প্রতি উত্তেজনার পারদ সর্বোচ্চে উঠেছে। সীমান্ত নিয়ে দুই দেশের মধ্যকার উত্তেজনা গত ৫০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে হিংস্র রূপ নিয়েছে। এর জের ধরে সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে নিজ নিজ সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ বাড়িয়েছে উভয় দেশই। দুই দেশই পারমাণবিক শক্তিধর হওয়ায় বিশ্ববাসীর জন্য তা আরো উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে। পরিস্থিতিতে বেইজিং নয়াদিল্লিকে সর্বোচ্চ সংযম বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ।

পরিস্থিতিতে মালাক্কা প্রণালি চীনের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। ভারত কি প্রণালিটিকে ব্যবহার করে সত্যি চীনে জ্বালানি তেলের সরবরাহ কমিয়ে আনতে সক্ষম হবে? সম্প্রতি নেভি বিশেষজ্ঞ এইচআই সুতান বিষয়টি নিয়ে ফোর্বস ম্যাগাজিনে লিখেছেন। তিনি লিখেছেন, ভারত মহাসাগরে ভারতের অবস্থান এবং আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে দেশটির নৌবাহিনীর উপস্থিতি দিন দিন শক্তিশালী হয়ে উঠছে, যা মালাক্কা প্রণালির খুব কাছাকাছি। এতে ইন্দোনেশিয়া মালয়েশিয়ার মধ্যবর্তী সংকীর্ণ প্রণালিটি তাত্ত্বিকভাবে ভারতের নিয়ন্ত্রণে যেতে পারে। ফলে যে কোনো ধরনের ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, সংকট বা যুদ্ধের ক্ষেত্রে মালাক্কা প্রণালি বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়, যার মাধ্যমে চীনে জ্বালানি তেল সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে ভারত। কারণ বিশ্বের শীর্ষ জ্বালানি তেল ভোক্তা আমদানিকারক দেশ চীন তার মোট আমদানির ৮০ শতাংশ পেট্রোলিয়াম রাস্তা ধরেই আমদানি করে।

তবে মালাক্কা প্রণালি অবরোধ এখন পর্যন্ত কেবল একটি দূর সম্ভাবনা। কারণ প্রণালিটির ওপর কেবল চীনই নির্ভরশীল নয়। প্রতি বছর গড়ে ৬০ হাজারেরও বেশি জাহাজ চলাচল করে সরু সমুদ্র প্রণালি দিয়ে। গোটা বিশ্বের বার্ষিক বাণিজ্যের ২৫ শতাংশ ঘটে পথটি ধরে। প্রণালিটির ওপর চীনের বাইরে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, জাপান, তাইওয়ান দক্ষিণ কোরিয়া জ্বালানি তেলসহ অন্যান্য পণ্য আমদানি-রফতানিতে ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। এছাড়া পথটি বন্ধ হলে উত্তর এশিয়ার দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে জ্বালানি তেলের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে। সবচেয়ে বড় কথা মালাক্কা প্রণালি বন্ধ হলে ভারতের অভ্যন্তরীণ ক্ষয়ক্ষতিও কম হবে না।

তবে বিষয়ে বসে নেই চীনও। দেশটি এরই মধ্যে মালাক্কা প্রণালির বিকল্প রাস্তা খুঁজতে উঠে-পড়ে লেগেছে। বর্তমানে জ্বালানি তেলসহ সব ধরনের পণ্য বাণিজ্যে মালাক্কা প্রণালির ওপর নির্ভরতা হ্রাসে দুটি প্রকল্প চীনের হাতে রয়েছে। এর একটি বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পটির আওতায় ভারতের প্রতিবেশী পাকিস্তানের গোয়াদার বন্দর হয়ে মূল ভূখণ্ডে জ্বালানি তেল আনার পরিকল্পনা রয়েছে চীনের। অন্যটি হচ্ছে, আর্কটিক নর্থ সি রুট। ২০১৮ সালের চায়না আর্কটিক পলিসি প্ল্যান অনুযায়ী, টেকসই অর্থনৈতিক সামাজিক বিকাশের সুবিধার্থে আর্কটিকে একটি পোলার সিল্ক রোড নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে চীন। তবে চীনের পরিকল্পনাগুলো সম্পূর্ণ হতে এখনো কয়েক বছর সময় লেগে যেতে পারে। এর পরও এগুলো চীনের জ্বালানি তেল বাণিজ্যে মালাক্কা প্রণালির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনার যথাযোগ্য কোনো বিকল্প রাস্তা নয় বলেই মনে করেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

রয়টার্স অয়েলপ্রাইসডটকম অবলম্বনে

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন