অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের স্বরূপ দেখাচ্ছে উহান

লকডাউন প্রত্যাহারের তিন মাস পেরিয়ে গেছে। ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পথে এগিয়ে চলেছে চীনের উহান শহর, যেখানে নভেল করোনাভাইরাস প্রথম আঘাত হেনেছিল। তিন মাসে উহানের উত্তরণের পথটা খুব একটা মসৃণ নয়। কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে এখনো স্থবিরতা বিরাজ করছে। করোনার বিস্তার প্রতিরোধে আরোপিত লকডাউন শেষে স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফেরার প্রক্রিয়া শুরু করেছে বিশ্বের বিভিন্ন শহর। কিছু শহর অপেক্ষায় রয়েছে। অর্থনৈতিক উত্তরণের পথটা কেমন হতে পারে, সে বিষয়ে অন্য শহরগুলোর জন্য উদাহরণ হয়ে দাঁড়াতে পারে ভাইরাসের আঁতুড়ঘর উহান।

উহানের কোয়ারেন্টিন পিরিয়ড শেষ হয়েছে গত এপ্রিল। সেদিন যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে চীন। কারণ করোনার মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার পেছনে দায়ী করা হচ্ছে চীনকেই। ফলে উহানের স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাকে রীতিমতো যুদ্ধজয়ের সমতুল্য দেখা হচ্ছিল। এর মাধ্যমে চীন বিশ্ববাসীর সামনে মাথা উঁচু করে দাবি করার সুযোগ পেয়ে যায়দেখো, আমরা সফলভাবে করোনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছি।

উহানের কারখানা অফিসগুলো তাদের কার্যক্রমে ফিরেছে খুব দ্রুত। কিন্তু ভোক্তাব্যয়ে সে গতি এখনো ফেরেনি। লকডাউন উঠে যাওয়ার ৭৬ দিন পেরিয়ে গেলেও শহরটির বাসিন্দারা এখনো বেশ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। বাইরের খাবার কেনার পরিবর্তে উহানবাসী এখন ঘরে রান্না করে খাওয়াকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। কেনাকাটার ক্ষেত্রেও সশরীরে দোকানে যাওয়া এড়িয়ে চলছে তারা। বরং অনলাইন শপিংয়ের মাধ্যমে কাজ চালিয়ে নিচ্ছে।


উহানে লকডাউনের মধ্যেও কিছু কারখানায় উৎপাদন চলেছে। আর শহরজুড়ে স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে এপ্রিলের প্রথমভাগেই। এসবের প্রভাবে মে মাসেই উহানের কারখানায় উৎপাদন, খুচরা বিক্রি রফতানি করোনাপূর্ব সময়ের কাছাকাছি পর্যায়ে ফিরে আসে। কিন্তু গৃহস্থালি ভোক্তাব্যয়ের স্থবিরতা কারখানায় উৎপাদন পুনরুদ্ধারে কিছুটা হলেও লাগাম টেনে ধরেছে।

নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব, শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষাসহ বিভিন্ন সতর্কতামূলক পদক্ষেপের ভরসায় স্বাভাবিক জীবনে ফেরার মাঝপথেই বড় ধরনের ধাক্কা খায় উহান। মে মাসে শহরটিতে নতুন করে সংক্রমণ ফিরে আসে। ফের চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। এবার আর সরকার ভাইরাসটি গণহারে ছড়িয়ে পড়তে দেয়নি। উহানের কোটি ১০ লাখ জনসংখ্যার প্রায় সবারই করোনা শনাক্তের পরীক্ষা করা হয়। সরকারের তত্পরতায় কাজ হয়েছে। মে মাসের পর থেকে শহরটিতে আর কোনো নতুন সংক্রমণ ধরা পড়েনি।

চায়না মিনশেং ব্যাংকিং করপোরেশনের গবেষক ওয়েন বিন বলেছেন, চীনের অর্থনৈতিক উত্তরণের গতিপথ আমাদের এটাই দেখিয়ে দিয়েছে যে করোনা-উত্তর পুনরুদ্ধারের গতি হবে দ্রুত, যদিও কিছু সীমাবদ্ধতা থাকবে। পুনরুদ্ধার চলাকালে স্বল্প পরিসরে নতুন করে সংক্রমণ দেখা দেবে, তবে তা সম্ভবত অর্থনীতির সার্বিক গতিতে প্রভাব ফেলতে পারবে না।

ওয়েনের মতে, নভেল করোনাভাইরাসের সতর্কতা তো রয়েছেই, এর সঙ্গে অতিবৃষ্টিও উহানে ভোক্তাব্যয়ের উত্থানে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। সরকারি উপাত্তের বরাত দিয়ে চায়না সেন্ট্রাল টেলিভিশন শুক্রবার এক প্রতিবেদনে জানায়, মুষলধারে বৃষ্টিপাত পাহাড়ি ঢলের কারণে সৃষ্ট বন্যায় চীনের দক্ষিণাঞ্চলে তিন কোটির বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারণে অর্থনৈতিকভাবে লোকসান হয়েছে হাজার ১৮০ কোটি ইউয়ান (৮৮০ কোটি ডলার)


উহানে মেট্রোরেলে যাত্রী সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। তবে তা করোনাপূর্ব সময়ের তুলনায় এখনো অর্ধেকের কম। এর একটা বড় কারণ হলো, উহানবাসী এখন গণপরিবহনে চলাচলের চেয়ে ব্যক্তিগত গাড়িকেই বেশি সুরক্ষিত মনে করছে।

গত এপ্রিলে শহরটিতে গাড়ির ডিলাররা জানিয়েছিলেন, করোনা মহামারী শুরুর পর ব্যক্তিগত গাড়ির চাহিদা অনেক বেড়েছে।

উহানে জীবনযাত্রা অর্থনীতিতে স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন প্রণোদনামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে কর্তৃপক্ষগুলো। এসব প্রণোদনার মধ্যে রয়েছে ৫০ কোটি ইউয়ান মূল্যের শপিং ভাউচার, কিছু পরিবারকে নগদ অর্থসহায়তা এবং চলতি বছরের শেষ পর্যন্ত কর থেকে অব্যাহতি। অঞ্চলে বিনিয়োগপ্রবাহ ফিরিয়ে আনতে কেন্দ্রীয় সরকার হুবেই প্রদেশের ফ্রি টেড্র জোন সম্প্রসারণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এছাড়া করোনা সংক্রমণের গণপরীক্ষার পর ভোক্তাদের জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতির ওপর কিছুটা হলেও আস্থা ফিরেছে।

ম্যানুফ্যাকচারিং হাব উহানে লকডাউন প্রত্যাহারের পর থেকেই বাণিজ্যে ঊর্ধ্বগতি দেখা গেছে। মে মাসে শহরটির আমদানি-রফতানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৯ দশমিক শতাংশ বেড়েছে। কারখানায় উৎপাদন, আমদানি-রফতানি, দাপ্তরিক কার্যক্রমে গতি ফিরেছে, কিন্তু অর্থনীতির অন্যতম প্রাণশক্তি ভোক্তাব্যয়ে স্থবিরতা না কাটলে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার পূর্ণতা পায় না। এখন সেটি দেখার অপেক্ষাতেই রয়েছে উহান। ব্লুমবার্গ অবলম্বনে

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন