হাজার বছরের শব্দশিল্পী আল মাহমুদ

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান

আল মাহমুদের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল মাত্র একবার। ১৯৬৩ সালে যখন তার প্রথম কাব্যগ্রন্থলোক লোকান্তরপ্রকাশিত হয়, তখন আমার বালকবেলা; পাঠ্যপুস্তকের বাইরে কবিতা পড়ার বয়স হয়নি। পরে সম্ভবত আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি; স্কুল, ভবঘুরে হয়ে বেড়ানো, আর কালেভদ্রে মারফি রেডিওতে পাকিস্তান বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেট খেলার ধারা বিবরণী শুনি (কেবলই টেস্ট ম্যাচওডিআই, টি২০ তখনো চালু হয়নি), এগুলোই কাজ। সেদিন বৃষ্টির কারণে খেলার ধারা বিবরণী বন্ধ ছিল। তাই বন্ধু তসলিমের বাসার বুক শেলফ খুঁজে লোক লোকান্তর বইটি আবিষ্কার করে পাতা ওল্টাতে থাকি। লেখক আল মাহমুদের নাম আগে কখনো শুনিনি। পাঠ্যপুস্তকের সুবাদে আমাদের দৌড় তখন রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম চন্দ্র, নজরুল, ফররুখ জসীমউদ্দীনে সীমিত। পাতা ওল্টাতে গিয়েনৌকোয়কবিতাটিতে থামি। বার তিরিশেক কবিতাটি পড়ার পরও তৃপ্তি মেটে না! বন্ধুকে বইটি ধার দিতে অনুরোধ করি। তার চাচার বই বিধায় সে ধার দিতে অক্ষমতা জানায়। এরই মধ্যে বৃষ্টি থেমে ক্রিকেট খেলার ধারা বিবরণী শুরু হয়ে গেলেও আমিকখন ভেসেছি জলে, গন্তব্য যে আরো কতদূর/ সে শুধু মাঝিই বোঝে, সবুজ জলের নূপুর/ আমার নৌকায় বাজে সারাদিন একি রিমঝিম,/ কার হাত ভাসিয়েছি ক্লান্ত জলে আদিম পিদিম।/ সে সাত সকালে চড়া, এখনতো মুছে গেছে রোদ/ সারারাত যাবো কেটে ছলছল জলের বিরোধ’— লাইনগুলোর মাদকতায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকি। সন্দ্বীপে বাড়ি বিধায় বহুবার নৌকায় চড়েছি। কিন্তু নৌকাযাত্রা জীবনযাত্রা কবিতায় একাকার হয়ে যায়। কবির নামটা মনে গেঁথে যায়।

কালের কলসবের হয় ১৯৬৬ সালে। আন্দরকিল্লার তাজ লাইব্রেরির মালিক মাহমুদুর রহমান (পরে চিত্রশিল্পী বর্তমানে সন্ত) স্কুলে আমার সহপাঠী বন্ধু। তাজ লাইব্রেরি নতুন লেখকের বই রাখে না। বন্ধুকে অনেক অনুরোধ করে বইটি আনাই। বই কেনার সামর্থ্য নেই। তাই পড়তে চেয়ে নিই। সমস্যা হলো পড়তে গিয়ে। একে তো আউট বই (পাঠ্যপুস্তকের বাইরের বই), তার ওপর কবিতা। আবার কিছু কবিতায় প্রেম কামের মিশ্রণে এক ধরনের স্বর্গীয় কামতৃষার আভাস। অভিভাবকের নজরে এলে আর রক্ষে নেই! তাই বাড়ি না নিয়ে তাজ লাইব্রেরির উপরে ওদের বইয়ের গুদামে বইটি বারবার পড়ি!

একদিন ঠিক করলাম, কবির সঙ্গে দেখা করব। এসএসসি পরীক্ষার পর অবসর। সাহিত্য পত্রিকামেঘনা চন্দনপুরাস্থ কার্যালয়ে আড্ডা দিই। কার্যকরী সম্পাদক রফিক ভুঁইয়াকে (বর্তমানে কানাডা প্রবাসী) ইচ্ছের কথা বলি। রফিক বলে, সে তো আর্ট প্রেসের মালিক শফি সাহেবের আশ্রয়ে থাকে, ফিরিঙ্গি বাজারে। চলো একদিন যাই। সেখানে গিয়ে দেখি, কবির সঙ্গে আরো আছেন শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব (চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের প্রখ্যাত শিল্পী) সুচরিত চৌধুরী (আকাশে অনেক ঘুড়ির লেখক) বাইরের দোকান থেকে চা আসে। রফিকের অনুরোধে কবিকণ্ঠে ছয়টি কবিতার আবৃত্তি শুনি। আগে পড়া কবিতাগুলোও তার কণ্ঠে এক নতুন ব্যঞ্জনা লাভ করে। সাধারণত কবিরা নিজেদের কবিতা এতটা ভালো আবৃত্তি করেন না।

আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই বের হয় বিখ্যাতসোনালী কাবিন দুই বন্ধুতে বাজি ধরে সোনালী কাবিন সিরিজের ১৪টি সনেট আমি মুখস্থ করে ফেলি। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে, হলের নাশতার ক্যান্টিনে, শরীফ মিয়ার চায়ের দোকানে, ডাইনিং হলে, বন্ধুদের সামনে, এমনকি বাথরুমে নিজেকে কবিতাগুলো আবৃত্তি করে শোনাই! কাব্যগ্রন্থটি পড়ে একবারে বড়শির টোপে মাছের মতো গেঁথে যাই। কবি আল মাহমুদের জেলে যাওয়ার খবর পাই আরেক কবি বন্ধু, পরে সিভিল সার্ভিসে সহকর্মী ফজলুল করিমের (কবিনাম আবু করিম) কাছে। সে সম্ভবত তখন দৈনিক গণকণ্ঠে কাজ করত। হতাশ হই না। কিংবদন্তি মানুষ, নামি লেখকদের ক্ষমতাবানদের হাতে নিগৃহীত হওয়া তো আর নতুন কিছু নয়।

আল মাহমুদের কবিতার প্রতি আমার দুর্বলতার কথা বন্ধুরা সবাই জানত। আজিজের (ডাকনাম সেতু, মহসীন হলে আমার রুমমেট প্রয়াত সহকর্মী) কাছে আসতেন ওর খালাত ভাই আমাদের সবার প্রিয়চিলেকোঠার সেপাইখোয়াবনামাখ্যাত লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ওরফে মনজু ভাই। একদিন নিউমার্কেটে মওলা ব্রাদার্সের বইয়ের দোকানে তিনিপানকৌড়ির রক্তবইটি দেখিয়ে বললেন, সেতু আখতার (আমার ডাকনাম), তোমরা পড়ে দেখতে পারো। আমি বললাম, আল মাহমুদ তো কবি। তিনি আবার গল্প লেখেন নাকি? স্বভাবসুলভ বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ মনজু ভাই বললেন, লেখেন মানে? ওর গল্প চিত্রকর্মের মতো। আসলেই, নিজে কেবল বড় লেখক ছিলেন না, জহুরি মনজু ভাই প্রকৃত জহর চিনতেন। আমাদের কারো হাতে বইটি কেনার মতো টাকা না থাকায় হলে ফিরে গিয়ে পরে একদিন গল্প সংকলনটি কিনে নিয়ে আসি। এক বসায় বইটি পড়ে ফেলি। জলবেশ্যা গল্পটি পড়তে গিয়ে মনজু ভাইয়ের কথার সারবত্তা অনুভব করি। আসলেই এটি গল্প নয়, একটি পেইন্টিং। শব্দ বাক্য দিয়ে আঁকা, এই যা পার্থক্য।

গল্পের পর তার লেখা উপন্যাসকাবিলের বোনউপমহাদেশপড়ে চোখের সামনে ঘটে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধকে নতুন পরিচয়ে মহিমায় দেখতে পাই। আবার কাহিনীর পরিমিতি বোধ বিবরণের সৌকর্যের কারণে ইটভাটার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী নায়িকা, চামার যুবতী, নিশিন্দা ঋষিকে নিয়ে লেখানিশিন্দা নারীউপন্যাসটি আমার অতি প্রিয়। নির্মেদ গদ্যের আস্বাদ পেতে হলে আল মাহমুদের কাছে ফিরে আসতেই হবে। তাই আল মাহমুদ বড় কবি না বড় গদ্য লেখক, সে বিতর্ক চলতেই থাকবে।              

এরই মধ্যে খবর আসে, ‘যৌনতাগন্ধিকবি থেকে গণকণ্ঠেরবিপ্লবীসম্পাদক হয়ে ওঠা আল মাহমুদ শেষমেশপ্রতিক্রিয়াশীল’- পরিণত হয়েছেন। তার নতুন কবিতার বইমায়াবী পর্দা দুলে ওঠোহাতে নিয়ে তা বিচার করতে বসি। কিন্তু কই না তো, মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো-তেবুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে সাক্ষাত্কারফররুখের কবরে কালো শেয়ালকবিতাগুলোয় গ্রামীণ বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ রূপকার পুরনো আল মাহমুদকেই আবার নতুনভাবে আবিষ্কার করি; আরো প্রতিবাদী, ন্যায়নিষ্ঠ অধ্যাত্মবাদপুষ্ট কবি হিসেবে। 

আল মাহমুদকে বুঝতে হলে ব্যক্তি আল মাহমুদকে নিয়ে তার লেখা আত্মস্মৃতিযেভাবে বেড়ে উঠিপড়তে হবে। তার আজীবনের দারিদ্র্য, পরের আশ্রয়ে বেড়ে ওঠা, ভীতি এমনকি অংক ভীতিও বুঝতে হবে।তখন কি জানতাম কবিতা লিখতেও অংকের দরকার হয়? অক্ষরবৃত্ত, স্বরবৃত্ত কিংবা মাত্রাবৃত্ত ছন্দও অংকবাহিত নিয়মে চলে?’ আল মাহমুদের লেখার প্রথমদিকে নারীলিপ্সা, মাঝপথে বামপন্থা সব শেষে আস্তিকতা বাঁকগুলো বুঝতে হলে তার আত্মস্মৃতি পড়তেই হবে।

আরেক কিংবদন্তি মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে তার বেশ মিল আছে। দুজনেই প্রচলিত রাজনৈতিক সঠিকতার (পলিটিকাল কারেক্টনেস) বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। দুজনেই এজন্য নিগৃহীত হয়েছিলেন। পশ্চিমা সমাজের অগ্রগতির কারণে মোহাম্মদ আলীর ক্ষেত্রে তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু আমাদের সমাজের অনগ্রসরতার কারণে আল মাহমুদের ক্ষেত্রে তা এখনো ঘটেনি। মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীর শেষকৃত্য স্মরণসভায় অভিনেতা বিলি ক্রিস্টাল বলেছিলেন, হাজার বছর পর আমরা একজন মোজার্ট কে শুনতে, একজন পিকাসোর চিত্রকর্ম দেখতে এবং একজন শেক্সপিয়ারকে পড়তে পাই। মোহাম্মদ আলী আল মাহমুদও তাদেরই একজন।

পরিশ্রমী এই কবি, চা বাগানের কুলিদের সঙ্গে নিজের তুলনা করে লিখেছিলেন, ‘কবিদের কাজও কুলিদের মতোই। উভয়েই চায় খারাপ জিনিস থেকে বেছে যা কিছু কোমল তা আলাদা করে ফেলতে। কুলিরা কচি পাতা বাছে। আর আমরা কোমল শব্দ বাছি।তিনিই সেই অহংকারী কবি যিনি লিখেছেন, ‘কেন আমি কবি? কেন প্রতিটি শব্দের জ্ঞাত অর্থের/ অতিরিক্ত অর্থ আমার জানা’ (কদর রাত্রীর প্রার্থনা) তিনিই সে অন্তর্যামী কবি, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেডাকাতদের গ্রাম?’ তকমা দিয়ে গেছেন। তিনিই সেই ভবিষ্যত্ জান্তা কবি, যিনি নিজের মৃত্যুর দিবসটি পর্যন্ত নির্ভুলভাবে বলে গেছেন, ‘কোনো এক ভোরবেলা, রাত্রিশেষে শুভ শুক্রবারে/ মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ;/ অপ্রস্তুত এলোমেলো গৃহের আলো অন্ধকারে/ ভালোমন্দ যা ঘটুক মেনে নেবো আমার ঈদ। রকম আরেকজন আল মাহমুদের আবির্ভাবের জন্য আমাদের আরেক হাজার বছর অপেক্ষা করতে হবে।

তিনি কখন জীবিকা বা অন্য কী প্রয়োজনে, অভাব কিংবা অন্য কিসের তাগিদে কোন দলে ছিলেন, কখন কার প্রশংসা করেছিলেন এসব বাদ দিয়ে, আমাদের চোখের ঠুলি খুলে তার পেলব মায়াবী কবিতা এবং জাদুকরী গদ্য রচনার দিকে মনোনিবেশ করার সময় এখনই।

লেখক: সাবেক সচিব


আল মাহমুদের জন্মদিন উপলক্ষ্যে পুনরায় অনলাইনে প্রকাশিত

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন