প্রযুক্তি নিয়ে ‘নতুন বিশ্বযুদ্ধ’

বণিক বার্তা ডেস্ক

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের চলমান স্নায়ুযুদ্ধের প্রভাব পড়ছে প্রযুক্তি খাতের ভবিষ্যতেও, যা নিয়ে এখন প্রযুক্তি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের জাতি ও কোম্পানিগুলো। প্রযুক্তি ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের এখনই কোনো না কোনো পক্ষ বেছে নিতে হচ্ছে, কেননা এ যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ চেইন ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। 

দুই পরাশক্তির রাজনৈতিক যুদ্ধের সবচেয়ে বড় বলি জনপ্রিয় ভিডিও অ্যাপ টিকটক, যা টিনএজদের মধ্যে ভীষণ জনপ্রিয় এবং ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে এর রয়েছে মিলিয়ন মিলিয়ন গ্রাহক। এই অ্যাপটির মালিকানা চীনা কোম্পানির, যদিও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা একজন আমেরিকান।

টিকটক নিয়ে সবচেয়ে বড় আঘাতটা আসে গত মাসে, যখন লাদাখে চীনা সেনাবাহিনী কর্তৃক ভারতের ২০ সৈন্য নিহত হয়। ওই ঘটনার পর টিকটক নিষিদ্ধ করে দেয় ভারত সরকার। এরপর গত সোমবার জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে নিয়ে টিকটক নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনার কথা জানায় যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষ। এরই মধ্যে আবার কোম্পানিটি জানিয়েছে, চীন কর্তৃক জাতীয় নিরাপত্তা আইন পাস করার ফলে তারা হংকং থেকে অফিস গুটিয়ে নিতে চলেছে।

টিকটক-এর মালিক বেইজিং-ভিত্তিক বাইটড্যান্স। যদিও মূল কোম্পানি থেকে এটি সবসময় দূরে থাকার নীতিই গ্রহণ করে এসেছে। গত মে মাসে কোম্পানিটি সিইও হিসেবে নিয়োগ দেয় ডিজনির সাবেক নির্বাহী কেভিন মায়ারকে। তারা বলছে, কোম্পানির ডেটা সেন্টার সম্পূর্ণরূপে চীনের বাইরে, কাজেই ডেটার ক্ষেত্রে চীনা আইনের প্রসঙ্গ আসে না। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বৃহস্পতিবার জানায়, বাণিজ্যিক কাঠামোতে পরিবর্তন এনে বাইটড্যান্স নিজেরাই টিকটকের জন্য চীনের বাইরে হেডকোয়ার্টার স্থাপন করার উদ্যোগ নিয়েছে। হুয়াওয়েও দাবি করছে, এটি একটি প্রাইভেট ফার্ম যার মালিক কর্মীরাই। তাতে অবশ্য দুই কোম্পানির বিপদ কাটছে না। 

হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের ডেমোক্রেসি প্রজেক্ট ও ডিজিটাল প্লাটফর্মের সহ-পরিচালক দীপায়ন ঘোষ এ নিয়ে বলেন, ‘সত্যিকারের একটি বৈশ্বিক প্রযুক্তির প্লাটফর্ম হওয়া ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে।’ তিনি যোগ করেন, ‘চীন সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ট যোগ থাকার কারণেই অনেক মার্কেট থেকে ছিটকে পড়েছে হুয়াওয়ে। আমি মনে করি এটা টিকটক প্রত্যক্ষ করেছে এবং নিজেদের হুয়াওয়ে থেকে আলাদা রূপে হাজির করতে চাইছে।’

সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে টিকটকের ওপর ভীষণ চাপ তৈরি করছেন যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতারা। টিকটক বলছে, তারা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য কোনো হুমকি তৈরি করছে না। তবে তাতে মন গলছে না আমেরিকান প্রশাসনের। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এ সপ্তাহে বলেছেন, তারা অ্যাপটি বন্ধের ব্যবস্থা নিচ্ছেন। 

বিশ্বের সর্ববৃহৎ দুই অর্থনীতির দেশের চলমান যুদ্ধে নতুন মোড় তৈরি করে দিয়েছে এই প্রযুক্তি ব্যবসা। এ নিয়েই এখন আলোচনা। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, সুপার ফাস্ট ফাইভজি মোবাইল নেটওয়ার্ক ও অন্যান্য প্রযুক্তি নিয়ে আগে থেকেই দীর্ঘ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ যুক্তরাষ্ট্র ও চীন।  

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আবার বেশ পুরনো, যার ওপর ভিত্তি করে অনেক ব্যবসাও প্রতিষ্ঠিত। যদিও হংকংয়ে সম্প্রতি জাতীয় নিরাপত্তা আইন পাস করা  নিয়ে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে, হংকং নিয়ে কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে আমেরিকান প্রশাসন এবং তা পরিশেষে দুই দেশের সরকারকে বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে।

এই যুদ্ধের ঢেউ লাগছে আরো শক্তিধর কিছুা দেশেও। যেমন যুক্তরাজ্য। চীনা কোম্পানি হুয়াওয়েকে ফাইভজি নেটওয়ার্ক উন্নয়নের দায়িত্ব দেবে কিনা, তা নিয়ে পুনরায় ভাবছে ব্রিটিশ সরকার। হুয়াওয়ের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক জারি করা নিষেধাজ্ঞার পরই বিষয়টি নিয়ে রিভিউ করার সিদ্ধান্ত নেয় যুক্তরাজ্য। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ফলে হুয়াওয়েসহ আরো কিছু ফার্ম দেশটিতে চিপসেট (একটি সমন্বিত সার্কিট বসানো ইলেকট্রনিক উপাদান যা প্রসেসর, মেমোরি ও পেরিফেরালের মধ্যে ডেটার প্রবাহ ব্যবস্থাপনা করে) সরবরাহ করতে পারবে না, যার ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠছে নেক্সট-জেনারেশন প্রযুক্তি।

ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস স্কুল ইনসিয়াডের সিনিয়র অ্যাফিলিয়েট প্রফেসর মাইকেল উইট বলেন, ‘আমার ধারণা হলো, প্রযুক্তি খাতের কোম্পানিগুলোর ঘুম ভাঙছে এবং উপলব্ধি করতে পারছে যে, ভবিষ্যতের জীবন অতটা বিশ্বায়িত নাও হতে পারে। তারা সত্যিই এখন উভয়সঙ্কটের মধ্যে রয়েছে।’

প্রযুক্তি দিয়ে কীভাবে বিশ্ব শাসন করা যায়, তা নিয়ে কয়েক দশক ধরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে। ১৯৮০’র দশকে যুক্তরাষ্ট্র যখন আইবিএম ও মাইক্রোসফট দিয়ে নানা উদ্ভাবন চালাচ্ছিল তখন চীন ব্যাপকভিত্তিক সেন্সরশিপ মেকানিজম ‘গ্রেট ফায়ারওয়াল’ তৈরি করে। এরপর আরো নিয়ন্ত্রিত ইন্টারনেট ব্যবস্থা সৃষ্টি করে চীন। তাদের সহযোগিতা নিয়ে রাশিয়ার মতো দেশও ইন্টারনেট বলয় গড়ে তোলে।

‘মেইড ইন চায়না ২০২৫’ মিশনকে সামনে রেখে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রযুক্তিখাতে চীনের বিনিয়োগ বেড়ে গেছে। ওয়্যারলেস কমিউনিকেশন্স, মাইক্রোচিপ ও রোবোটিকস খাতে অন্যদের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে উচ্চাভিলাষী এই প্রকল্প শুরু করেছে চীন। গত বছর যেমন ৩০৬ বিলিয়ন ডলার মূল্যের চিপসেট আমদানি করেছে চীন, যা দেশটির মোট আমদানি মূল্যের ১৫ শতাংশ।

চীনের বিরুদ্ধে প্রযুক্তি খাতের তথ্য চুরির অভিযোগ প্রায়ই করে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। এই ইস্যুটিই ২০১৮ সাল থেকে দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কে চিড় ধরাতে শুরু করে। চীন অবশ্য এমন অভিযোগ সব সময়ই উড়িয়ে দিয়েছে এবং বলেছে, প্রযুক্তি খাতের কোনো গোপনীয় তথ্য হস্তান্তর হলে তা হয়েছে দুই পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতেই।     

যাই হোক, সম্প্রতি চীনের অনেক নামী প্রযুক্তি ফার্মকে নিষিদ্ধ করেছে যুক্তরাষ্ট্র এবং নিজেদের বৃহত্তর ক্যাপিটাল মার্কেটেও বেইজিংয়ের প্রবেশাধিকার সীমিত করে দিয়েছে। 

ওয়াশিংটনের সঙ্গে বেইজিংয়ের এই লড়াই যত ঘনীভূত হচ্ছে প্রযুক্তি খাতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মঞ্চও ততই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। ইউরাসিয়া গ্রুপের প্রেসিডেন্ট ও চেয়ারম্যান ইয়ান ব্রেমের ও ক্লিফ কুপচান বলেন, ‘বেইজিং কর্তৃক আলাদা হয়ে যাওয়াটা অনিবার্য হয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক স্থাপত্যকে নিজেদের স্বার্থেই নতুন রূপ দিতে ব্যাপকভিত্তিক প্রচেষ্টা হাতে নিয়েছে চীন এবং এর মধ্য দিয়ে দ্বিখন্ডিত বিশ্বে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে তারা।’

সূত্র: সিএনএন

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন