বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসে বিশেষ সাক্ষাৎকার

জনসংখ্যাসংক্রান্ত নীতি-পরিকল্পনার দুর্বলতা ও সমন্বয়হীনতা দূর করা জরুরি

ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক চেয়ারম্যান। ২০০৯ সালে চীনের পিকিং ইউনিভার্সিটি থেকে ডেমোগ্রাফি বিষয়ে অর্জন করেছেন পিএইচডি ডিগ্রি এবং সেখানে ২০০৮ সালে একাডেমিক সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন ফার্স্ট প্রাইজ অব একাডেমিক এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড অব পিকিং ইউনিভার্সিটি জনস্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষণার জন্য ২০১০ সালে গ্লোবাল হেলথ কাউন্সিল (ইউএসএ) কর্তৃক নিউ ইনভেস্টিগেটর ইন গ্লোবাল হেলথ প্রোগ্রামে বিজয়ী নিকসাইমন্সস্কলার নির্বাচিত হয়েছেন। . মঈনুল ওয়ার্ল্ড হেলথ সামিটবার্লিন, জার্মানি ২০১৪ ২০১৬ সালে দুবার নিউ ভয়েসেস ইন গ্লোবাল হেলথ হিসেবেও বিজয়ী হয়েছেন। ২০১৪ সালে ইন্টারন্যাশনাল একডেমি অব সোস্যাল সায়েন্সেস (ইউএসএ) কর্তৃক একাডেমিশিয়ান অব সোস্যাল সায়েন্সেস হিসেবে পেয়েছেন সর্বোচ্চ স্বীকৃতি। আর কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্লোবাল হেলথ রিসার্চ ক্যাপাসিটি স্ট্রেনদেনিং প্রোগ্রাম ফেলোশিপের (২০১৩-১৪) আওতায় পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণা করেছেন। বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসকে সামনে রেখে তাঁর সঙ্গে কথা হয় বণিক বার্তার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা।

বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?

২০১১ সালে হওয়া আদমশুমারির ফল আমলে নিয়ে আমরা যদি ২০১৯ পর্যন্ত হিসাব করি, তাহলে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৮১ লাখ। জনসংখ্যা একদিক থেকে যেমন একটি সংখ্যাগত বিষয়, তেমনি জনসংখ্যার গুণগত দিকও রয়েছে। সংখ্যার দিকে লক্ষ করলে দেখা যাবে জনসংখ্যা প্রতিনিয়তই বাড়ছে। সঙ্গে জনসংখ্যার ঘনত্বও বাড়ছে। এখন বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে হাজার ২৬৫ জন বাস করে। গুটি কয়েক নগররাষ্ট্র বাদ দিলে বাংলাদেশেই প্রতি বর্গকিলোমিটারে বিশ্বের সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষ বাস করে। সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার দেশ চীন দ্বিতীয় ভারতও এত ঘনবসতিপূর্ণ নয়। আমাদের আয়তন সীমিত। জনসংখ্যার ঘনত্বের ওপর নির্ভর করে শিক্ষা ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, যাতায়াত ব্যবস্থা, নাগরিক জীবন কেমন হবে। আমাদের দেশে মানুষগুলো গ্রাম থেকে শহরমুখী হচ্ছে। সারা বিশ্বেই শহুরে জনসংখ্যা বাড়ছেপ্রতি দুজনে একজন শহরে বসবাস করছে। আর আমাদের দেশে বর্তমানে ৩৭ শতাংশ মানুষ শহরে বাস করে। পূর্বাভাস অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, ২০৪১ সালে প্রতি দুজনে একজন নগরে বসবাস করবে। তবে জনসংখ্যার আকার বাড়লেও জন্মহারে এক ধরনের পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। জন্মহারের মধ্যে মোট প্রজনন হার, ইংরেজিতে যেটাকে বলা হয় টোটাল ফার্টিলিটি রেট, ১৫ থেকে ৪৯ বছরের একজন বিবাহিত নারী গড়ে তার জীবদ্দশায় কয়টি জীবিত সন্তান প্রসব করেন, তার হার। মানদণ্ড বিচারে আমাদের স্বাধীনতার সময়েও একজন নারী দশমিক জন সন্তান জন্মদান করতেন। কিন্তু বর্তমানে হার হচ্ছে দশমিক জন। ১৯৭০ থেকে ২০১৭-১৮ সাল বিবেচনা করি, তবে অবশ্যই বাংলাদেশের এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটেছে। কিন্তু এটিই কি আমাদের কাঙ্ক্ষিত ছিল? নাকি এর চেয়ে ভালো হতে পারত? বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা ১৯৫০ দশকে শুরু হয়েছিল। তবে সরকারি পর্যায় থেকে নয়, ব্যক্তি পর্যায়ে স্বেচ্ছাশ্রম পর্যায়ে। পাকিস্তান সময়ে ১৯৬৫-এর দিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টির দিকে খুব স্বল্প পরিসরে দৃষ্টি দেয়া হয়েছিল। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়েছিলেন। তিনি জনসংখ্যা বৃদ্ধি সমস্যার সমাধানে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কথাটি উল্লেখ করেছিলেন। পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। সময়গুলোয় পরিবার পরিকল্পনাকে সুসংহত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট এরশাদের সময়ও এর একটি উল্লেখযোগ্য গতিধারা ছিল। এখানে পরিবার পরিকল্পনার বেইজ বা ভিত্তি তৈরি হয়েছিল সত্তরের দশকে। আর আশির শেষ দিকে বা নব্বইয়ের কাছাকাছি সময় হলো পরিবার পরিকল্পনার ম্যাচিউরিটি টাইম। আমার মা সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে পরিবার পরিকল্পনায় কাজ করতেন। আমার মায়ের অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছি, ওই সময় পরিবার পরিকল্পনায় কাজ করা খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল। যদিও পরবর্তীতে এটি সামাজিক আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। ওই সময় মনে করা হতো জনসংখ্যা আমার দেশের একটি প্রধান সমস্যা। এখন কিন্তু তা মনে করা হয় না। ১৯৯৪ সালে কায়রোয় ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অব পপুলেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বা আইসিপিডি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলন থেকে জনসংখ্যা পরিমাণগত দিক থেকে গুণগত দিকে চলে এসেছে। পরিবার পরিকল্পনাকে মানবাধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। পরিবার পরিকল্পনার বিষয়টি হচ্ছে শুধু জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার নয়, বরং স্বামী-স্ত্রী সমঝোতার মাধ্যমে কয়টি সন্তান নেবেন না-নেবেন, সন্তান নেয়ার মধ্যে বিরতি থাকবে কিনা, কার সিদ্ধান্তে সন্তান হবে, যৌথভাবে সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে যাওয়া এবং পদ্ধতি বেছে নেয়ার ক্ষমতা থাকা, ইনফরমেশন, এডুকেশন, আন্তঃযোগাযোগের বিষয়টা রয়েছে। আমার মা যখন কাজ করেছিলেন তখন তাদের ট্রেনিং দেয়া হতো, তারা মনিটরিংয়ের জন্য ফিল্ডে যেতেন, গ্রামে গিয়ে ভিজিট করতেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে দম্পতিদের বোঝাতেন, বিনা মূল্যে জন্মনিরোধক পিল দিতেন, বোঝানোর চেষ্টা করতেন কেন পরিবার পরিকল্পনা দরকার। একটা পরিবারে যদি সাত থেকে আটটি করে সন্তান থাকে, তাতে মায়ের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতো, সন্তানও মারা যেত। পরবর্তীতে যখন ভ্যাকসিনেশন (টিকা) এল তখন শিশুমৃত্যুর হার কমে যাওয়ার সঙ্গে শিশু নেয়ার হারও কমে এসেছে। আমাদের পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে রাজনৈতিকভাবে যে গতিধারা ছিল, সেটা ছিল আশির দশক পর্যন্ত। ১৯৯৪ সাল থেকে আমরা একটা পরিবর্তন দেখতে পাই। ১৯৯৪ সালে মিসরের কায়রোয় অনুষ্ঠিত জনসংখ্যা উন্নয়নবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির দ্রুত বাস্তবায়নকে উপজীব্য করে পর্যায়ে সরকারের পলিসি লেভেলে একটা পরিবর্তন এল। প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার, জেন্ডার সমতা, নারীর ক্ষমতায়ন, পরিবার পরিকল্পনার বিষয়গুলো অধিকতর গুরুত্ব পায়, যা জনসংখ্যা উন্নয়ন ভাবনার দেশীয় পরিকল্পনায় যুক্ত হয়।

 

পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমে এক ধরনের ভাটা লক্ষ করা যাচ্ছে। কেন?      

বর্তমানে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারে এক ধরনের স্থিতাবস্থা লক্ষ করা যাচ্ছে। ২০১১ ২০১৭-১৮ সালের জরিপে তেমন কোনো পরিবর্তন দেখছি না। এখন ৬২ শতাংশে এসে ঠেকেছে। যারা গর্ভনিরোধক পদ্ধতি ব্যবহার করতে চান কিন্তু পারছেন না, তাদের সংখ্যা এখনো ১২ শতাংশ। আমাদের বিবাহিত দম্পতির সংখ্যা বাড়ছে। কিশোরী অবস্থায় প্রজনন হার প্রায় ২৮ শতাংশ। এখনো বাংলাদেশে ২০-২৪ বছর বয়সী বিবাহিত নারীদের অর্ধেকেরও বেশির বিয়ে হয়ে যায় ১৮ বছরের আগেই। প্রায় প্রতি তিনজন কিশোরীর একজন এখনো গর্ভধারণ করে ২০ বছরে পৌঁছানোর আগেই। আমাদের এখানে বাল্যবিবাহ এখনো হয় এবং বিয়ে হওয়ার পর পরই সন্তান নেয়া হয়। সময়ে জন্মনিরোধক পদ্ধতি ব্যবহারের হার কম। কারণ আমাদের দেশে তাড়াতাড়ি সন্তান নেয়ার একটি প্রবণতা রয়েছে। জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি মূলত ব্যবহার করছে ২৪ থেকে ৩০ বা এর পরের বয়সীরা। কিন্তু শুরুতেই যদি একাধিক সন্তান হয়ে যায় তাহলে একটা সমস্যা। মোট প্রজনন হারের প্রেক্ষাপটে যদি বলি, সত্তরের দশক থেকে এখনকার সময়ে, তাহলে আমি বলব এটা একটি সফলতা। বাংলাদেশে মোট প্রজনন হার, জন্মহার কমে এসেছে, সেদিক থেকে আমরা ভারত, পাকিস্তান থেকে এগিয়ে রয়েছি। এর পেছনে অন্যতম কারণ আশি নব্বইয়ের দশকে পরিবার পরিকল্পনায় বেশ কাজ করা হয়েছিল। মিডিয়া কমিউনিকেশন জোরালো ভূমিকা রেখেছিল। আগে জনসংখ্যার প্রজনন হার যত কমানো যায়, সেটা ছিল মূল ফোকাস। ১৯৯৪ থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিতে নারীর অধিকারের বিষয়, মানবাধিকারের বিষয়, যেমন কাউকে জোর করে স্টেরেলাইজেশন করা যাবে না, এটা মানবাধিকারের লঙ্ঘন ইত্যাদি বিষয় সামনে চলে আসে। এজন্য সিদ্ধান্ত  নিতে হবে কোন পদ্ধতি গ্রহণে উৎসাহিত করা হবে, সরকারি সেবা নাকি এনজিওগুলোকে উৎসাহিত করা হবে, নাকি মিডিয়া কমিউনিকেশনে যাওয়া হবে। অর্থাৎ টায়ার লেভেলটা ঠিক করতে হবে। একটা টায়ার লেভেল হচ্ছে ইন্টারপারসোনাল কমিউনিকেশন। এজন্য পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের যে লোকবল ছিল, তারা ফিল্ড ভিজিট করত, বিবাহিত দম্পতিদের কাছে যেত, জন্মনিরোধক পিল বিনা মূল্যে দিত। গরিবরা যারা পিল কিনতে পারত না, তারা বিনা মূল্যে পিল পেয়ে অপরিকল্পিত গর্ভধারণ থেকে রক্ষা পেত। অপরিকল্পিত গর্ভধারণ মানেই এক ধরনের ঝুঁকি। পলিসি বা নীতি কৌশলে পরিবর্তনের  কারণে বাড়িতে যাওয়া বন্ধ ছিল বা আগের মতো নেই। মাঝখানে আবার লোকবল নিয়োগ দেয়া হয়নি। এখনো পরিবার পরিকল্পনায় চার থেকে পাঁচ হাজার লোকবল ফাঁকা রয়েছে বলে মাঝেমধ্যে পত্রপত্রিকায় সংবাদ দেখি। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে বিবাহিত দম্পতির সংখ্যা বেড়েছে। নতুন জনগোষ্ঠীর মাইন্ড সেটে পরিবর্তন এসেছে। তাদের মধ্যে পরিবার পরিকল্পনার মেসেজে নতুন ইনোভেটিভ আইডিয়া নিয়ে আসতে হবে। শিক্ষিত দম্পতি সম্ভাব্য টার্গেট জনগোষ্ঠীর কাছে তৃণমূল পর্যায়ে কীভাবে পৌঁছানো যায়, তা নিয়ে কর্মসূচি নিতে হবে।

 

এখন তো বলা হচ্ছে জনসংখ্যাই সম্পদ...

হ্যাঁ, সরকার ভাবছে বিদেশে জনসংখ্যা রফতানি করবে। কিন্তু বিদেশের বাজার তো দেখতে হবে। আমার বিভিন্ন দেশে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। প্রায়ই বিদেশে যেতে হয়, সেটা পেশাগত কারণেই। মধ্যপ্রাচ্য বা মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশের বিমানবন্দর দিয়ে গেলে যাত্রাপথে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে থাকা বাংলাদেশীদের সঙ্গে কথা হয়। তারা তো বলছে, তাদের বাজার সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। প্রতিযোগিতা বেড়ে গেছে। আমরা দক্ষ শ্রমিক পাঠাতে পারছি না। আগে আমরা যাদের পাঠিয়েছি, তারা আধা দক্ষ বা অদক্ষ শ্রমিকশ্রেণীর। আবার নারীদের যে পাঠানো হচ্ছে, তারা কোথাও কোথাও বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অন্যদিকে ভারতসহ বিভিন্ন দেশ মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে প্রবেশ করছে। আমাদের দেশ থেকে যদি দক্ষ নার্স, ডাক্তার, টেকনিশিয়ান তৈরি করে বিদেশে পাঠানো যেত তাহলে তা ফলপ্রসূ হতো। বৈশ্বিক বাজার তো প্রতিযোগিতামূলক। বিদেশের বাজারে তো দক্ষ লোকই বেছে নেবে। জনগণ যদি দক্ষ হয়, তাহলে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে অর্থনীতিতে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে গ্র্যাজুয়েট তৈরি করেছি, তাদের যদি চাকরি দিতে না পারি বা এরা যদি অর্জিত জ্ঞানভিত্তিক কাঙ্ক্ষিত জায়গায় কাজের সুযোগ না পান বা কোনো কাজে সংযুক্ত না হন, তবে তো সমস্যা তৈরি হবে। নিজে উদ্যোক্তা হওয়ার পথ সুগম থাকতে হবে। কোনো কাজই খারাপ না। সব কাজকেই ইতিবাচকভাবে দেখা উচিত। যাই মনে করি না কেন, আমাদের বাজারের চাহিদা অনুযায়ী শ্রমশক্তি তৈরি করতে হবে। একসময় বাণিজ্য অনুষদের চাহিদা না থাকলেও এখন এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আমাদের দেখতে হবে আমরা যে গ্র্যাজুয়েট তৈরি করছি, তাদের বাজারের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর মতো যোগ্যতা রয়েছে কিনা, তার অর্জিত জ্ঞান বাস্তবতাসম্পন্ন হচ্ছে কিনা। আমাদের দরকার প্রায়োগিক এডুকেশন। পলিসি বা নীতি প্রণয়নে জনসংখ্যার বিশ্বকে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করতে হবে। জনসংখ্যার বার্ষিক গড় বৃদ্ধির হার হচ্ছে এভারেজ অ্যানুয়াল গ্রোথ রেট। বর্তমানে বাংলাদেশে হার দশমিক ৩৭ শতাংশ। এখানে প্রতি বছর শ্রমবাজারে প্রায় ২০ লাখ লোক যোগ হচ্ছে। আমরা যে গ্র্যাজুয়েট তৈরি করছি, তার খুব কমই যায় সরকারি চাকরিতে আর বেশির ভাগই যায় বেসরকারি কিংবা অন্য উৎসে। এজন্য বেসরকারি পর্যায়ে বিনিয়োগ লাগবে এবং সেজন্য পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। সুনির্দিষ্ট কার্যকর পরিকল্পনা থাকতে হবে, স্কিল ডেভেলপমেন্টের কথা শুধু পলিসিতে থাকলে বা বললে হবে না, বাস্তবে তা প্রয়োগ করতে হবে।

 

অঞ্চলভেদে প্রজনন জন্মহারের পার্থক্য কেন দেখা যায়?

বিভাগীয় কিংবা অঞ্চলভেদে বেশ পার্থক্য রয়েছে। সিলেট, চট্টগ্রাম ময়মনসিংহে হার বেশি। তবে খুলনা রংপুরে দেখা যায়, রিপ্লেসমেন্ট লেভেল বা প্রতিস্থাপনযোগ্য হারের কাছাকাছি চলে গেছে। সিলেট চট্টগ্রাম দুটো অঞ্চলে কেন এই ভিন্নতা তা বুঝতে হবে। সেখানে পরিবার পরিকল্পনা কেমন চলছে এবং ওখানকার মানুষের মানসিকতা কী রকম, তৃণমূল পর্যায়ে ধর্মীয় কোনো বিষয় এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে কিনা ইত্যাদি। বরিশাল বিভাগে জনসংখ্যার বার্ষিক গড় বৃদ্ধির হার হচ্ছে জিরো। কিন্তু বাস্তবে কি জিরো হয়? কিন্তু শুমারির তথ্যে তাই তো দেখতে পাচ্ছি। কারণ হিসাবে বলা যায়, বরিশালের মানুষ মাইগ্রেট বা স্থানান্তর করে বেশি। ঢাকা, চট্টগ্রাম বিভিন্ন জায়গায় চলে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে  মাইগ্রেশন ফ্যাক্টর গুরুত্বপূর্ণ। জনসংখ্যার গ্রোথ রেট জিরো হয় জন্ম, মৃত্যু মাইগ্রেশনের ভিত্তিতে। এখন সব মানুষ যদি ঢাকায় আসে, তবে তো এখানে গ্রোথ রেট বেড়ে যাবে। এটাই তো স্বাভাবিক। বরিশালে এমনটাই ঘটেছে। এখন বরিশালের মানুষ কেন বেশি মাইগ্রেট করে, তার কারণ আমাদের বুঝতে হবে। তারা কি খুব বেশি ইনডিপেনডেন্ট, পরিবেশগতভাবে ভালনারেবল কিংবা বন্যা, নদীভাঙন ইত্যাদি প্রভাব ফেলে? সিলেট চট্টগ্রামের গ্রোথ রেট তুলনামূলক কেন বেশি, সেজন্য জন্মনিরোধক ব্যবস্থার প্রতি কনজারভেটিভ কিনা, বাল্যবিবাহের হার কেমন ইত্যাদি বিষয়ের ওপর নজর দিতে হবে। দ্য লান্সেট জার্নালে প্রকাশিত আমার নিজেরও এক গবেষণায় দেখেছি ১৮ বছরের আগে কোনো নারীর বিয়ে হলে চার বা পাঁচটি সন্তান হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। জন্মনিরোধক ব্যবহার করার হার যেহেতু স্থিতাবস্থায় এবং মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস (২০১৬) জরিপ অনুযায়ী কোনো অগ্রগতি নেই বা ক্ষেত্রবিশেষ বাড়ছে কেনএগুলোর উত্তর খুঁজতে হবে।

 

গবেষণায় দেখা যাচ্ছে বাল্যবিবাহের হার অপরিবর্তনীয়। কেন?

আমি আমার সহগবেষকদের এক গবেষণায় দেখতে পেয়েছি যে কোনো নারীর যদি ১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয় এবং আরেকজনের যদি ১৮ বছর বয়সে বিয়ে হয় তাহলে দেখা গেছে, প্রথম জনের শিক্ষাজীবন থেকে এক বছর ঝরে পড়ে। একটি মেয়ের শিক্ষাজীবন থেকে এক বছর চলে যাওয়া মানে চাকরির বাজারে এর প্রভাব পড়বে, উপার্জনে প্রভাব পড়বে। উচ্চতর শিক্ষা থাকলে উচ্চ আয়ের সম্ভাবনা বেশি হয়। বাল্যবিবাহের কারণে একজন নারীর শরীরে প্রভাব পড়ছে, চাকরির বাজারে প্রভাব পড়ছে। এগুলো এখন জনসংখ্যার ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

সরকারের পরিকল্পনায় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কতটা গুরুত্ব পাচ্ছে?

পলিসি লেভেল থেকে দেখতে হবে আমরা আমাদের জনসংখ্যার আকার কেমন দেখতে চাই। জাতীয় জনসংখ্যা নীতি ২০১২, তার আরেকটি ২০০৪, এর আগে আরেকটি আউট লাইন হয়েছে ১৯৭৬-এ। ২০০৪ সালে প্রণীত পলিসির যে টার্গেট ছিল, ২০১২ সালেও একই রয়েছে। ২০০৪ থেকে ২০১১ সময়ে কেন লক্ষ্য অর্জন করা গেল না, তা পরের পলিসিতে বিবেচনায় নেয়া  উচিত ছিল। সেটা কিন্তু হয়নি। চলমান পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা পারস্পেকটিভ প্ল্যান, যেটি ২০১০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত, সেখানে দেখা যাচ্ছে মোট প্রজনন হার পয়েন্ট লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। কিন্তু সর্বশেষ বিডিএইচ জরিপে (২০১৭-১৮) দেখা যায়, আমরা এখনো রয়েছি দশমিক -এ। আবার জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি ২০১২ বলছে, ২০২১-এর মধ্যে মোট প্রজনন হার আসবে দশমিক -এ। পলিসি প্ল্যানের টার্গেটগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। আমাদের জাতীয় যুব নীতি ২০০৩ সালের পর ২০১৭ সালে আপডেট করা হলো। একটি পলিসি আপডেট করতে এত সময় তো লাগার কথা নয়। আবার ন্যাশনাল পপুলেশন কাউন্সিলের একটি বডি রয়েছে, যারা প্রতি বছর দুবার করে বসবে এবং জাতীয়ভাবে জনসংখ্যা সম্পর্কিত সমস্যা চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে বৈঠক করবে, সিদ্ধান্ত পদক্ষেপ নেবে। এটা জনসংখ্যা নীতি ২০১২- বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও এখন পর্যন্ত নাকি তারা একটিও সভা করেনি। ২৫টি মন্ত্রণালয় দায়িত্বে রয়েছে জনসংখ্যা নীতির বাস্তবায়নে। কিন্তু মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে তো কোঅর্ডিনেট বা সমন্বয় করতে হবে। তা জোরদার করতে হবে। জনসংখ্যার বিষয়টিকে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে পরিকল্পনা করতে হবে। বিশেষ করে জনসংখ্যার বয়স কাঠামো বিবেচনায় নিতে হবে। যেমন বয়স্ক লোক, কর্মক্ষম লোকের সংখ্যা বাড়ছে, তাদেরকে কীভাবে উন্নয়নের সঙ্গে সংযুক্ত করা যায় তা নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে।

 

দেশের জন্য কতটুকু জনসংখ্যা দরকার, সেটাও তো বের করা দরকার?

অবশ্যই। আমাদের মতো ছোট আয়তনের দেশে জনসংখ্যার আকার নিয়ে ভাবতেই হবে। ঢাকা শহরের কথাই যদি ভাবি, শহরেই কত মানুষ বাস করে, তার কি সঠিক পরিসংখ্যান রয়েছে? জাতিসংঘের পপুলেশন ভিভিশনের তথ্য অনুযায়ী, শহরে প্রায় দুই কোটি মানুষ বাস করে। শহর কি বসবাসের উপযোগী রয়েছে? এখানে থাকা মানুষগুলোর আবাসন, যানজটসহ নানা সমস্যা প্রতিদিনই প্রকট হয়ে উঠছে। বস্তি বস্তিবাসীর  সংখ্যা বাড়ছে। বস্তিতে বসবাসকারীরা কতটুকু সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে, সেটাও একটি চিন্তার বিষয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএস কি বিশ্বাসযোগ্য তথ্য দিতে পারছে? বাংলাদেশে বেকারত্বের হার দশমিক থেকে দশমিক -এর মধ্যে ওঠানামা করছে বেশ কয়েক বছর ধরে, অথচ বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পথে এগিয়ে গেলেও এখানে কোনো পরিবর্তন হয়নি। কেন কোনো পরিবর্তন নেই? যে নির্দেশক দ্বারা পরিমাপ করা হচ্ছে, তাদের সংজ্ঞাগুলো সঠিক রয়েছে কি? এগুলো দেখার বিষয়। জনসংখ্যার আকার সীমিত রাখার পাশাপাশি গুণগত উন্নয়নের দিকেও দৃষ্টি দিতে হবে। জনসংখ্যাসংক্রান্ত পলিসিগুলোর মধ্যে দুর্বলতা ব্যবধান রয়েছে, তা খুঁজে সমাধানে উদ্যোগ বের করা।

 

বাইরে থেকে লোক ফেরত পাঠানো হচ্ছে (যেমন রোহিঙ্গা, প্রবাসী) তাতে কী ধরনের প্রভাব পড়বে আমাদের জনসংখ্যার ওপর?

ভবিষ্যতে বাংলাদেশের বিদেশী শ্রমবাজার অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। কারণ এক. আমাদের শ্রমিকদের দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে, দুই. চাহিদার ভিত্তিতে নতুন বাজার খোঁজার ঘাটতি রয়েছে। ফিলিপাইন, শ্রীলংকা, ভারত যেভাবে বিশ্ববাজারে শ্রমিক পাঠাচ্ছে, সেভাবে আমরা তা পারছি? প্রবাসীরা যদি ফিরে আসে তাহলে তো আরো চাপের মধ্যে পড়বে তারা। অন্যদিকে রোহিঙ্গারা বিভিন্ন জায়গায় মিশে যাচ্ছে। শুনতে পাচ্ছি তারা বাংলাদেশের পাসপোর্ট ব্যবস্থা করে ফেলছে এবং তা ব্যবহার করে কেউ কেউ বিদেশ যাচ্ছে। রকম সংখ্যা কত? সেটাই চিন্তার বিষয়। যেভাবেই দেখি না কেন, রোহিঙ্গারা কিন্তু আমাদের জন্য বড় উদ্বেগের বিষয়। প্রচুর অর্থসংস্থানের ব্যাপার রয়েছে, মানবাধিকারের বিষয় রয়েছে।

 

জনসংখ্যার আকার হিসেবে আগামী দিনে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ আসতে যাচ্ছে?

সামনে আরবানাইজেশন বা নগরায়ণের চ্যালেঞ্জ দেখা দেবে। প্রজেকশন বলছে, যা আগেই বলেছি, ২০৪১ সালের মধ্যে প্রতি দুজনের একজন থাকবে শহরে। শহরে এসব মানুষের জন্য সুযোগ-সুবিধা প্রদান চাহিদা নিশ্চিত করা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে। এরপর হবে শ্রমবাজারে কর্মসংস্থান তৈরি করা। আমরা প্রতি বছর যে শ্রমশক্তি তৈরি করছি, সে তুলনায় কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারছি না। আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে স্কিল মিসম্যাচ। বিশেষায়িত বিষয়ে পড়াশোনা করে সে-সংক্রান্ত পেশায় না থেকে অন্য পেশায় যুক্ততা বেশ লক্ষণীয়। তাছাড়া সবার জন্য তো উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন নেই; বরং টেকনিক্যাল, ভোকেশনাল এডুকেশনের দিকে এগিয়ে যাওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত। প্রজনন হার নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা হবে আরেকটি চ্যালেঞ্জ। বাল্যবিবাহ দূর করতে না পারলে তা বড় সমস্যা হয়ে উঠবে। প্রজনন স্বাস্থ্যের উন্নয়নসহ নারীর ক্ষমতায়নে তা বিশেষ বাধা। এখন সরকারের মূল লক্ষ্য হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন। কিন্তু সেটা করতে হলেও তো মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়াতে হবে। দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। ২০৩৫ থেকে ২০৩৮ সময়ের মধ্যে জনমিতিক লভ্যাংশ (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) নিতে হবে। জীবন আয়ুষ্কাল বাড়লেও রোগশোকহীন শারীরিক অক্ষমতাহীন আয়ষ্কালু কতটুকু বাড়ছে, তা নিয়ে ভাবতে হবে। শ্রমবাজারে ব্যবস্থাপক দক্ষ শ্রেণীর পেশায় বিদেশ থেকে লোক আনার বদলে আমরা যদি আমাদের লোকদের দক্ষ করে তুলতে পারি, সেটা আমাদের জন্যই ভালো হবে। এরপর জনসংখ্যার বিচারে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়ার কারণে পপুলেশন এইজিং একটা বড় চিন্তার বিষয় হয়ে উঠবে। কারণ পরিবার ভেঙে যাচ্ছে, অনু পরিবার জনপ্রিয় হচ্ছে। পরিস্থিতিতে বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে কীভাবে সামাল দেয়া হবে তা নিয়ে বিশেষভাবে ভাবতে হবে। বয়স্কদের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধাযুক্ত সমাজ তৈরি করার দিকে আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে।

 

শ্রুতলিখন: রুহিনা ফেরদৌস

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন