করোনাকাল এবং ঢাকার বায়ু দূষণ

মুসফেরা জাহান শর্মি ও মো. শাহিন রেজা

বাংলাদেশ রাজধানীর শহর ঢাকা বিশ্বের বসবাসের অনুপযোগী শহরের হিসেবে ইতোমধ্যে পরিচিত লাভ করেছে ১৬১০ সালে ইসলাম খান ঢাকায় প্রথম রাজধানীর স্থাপন করে স্বাধীনতা পূর্বে মোট চার বার ঢাকা বাংলার রাজধানী শহরের মর্যাদা পেয়েছে ইতিহাস ঐতিহ্য ঢাকার জৌলুশ ছিল জগতজুড়ে ঔপনিবেশিক আমলের বেশ কিছু স্থাপত্য ছিল নান্দনিক পরিকল্পিত কিন্তু পরবর্তিতে দেশ ভাগ হবার পরে ঢাকা তার প্রাণ হরাতে শুরু করে ১৯৪৭ দেশ ভাগের পর তত্কালীন পাকিস্তান সরকার ঢাকা তথা পূর্ব বাংলাকে নিয়ে তেমন কোন পরিকল্পনায় গ্রহণ করেনি ফলে শিক্ষা, সংস্কৃতি, কর্মসংস্থান, ইতিহাস, ঐতিহ্য পিছিয়ে পড়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিসস্তান শুধু ১৯৫৯ সালে ঢাকার জন্য একটি মহাপরিকল্পনা করা হয়  এরপর  স্বাধীনতা পরেও নেওয়া হয়নি তেমন কোন সঠিক পরিকল্পনা ঢাকা শহরকে নিয়ে পরবর্তীতে কিছু মহাপরিকল্পনা করা হলেও সেগুলো সঠিকভাবে বাসত্মবায়ন করা হয়নি ফলে কালের বিবর্তনে অপরিকল্পিত , অনিয়ন্ত্রিত  নগরায়নের  ঢাকা আজ মৃত নগরী!

প্রকৃতি তাঁর সবটুকু উজাড় করে দিয়েছে মানব কল্যানে কিন্তু আমরা নিজেদের স্বার্থে নিষ্ঠুরের মত শুধু তাকে ব্যবহারই করেছি, প্রতিদানে আমরা তাকে কিছুই দিতে পারেনি ফলে প্রকৃতি ধীরে ধীরে তার রূপ পরিবর্তন করেছে এক সময় দেশ ছিল সবুজে ঢাকা, নদ নদীতে ছিল পানি, প্রাণীজ জলজ সম্পদ শিল্পায়নের পূর্বে মানুষ প্রকৃতির সাথে আনন্দে বসবাস করতো কিন্তু আঠারো শতকের শিল্প বিপ্লবের পরে শুরু হল প্রাকৃতিক পরিবেশকে ধ্বংস করার কর্মযঞ্জ একের পর এক শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলো সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকলো অপরিকল্পিত নগরায়ন মানুষের কর্মকান্ড চলে যেতে থাকলো প্রকৃতির বিপক্ষে

বাংলাদেশ শিল্পায়ন নগরায়ন স্বাধীনতার পর থেকে বিস্তার লাভ করে পাকিস্তান সময়ে কিছু শিল্প প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি হলেও তা ছিল হাতে গোনা অল্প কিছু বাংলাদেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত ঢাকা কেন্দ্রিক ছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, কোর্ট কাচারি সব কিছুই ঢাকা কেন্দ্রিক ফলে মানুষ কর্মসংস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ নানান কাজে ঢাকা মুখী হচ্ছে প্রতিনিয়ত কিন্তু ঢাকাকে নিয়ে কোন সুষ্ঠ সুষ্ঠু পরিকল্পনা নেয়া হয়নি যানবাহন কালো ধোঁয়া, অপরিকল্পিত পয়ঃনিষ্কাশন, যানজট, বিদ্যুত্ সুপেয় পানির ব্যবস্থা, নিরাপত্তার অভাব সহ নানান সমস্যায় প্রতিদিন সম্মুখীন হচ্ছে ঢাকার মানুষ ঢাকার নদী খাল দখল করে অপরিকল্পিত ভবে বসত বাড়ী, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নির্মান করা হচ্ছে ঢাকার চার পাশে গড়ে উঠেছে ইট ভাটা যেখানে ব্যবহার করা হচ্ছে গাছ পালা বলা হয়ে থাকে ঢাকা শহরের বায়ু দূষনের মূল কারণ শহরের চারপাশের এই ইটের ভাটাগুলো ঢাকার যানবাহনগুলোও পরিবেশ বান্ধব না শিল্প কলকাখানা, যানযাহন, মানুষের বিভিন্ন ধরনের কর্মকান্ড কার্বন নির্গমন করছে ফলে বায়ুমন্ডলে তাপমাত্রা বাড়ছে বাড়ছে বায়ুদূষণ গাছ কার্বনডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে প্রস্বেদনের মাধ্যমে পরিবেশকে শীতল রাখে কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় ঢাকাতে গাছ পালার পরিমান খুবই নগন্য শুধু ঢাকাতে না সারা দেশেই যতটুকু পরিমান বনাঞ্চলের প্রয়োজন তার থেকে শতাংশ কম রয়েছে আজ থেকে ৭০ বছর আগেও দেশে বনভূমির পরিমান ছিল ৪৭ শতাংশ কিন্তু বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক কাজে বনাঞ্চল উজাড় করা হয়েছে ফলে প্রকৃতির বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে

সাধারণত চৈত্র বৈশাখ মাসে বাংলাদেশ তাপমাত্রা বেশি থাকে কিন্তু ঢাকা শহরের সারা বছরই বেশি তাপমাত্রা বিরাজ করে যার মূলে রয়েছে মানুষের অপরিকল্পিত কর্মকান্ড, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি শীতের সময়টাও খুব বেশি দীর্ঘ হয়না ঢাকাতে কিন্তু গত দুই বছরের চিত্র  যেন আরো ভিন্ন গত দুই বছরে শীত একেবারেই কম অনুভূত হয়েছে সেই সাথে গত কয়েক বছরে বায়ুদূষণের মাত্রা অত্যাধিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে বায়ুদুষণের মাত্রা ছিল সর্বাধিক, বায়ু গুণ সূচকে যার মান ৩৪৮ যার অর্থ বাতাসের গুণমানবিপদজনক ঢাকা এয়ার কোয়ালিটি ইনডিক্স (একিউআই) তে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে

সারা পৃথিবীর ন্যায় বাংলাদেশেও করোনা মহামারী রূপ ধারণ করেছে সরকার দীর্ঘ দিন লকডাউন দিয়ে করোনা দূর্যোগ মোকাবিলা কাজ করছে, যদিও বর্তমানে লক ডাউন কিছুটা শিথিল করা হয়েছে ফলে কলকারখানা, যানবাহন সহ মানুষের কর্মকান্ড অনেকটা স্থবির হয়ে রয়েছে যা প্রাকৃতিক পরিবেশে উপর প্রভাব ফেলছে কার্বন নির্গমন কমে যাওয়ায় ঢাকার বায়ু দুষণের পরিমাণও কমে গেছে

নিম্নে একটি চিত্রের মাধ্যমে গত বছরের নভেম্বর থেকে ২০২০ এর জুন মাস পর্যন্ত বায়ু দূষণের মাত্রার তারতম্য দেখানো হল:

( সূত্র: https://aqicn.org/city/dhaka/)

চিত্রে দেখা যাচ্ছে, নভেম্বর ২০১৯ এয়ার কোয়ালিটি ইনডিক্স (একিউআই) ঢাকা তে ষনের মাত্রা ১৯৪ কিন্তু ডিসেম্বর মাসে বায়ু দূষনের মাত্রা ছিল ৩৪৮ , যেখানে মঙ্গোলিয়ার উলানবাটার, পাকিসত্মানের লাহোর এবং ভারতের দিলস্নী তে যথাক্রমে ২৫৮, ২২০ ২১০ পরবর্তী তিনটি স্থান দখল করেছে জানুয়ারি ২০২০ ঢাকাতে বায়ু দূষণের মাত্রা ছিল সর্বাধিক এয়ার কোয়ালিটি ইনডিক্স (একিউআই) সবচেয়ে খারাপ বাতাস নিয়ে শহরগুলির শীর্ষে চলে আসে জানুযারি মাসে সর্বাধিক বায়ু দূষণের মাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪০৮ পাকিসত্মানের লাহোর এবং ভারতের দিল্লিতে ৩০৮ এবং ২৮২ এর একিউআই স্কোরসহ খারাপ বায়ু মানের পরবর্তী শহরগুলির তালিকাতে রয়েছে ফেব্রম্নয়ারি মাসে বায়ুমান ছিল ২৩৫ কিন্তু মার্চ মাস থেকে বায়ু দুষনের পরিমাণ অনেকটাই  কমে গেছে মার্চ মাসে ঢাকার বায়ু মান ছিল ১৪৮ এবং এপ্রিল মাসেও বায়ু মান রেকর্ড করা হয়েছে ১৬৮ মে মাসে ঢাকার বায়ু মান ছিল সবথেকে ভাল মে মাসে গড়ে বায়ু মান ছিল ৫৫ যা গত কয়েক মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন করোনার কারনে মার্চ মাস থেকে ঢাকা মহরকে লকডাউন করা হয় স্বাভাবিক কর্মকান্ড অনেকটাই বন্ধ হয়ে যায় এই সময় ঢাকার বাতাস এখন অনেকটা নির্মল কারণ কী? ইতিমধ্যে আমরা জেনেছি করোনা ভাইরাস সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে গেছে  উলেস্নখ্য যে, যখন একিউআই মান ৩০০ এর বেশি হয়, তখন তা সবার জন্য ঝুকিপূর্ণ

কিন্তু ঢাকার এই সময়ের তাপমাত্রার তারতম্য খুব সামান্য দেখা গেছে বায়ু দূষণ কমলেও তাপমাত্রা না কমার প্রধান কারন হচ্ছে ঢাকা শহওে গাছপালার পরিমাণ খুবই কম নিম্নে একটি টেবিলের মাধ্যমে ২০১৯ এর প্রথম মাস এবং ২০২০ সালের প্রথম মাসের সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা এবং সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা এর পার্থক্য দেখানো হল:

 

২০১৯

২০২০

মাস

সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা (সেলসিয়াস)

সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা (সেলসিয়াস)

মাস

সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা (সেলসিয়াস)

সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা (সেলসিয়াস)

জানুয়ারি

২৫.

১২.

জানুয়ারি

২৪

১১

ফেব্রুয়ারি

২৮.

১৫.

ফেব্রুয়ারি

২৮

১৪

মার্চ

৩২.

২০.

মার্চ

৩২

২০

এপ্রিল

৩৩.

২৩.

এপ্রিল

৩৪

২৩

মে

৩৩.

২৫

মে

৩৩

২৪

জুন

৩২.

২৬.

জুন

৩৩

২৬

 

(সূত্র: www.holiday-weather.com/dhaka/)

এতে দেখা যাচ্ছে যে, লকডাউনের ফলে ঢাকাতে তাপমাত্রা কমেনি

করোনাকাল শেষ হওয়ার পরেও যাতে বায়ু দূষণের মাত্রা কম থাকে সেইজন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে সেগুলো হল:

ঢাকা শহরের আশেপাশের ইটভাটাগুলি শহরের দূষণের জন্য ৫২ শতাংশ দায়ী, তাই ইটভাটাগুলিতে দূষণের মাত্রা কমানোর জন্য দড়্গ টেকসই শক্তি ব্যবহারের জন্য সরকার থেকে দ্রুত যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত

এলাকাগুলিতে অনিবন্ধিত  ইটভাটার বিরম্নদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে

ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার কমানো এবং ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারে নিরম্নত্সাহিত করতে হবে

সপ্তাহে একদিন অথবা দুইদিন শহরকে ব্যক্তিগত গাড়ি মুক্ত করা যেতে পারে

উন্নয়নমলক কাজে (যেমন মেট্রো-রেল, ড্রেন, রাস্তার সংস্কার কাজ) এড়্গেত্রে বায়ু দূষণের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে দেখতে হবে

নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে

ঢাকাতে বৃক্ষরোপণ এর বিষয়টি খুবই গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে

প্রাথমিকভাবে, এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা হলে ঢাকাতে বায়ুদূষণ এবং তাপমাত্রাও কমানো যেতে পারে ঢাকাতে কিছু এলাকাহিট আইসল্যান্ড বা তাপ-দ্বীপ রয়েছে সেই এলাকাগুলোতে বেশি করে গাছ লাগাতে হবে

লকডাউনে বায়ু মান মাত্রাতে আমরা দেখতে পেয়েছি সেই বায়ু-মান ঢাকাতে সব সময় আমরা দেখতে চাই সে জন্য আমাদের সবারই ভূমিকা রাখা উচিত

মুসফেরা জাহান শর্মি, নগরপরিকল্পনাবিদ
মো. শাহিন রেজাশিক্ষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন