১২০ কভিড হাসপাতালের ৭১টির ব্যবস্থাপনাই নাজুক

ফয়জুল্লাহ ওয়াসিফ

বেসরকারি হাসপাতাল হিসেবে করোনা রোগীদের সেবা প্রদানের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে নিবন্ধিত হয়েছিল রাজধানীর রিজেন্ট হাসপাতালের দুটি শাখা। সেবা মূল্যায়নে অধিদপ্তরের স্কোর কার্ডে সবুজ চিহ্নযুক্ত হাসপাতালের তালিকায় স্থানও করে নিয়েছিল রিজেন্ট। সম্প্রতি করোনার ভুয়া সনদ প্রতারণার অভিযোগে এই হাসপাতালটিতে অভিযান চালিয়ে সিলগালা করে দিয়েছে র‌্যাব।

তো গেল সবুজ চিহ্নিত হাসপাতালের চিত্র। এর চেয়ে আরো খারাপ পরিস্থিতি হলুদ লাল চিহ্নিত হাসপাতালগুলোর। রাজধানীর উপকণ্ঠে কভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসা দিচ্ছে এমন আরেকটি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান আমিনবাজার ২০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল। করোনা চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় তেমন কোনো ব্যবস্থাপনাই চোখে পড়েনি। হাসপাতালটিকে লাল চিহ্নিত হাসপাতালের তালিকায় রেখেছে অধিদপ্তর।

দেশে নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসা দিতে নির্ধারণ করা ১২০টি হাসপাতাল রয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ন্যাশনাল হেলথ ফ্যাসিলিটি প্রিপেয়ার্ডনেস অ্যান্ড রেডিনেস র‌্যাপিড অ্যাসেসমেন্ট চেকলিস্ট ফর কভিড-১৯ শীর্ষক তালিকায়। এর মধ্যে ৭১টি হাসপাতালের সার্বিক ব্যবস্থাপনাই সন্তোষজনক অবস্থানে নেই।

বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি ডা. মোস্তাফা জালাল মহিউদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, হাসপাতালগুলোর ব্যবস্থাপনা আরো উন্নত করা গেলে সেটা রোগী সেবা প্রদানকারী সবার জন্যই ভালো হবে। কিছু হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা নিয়ে অসন্তুষ্টি আছে। সেটার দিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজর দেয়া উচিত বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।

চেকলিস্টের স্কোর কার্ড অনুযায়ী, সবুজ তালিকায় রয়েছে মাত্র ৪৯টি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। বাকি ৭১টি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে পিছিয়ে থেকে হলুদ লাল চিহ্নিত তালিকায় অবস্থান করছে। এর মধ্যে মোট স্কোরে ৩০-এর কম পয়েন্ট নিয়ে ১০টি হাসপাতাল আছে লাল চিহ্নিত তালিকায়। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো হলুদ চিহ্নিত তালিকায় অবস্থান করছে। যে প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থাও খুব বেশি ভালো না।

র‌্যাপিড অ্যাসেসমেন্ট চেকলিস্টের তথ্য মতে, কভিড চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত এই ১২০টি হাসপাতালের অ্যাসেসমেন্ট প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত আছে বেশকিছু আন্তর্জাতিক এজেন্সি। এর মধ্যে কনসার্ন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ছয়টি, ইউনিসেফ পাঁচটি, ইউএনএফপিএ আইসিডিডিআর,বি যৌথভাবে ২২টি, ইউএনএফপিএ এসএনএফপি যৌথভাবে ১৪টি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০টি, ইউনিসেফ আইসিডিডিআর,বি যৌথভাবে ১০টি, ইএসএআইডি এমটিএপিএস যৌথভাবে ১৯টি এবং  ইএসএআইডি এসসি যৌথভাবে ২৪টি হাসপাতালের সঙ্গে কাজ করছে।

এসব সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিশেষায়িত হাসপাতাল রয়েছে ১৬টি, সদর হাসপাতাল মানের প্রতিষ্ঠান ৫৯টি, মেডিকেল কলেজ ২০টি, উপজেলা হাসপাতাল ছয়টি, প্রাইভেট হাসপাতাল নয়টি এবং এনজিও অন্যান্য হাসপাতাল মিলিয়ে আরো ১০টি প্রতিষ্ঠান সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে শুধু কভিড রোগী চিকিৎসার জন্য নিবেদিত আছে ১৯টি হাসপাতাল। বাকি ১০১টি প্রতিষ্ঠানে কভিড রোগীদের সঙ্গে অন্য রোগীদেরও সেবা প্রদান চালু রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র।

চেকলিস্টটি করতে সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর লিডারশিপ, ইনফেকশন প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল (আইপিসি), কেস ম্যানেজমেন্ট, ওয়াশ, মনিটরিং অ্যান্ড রিস্ক ইভ্যালুয়েশন, এসেনশিয়াল সাপোর্ট সার্ভিস, ট্রিয়েজ এসেনশিয়াল হেলথ সার্ভিস অ্যান্ড প্যাশেন্ট কেয়ারের মতো বিষয়গুলো পৃথকভাবে মূল্যায়নের মাধ্যমে মোট স্কোর প্রদান করা হয়েছে। সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো ৮৮ দশমিক স্কোর নিয়ে তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে ঢাকার আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ। এরপর ৮৬ দশমিক ৮৪ দশমিক পয়েন্ট নিয়ে যথাক্রমে দ্বিতীয় তৃতীয় অবস্থানে আছে লক্ষ্মীপুর সরকারি হাসপাতাল মিরপুরের মাতৃ শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ গবেষণা ইনস্টিটিউট।

তবে দেশে করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত এসব হাসপাতালের অধিকাংশেরই চিকিৎসাসেবা নিয়ে আছে নানান প্রশ্ন। হাসপাতালগুলো ঘুরেও সেবার মান ব্যবস্থাপনা নিয়ে নানান সংকটের চিত্র উঠে এসেছে। এমনকি এখনো সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে সেবা প্রদান চালু করতে পারেনি বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে কভিড চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত সবচেয়ে বড় বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টারের হাসপাতালটি নিয়েও আছে নানা প্রশ্ন। যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এসব ব্যাপারে বরাবরই তাদের প্রস্তুতি তোড়জোড়ের কথা বলা হচ্ছে। তবে এতে হাসপাতালগুলোর দৃশ্যমান কোনো উন্নতির লক্ষণ নেই বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকায় লাল চিহ্নিত হাসপাতাল রয়েছে ১০টি। এগুলো হলো পিরোজপুর সদরের আম্বিয়া হাসপাতাল, ইউনাইটেড ক্লিনিক অ্যান্ড প্যাথলজি, মাজহারুল হক বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতাল, মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ডায়াবেটিক হাসপাতাল, ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশন মার্কেট হাসপাতাল, আমিনবাজার ২০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল, মেঘদবি ২০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল, চর আলগি ২০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল, নোয়াখালী অন্ধ কল্যাণ চক্ষু হাসপাতাল বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টার (অস্থায়ী হাসপাতাল)

কভিড হাসপাতালগুলোর সঙ্গে যুক্ত আন্তর্জাতিক এজেন্সিগুলো বলছে, হাসপাতালগুলোর সার্বিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে তারা সরকারের সঙ্গে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। নিয়মিতভাবে তাদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরছে বলে বণিক বার্তাকে জানালেও ব্যাপারে কেউ সরাসরি মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তারা বলছে সরকার সামর্থ্যের মধ্যে চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে হাসপাতালগুলোর ব্যবস্থাপনা নিয়ে কিছু অভিযোগ তাদের কানে এলেও বিষয়ে গণমাধ্যমে মন্তব্য করবে না বলে জানান কয়েকটি আন্তর্জাতিক এজেন্সির কর্তাব্যক্তি।

দেশের কভিড হাসপাতালগুলোর সার্বিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলতে বণিক বার্তার পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. মো. আমিনুল হাসানের সঙ্গে মুঠোফোনে বারবার যোগাযোগ করতে কল মেসেজ দিলেও তিনি সাড়া দেননি।

বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক আয়শা আক্তার বণিক বার্তাকে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালকসহ (হাসপাতাল) অন্যরা বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছেন। ধরনের জাতীয় সংকটে সবার সহযোগিতা চেয়ে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে সহনশীল মনোভাব পোষণের অনুরোধ জানান তিনি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন