অভিমত

পোলট্রির ওপর অপবাদমূলক অপপ্রচার ও সংশ্লিষ্টদের দায়বদ্ধতা

ডা. মো. নূরে আলম, ডা. মো. আনিসুর রহমান

বিশ্বজুড়ে সব বয়সী মানুষের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়, সুলভ প্রোটিন উৎস হলো পোলট্রি মাংস ডিম। দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ প্রাণিজ প্রোটিন সরবরাহ আসে প্রাণিসম্পদ খাত থেকে, যার সিংহভাগ আসে পোলট্রি থেকে। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে দেশের মানুষ মুরগি পালন করে আসছে। জামাই আপ্যায়ন করতে মুরগি দৌড়ানোর ইতিহাস মুরুব্বিদের আনন্দ দেয়।

শিল্পায়নের যুগে মুরগি পালনের ধারায় যেমন ছেদ পড়েনি, তেমনি জনপ্রিয়তায়ও ভাটা পড়েনি; বরং পাঁচ শতাধিক বিভিন্ন রকম রেসিপি নিয়ে পোলট্রি এখন গাছতলা থেকে ফাইভ স্টার হোটেলে সব শ্রেণীর মানুষের রসনাবিলাস করছে। মুরগি পালন শিল্পে পরিণত হয়ে দেশের পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বেকারত্ব নিরসনে বিশাল ভূমিকা রাখছে পোলট্রি খাত। সহস াধিক ফিড মিল, হ্যাচারি, কাঁচামাল আমদানিকারক, সরবরাহকারী, পরিবহন, মেডিসিন কোম্পানি, টিকা উৎপাদক, আমদানিকারক, বিপণন কোম্পানির পাশাপাশি লাখো এজেন্ট, ডিলার, পাইকারি, খুচরা ব্যবসায়ীসহ দুই লক্ষাধিক খামার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছে দুই কোটির বেশি মানুষের, প্রত্যক্ষভাবে ২৫ শতাংশ পরোক্ষভাবে দেশের মোট শ্রমশক্তির ৫০ শতাংশ প্রাণিসম্পদ খাতের সঙ্গে জড়িত। বিশাল জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণে পাল্লা দিয়ে যেমন উৎপাদন বেড়েছে, তেমনিভাবে দেশী-বিদেশী বিশাল শিল্পগোষ্ঠীর নজর এখানে পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই নজর পড়েছে কিছু স্বার্থপর গোষ্ঠীর, যারা জনগণের চাহিদাকে নিজস্ব অনৈতিক ফায়দা হাসিলে ব্যবহার করতে চায়। এরা চায় না দেশের খামারিরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াক! বরং এরা চায় দেশী খামারিরা মরে যাক, তারা ৫০ টাকার পেঁয়াজ ২০০ টাকার মতো আমদানি করে উচ্চমূল্যে জনগণকে মুরগির মাংস খাওয়াক। ফলে বারবার তাদের মিথ্যাচারের শিকার হয়েছে পোলট্রি খাত।

যদিও বাজারের ফিড নিয়ে গবেষণা হয়নি, কিন্তু পোলট্রিকে হজম করতে হয়েছে ক্রোমিয়ামের অপবাদ, চিনির ফানির অপবাদ, কথায় কথায় ক্যান্সারের দায় চাপানো হয়েছে, এরই ধারাবাহিকতায় গত কয়েক দিন থেকেই বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের অনলাইন ভার্সনসহ নামে-বেনামের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে নতুন রোগ সালমোনেলা ভাইরাস মুরগি থেকে ছড়াচ্ছে এবং মুরগি থেকে ছড়াচ্ছে নতুন ভাইরাস সালমোনেলাসহ নানা শিরোনামে বিভিন্ন খবর দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। কোনো পত্রিকা বলছে, এটি একটি ভাইরাস আবার কোনো পত্রিকা বলছে ব্যাকটেরিয়া। প্রথমত, যারা ব্যাকটেরিয়া ভাইরাসের তফাত বোঝেন না বা জানেন না, এমন অনভিজ্ঞ সাংবাদিকদের পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রির মতো এত বড় বিষয় নিয়ে ধরনের সংবাদ প্রকাশ করা রীতিমতো অনাচার। অজ্ঞতা নীতিহীনতাই এজন্য দায়ী।  ধরনের খবর ছাপার আগে দেশে যারা পোলট্রি বিশেষজ্ঞ আছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলার দরকার ছিল। রকম ভিত্তিহীন খবর ছাপানোর ফলে জনগণ পোলট্রি, পোলট্রিজাত পণ্য ডিম খাওয়া ছেড়ে দিলে কিংবা পোলট্রি শিল্পের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়লে কী হবে, এর দায়ভার কে নেবে? এমনিতেই করোনা পরিস্থিতি, সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনার অভাব পোলট্রি কোম্পানি খামারিদের পথে বসিয়ে দিচ্ছে!

মানুষ সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়ার একত্রে বসবাস বিশ্বজুড়ে। সালমোনেলোসিস বা ফাউল টাইফয়েড একটি ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট রোগ। রোগ যুগের পর যুগ বাংলাদেশসহ বিশ্বের পোলট্রি সেক্টরে অবস্থান করছে। এতদিন তো সামোনেলোসিস দ্বারা কোনো মানুষ আক্রান্ত হয়নি? আর যেহেতু ব্যাকটেরিয়াল ডিজিজ, তাই রোগ নিয়ে কোনো মাতামাতি নেই। বায়োসিকিউরিটি মেনে, প্রোবায়োটিকস, ক্লোরিন এসিডিফায়ার ব্যবহার করে সহজেই একে কন্ট্রোল করে খামার চলছে।

তাহলে কেন বাজেটকালীন প্রতি বছর নতুন নতুন গুজব ছড়িয়ে প্রাণিসম্পদ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রির ক্ষতি করা হচ্ছে?

সমস্যার স্থায়ী নিরসনে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো নেয়া যেতে পারে

. প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরকে ঢেলে সাজানো, যাতে পোলট্রি উৎপাদন, ফিড থেকে শুরু করে সব কাঁচামাল উৎপাদন সরবরাহ ব্যবস্থায় কঠোর নজরদারির মাধ্যমে সবার জন্য নিরাপদ পোলট্রি মাংস ডিম উৎপাদন করতে পারে। এজন্য প্রাণিসম্পদের লোকবল কাঠামো (অর্গানোগ্রাম) সত্বর বাস্তবায়ন করা জরুরি।

. বাংলাদেশ এগ্রিকালচারাল ডেভেলমেন্ট করপোরেশন বা মত্স্য উন্নয়ন করপোরেশনের আদলে পোলট্রি ডেভেলপমেন্ট বোর্ড বা করপোরেশন গঠন করে কঠোর মান নিয়ন্ত্রণ বাজার ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন করা যেন খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত না হন।

. শক্তিশালী মিডিয়া উইং গঠন করা, যাতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, পোলট্রি শিল্পের দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান, যেমন বিপিআইসিসি, আহকাব, খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদ, মিডিয়া প্রতিনিধি থাকবে। তারা সব অপপ্রচারের মুখোশ উন্মোচন করবে, সত্য প্রচার করবে এবং এর পেছনে কারা জড়িত, তাদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনবে এবং এসব গুজব ছড়ানো মিডিয়ার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবে।

 

ডা. মো. নূরে আলম: ভেটেরিনারি সার্জন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর

ডা. মো. আনিসুর রহমান: জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা, ফেনী

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন